সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
…আমরা কার শরণ নেব? জড় বুদ্ধিজীবীদের? মৃত রবীন্দ্রনাথের? নাকি জ্যান্ত খবরের কাগজের? কেউ সঙ্গে নেই। বাঙালি বুদ্ধিবণিকরা আজ কমবেশি প্রায় সকলেই নীরব। তারা প্রত্যেকেই ভাবছেন যে আর কথা বলার দরকার নেই, আজকের এই পৃথিবী অনুদানমুগ্ধ; নীরবতাই শ্রেষ্ঠ পন্থা।…
একদিন আমরা বিভাজন রেখা সামনে দেখে ‘দোহাই আলি’ বলেছিলাম। ঈশ্বর ও আল্লা কোনও আকাশবাণী করেননি। আমাদের ইতিহাসযান চুরমার হয়ে গেল রেলপথের বাফারে। সেই থেকে আমরা ভ্রাম্যমান, পথচ্যুত। আমাদের কোনও মোজেস নেই, যিনি সমুদ্র বিভক্ত করে আমাদের প্রার্থিত ভূমিতে পৌঁছে দেবেন। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা যে যার মতো নিজেদের আস্তানা গড়ে নেব। কিন্তু আজ শুনছি আমাদের জন্মপরিচয়ের প্রমাণ দিতে হবে৷ আমাদের মা যন্ত্রণায় নীল, রুধিরাক্ত এই যে শস্যশ্যামলা আসমুদ্র হিমাচল গড়ে তুলেছেন, সেখানে আমাদের কান্না কোথায় লিপিবদ্ধ আছে, তার নথিপত্র পেশ করতে হবে। সে তো আমাদের জানা নেই৷ আমরা শুধু এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, এক রাত্রি থেকে আরেক রাত্রির কাছে ছুটে গেছি। এ এক অসমাপ্ত শিশুতীর্থের বিরুদ্ধযাত্রা৷ আমরা কার শরণ নেব? জড় বুদ্ধিজীবীদের? মৃত রবীন্দ্রনাথের? নাকি জ্যান্ত খবরের কাগজের? কেউ সঙ্গে নেই। বাঙালি বুদ্ধিবণিকরা আজ কমবেশি প্রায় সকলেই নীরব। তারা প্রত্যেকেই ভাবছেন যে আর কথা বলার দরকার নেই, আজকের এই পৃথিবী অনুদানমুগ্ধ; নীরবতাই শ্রেষ্ঠ পন্থা।
আমার তা মনে হয় না। বরং আমার মনে হয়, আমরা এই যে বেঁচে আছি, তার জন্য কখনও কখনও আমাদের কথা বলতে হবে। আমাদের বলতে হবে, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’ আজ আমি করিমগঞ্জের, হাইলাকান্দির অথবা কাছাড় জেলার ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোর কথা ভাবি, যা শীঘ্রই তৈরি হবে, যেখানে শিশু, নারী, তরুণী, তরুণ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা স্থান পাবে। তারা হয়তো পিএল ক্যাম্পের বাসিন্দায় পরিণত হবে। কিন্তু কার এই পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি, কিসের স্থায়ী দায়িত্ব? আসলে যে যার জন্মের জড়ুল বহন করে যাবে, যে যার জন্মের জন্য শাস্তি পাবে। আজ আমার কোনও জবানবন্দি দেওয়ার নেই। তার কারণ আমি একা বা আমার মতো কয়েকজন, যারা দুনিয়ার হতভাগ্য, নোম চমস্কি যাদের ‘উদ্বৃত্ত জনপুঞ্জ’ বলেছিলেন, আমরা তো তারাই। আমাদের দেশ পরিচয় নেই। আমাদের ভূমিপরিচয় নেই। আমাদের কবচকুণ্ডলও নেই। আমাদের ইচ্ছায় আমাদের বাসস্থান নিয়ন্ত্রিত হয় না। তা শাসকের হুকুমে হয়। শুধু দেখতে পাই, ওই যে ডিটেনশন ক্যাম্প, যাকে আমার কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ভাবতে ইচ্ছে হয়, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কোনও শিশুকে টাটকা আখের রস খাওয়াচ্ছেন চে অথবা রবীন্দ্রনাথের গোরা। সেই চে যিনি নিজেই রাষ্ট্র-পরিচয়হীন, রাষ্ট্র-পরিচয়কে যিনি জীর্ণ বস্ত্রবৎ ত্যাগ করেছেন, সেই চে এই মুহূর্তে বলিভিয়ার ক্ষেত থেকে আনা টাটকা আখের রস এনে খাইয়ে দিচ্ছেন করিমগঞ্জের, হয়তো বা নদিয়ার কোনও শিশুকে। এটুকু স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি, এটুকু স্বপ্ন নিয়েই যেন চলে যেতে পারি।