ঈশানী বসাক
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় খাবার নিতে ভুলে গেছিলাম। সন্ধ্যায় খানিক চিকেন ভর্তা আর পরোটা রান্না করেছিলাম। বাঙালির যা স্বভাব, রাতের খাবার আর জগন্নাথ এক্সপ্রেস কিংবা দার্জিলিং মেল। সেবা হাসপাতালের কাছে এসে মনে পড়তেই অর্ণবকে দাঁড়াতে বলে খাবারটা নিতে আবার ফিরে আসি। সে তো অধৈর্য, জলদি আয়। আমি ছুটতে ছুটতে দূরে যাবার আগে দেখি সে ফোনের দিকে তাকিয়ে। একবার ভাবলাম, পালাই তাহলে, কী হবে ভালবাসা নিয়ে!!
গরম খাবারের প্যাকেট নিয়ে কেয়ারটেকার জেঠু রাস্তার ধারে অপেক্ষায়। ফেলে গেছিলে দিদিমণি। ওপারে ছেলেটা তাকিয়ে। ফিরতেই হয়, সবাইকে ফিরতে হয়।
দুই
শিয়ালদহ নাইন এ-তে ট্রেন দিয়েছে। ঘণ্টাখানেক দেরি। আকাশ এসে অপেক্ষা করছে। ট্যাক্সিতেই বার তিনেক ফোন, কই, কতদূর ইত্যাদি। আমরা তিনজন নিহত জওয়ান। একজন সেক্টর ফাইভ, একজন মধ্যমগ্রাম, একজন দেশপ্রিয় পার্ক। ক্লান্ত, গরমে অসুস্থ। সিগারেট খেতে দেবে না স্টেশন চত্বরে। তাই একটু বাইরে গিয়ে দুজনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আকাশের রুকস্যাক, আমার ট্রলি। অর্ণবের শুধুই স্কুলব্যাগ।
স্লিপার কোচের দরজা খোলেনি। কামরার গরমে হাপিত্যেশ করে বসে। আকাশ দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল এসি বুক করার কথা। পরের বার এসি ছাড়া যাব না। নিজেরাই হেসে উঠলাম। আগে কত কষ্ট করতে পারতাম। দোনোমোনো করে ডিনার খুললাম। খাবার খেতে খেতে জল খাচ্ছি। খুব কাশি হয়েছে।
–তোকে না জল খেতে খাবারের মাঝে কতবার মানা করেছি?
খাবার পর আকাশের কাফসিরাপটা খেয়ে ফেলেছি খানিক। অর্ণব যথারীতি আপার বার্থে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেদিন ও ছাড়া কামরার সবাই জেগে ছিল। অপরাধ আমার কাশি। যদিও আকাশের ট্রেনে ঘুম হয় না। বার কয়েক বললাম, এই গুলি ঘুমাবি না? অর্ণবও যখন ঘুমাতে বলল গুলি আনমনে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল, নাহ। তোর মুখে ট্রেনের আলো পড়ছে। তুই একটানা কেশে যাচ্ছিস। দু বার তো বাথরুম থেকে এলি। কাফসিরাপ খা। আমি জেগে আছি।
বন্ধুরা এমনই হয়।
তিন
আকাশ মুখ কুঁচকে রয়েছে। মেঘ নেই। আজ বৃষ্টি আসেনি। তাই হয়তো। পাতলা স্টোল জড়িয়ে ধরে বাইরে দেখছি। নতুন বিয়ে, একটি মেয়ে প্রথম বার ভয়ে ভয়ে উঠছে গাড়িতে। ছেলেটি মালপত্র সিটের তলায় রাখছে।
আমাকে সে জিজ্ঞেস করল। তাহলে আমরা যাচ্ছি? আনমনাভাবে আকাশ বলল, “চলে যেতে হবে বলে যাচ্ছি, না হলে তো আরেকটু থাকতাম।” ঘর পোড়ার গল্পের নেশায় বুঁদ যারা তারা কোনওদিন গাড়ি ছাড়ার সিগনাল শুনতে চায় না। কানে আঙুল, নেশা আর বৃষ্টি ছাড়া খোলা আকাশের নীচে সমুদ্রও অসহায়। টাইমলাইনে আল মাহমুদ, সোনালি কাবিন। লাভ রিঅ্যাক্ট দিয়ে চোখ বুজি। ট্রেন ছাড়লে ভয় লাগে খুব এখনও…
চার
বদহজম, বমি সেরেও ঘুম নেই। অর্ণব আপার থেকে নেমে পাশে বসল। আকাশ আপারে গিয়ে শুল।
–ওর পাশে বস।
–আকাশদা তুমি ঘুমাবে না?
–ধুত আমার অভ্যেস আছে। ঈশানীর কষ্ট হচ্ছে। গরম প্লাস এই কাশি। ট্রেনের জানালায় ওর চুলগুলো ধাক্কা দিচ্ছে। একটা অদ্ভুত আলো মাখা ব্যথা ওর দু চোখে। আমি চুপচাপ গান শুনছি। ওকে দিয়ে কথা বলালে আরও শরীর খারাপ হবে। এই তুই এসেছিস। যাই আমি ওপরে গিয়ে শুই।
সারারাত অর্ণব মাথায় হাত বুলিয়ে জল খাইয়ে বসে থাকে। জানালার পাশে হঠাৎ দেখি ঘুমিয়ে পড়েছে বসে বসে। কাশির দমকা সামলে সরে যেতে চাই। ওর জেগে থাকার কারণ হতে চাই না। এদিকে দার্জিলিঙের কাছে আসার অনেক দেরি। সে ঘুম ভেঙে এসে জল এগিয়ে দেয়। দিনের আলোয় জানালায় প্যাস্টেল রঙ। রানি রঙের আগুন শাড়িতে কমলালেবুর মিষ্টি বুটি। জমা জল, ধানগাছ। তার বিস্ময় চোখে সমতল আঁকা।
–পাহাড় কতদূর রে?
ওই তো, এই এসেই গেল। বাবা বলত, এই তো সোনা আরেকটু। আমিও হঠাৎ তাই দেখলাম। আরেকটু পরেই পাহাড়…
… পাহাড় কতদূর রে? (ছবি; ঈশানী বসাক)
পাঁচ
মেঘেদের উপর থেকে দেখব এমন ইচ্ছে নিয়ে স্কুলের আঁকার খাতায় ঘাসের উপর ভাসিয়ে দিয়েছি আকাশ। চিরকালীন বাঘ বনে বেরিয়ে হাত ধরে নিয়ে চলে সেইসব শীতল বাতাসের কাছে।
–ওই দেখ, ওই যে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
শুটিং-য়ের লক্ষ্যভেদী চোখ ধরে ফেলে ঈশ্বরকে ধূপগুড়িতেই। বাইরে তখন ট্রেনের দরজায় রঙ চেনাচ্ছে প্রকৃতি। আর্টিস্ট কেক কালারের গাঢ় কমলা, বেগুনি রঙের ভার্সানে ক্ষেতের সবুজ ফসল হতভম্ব। এমন সব ছবির সামনে দূরপাল্লার গাড়ি থামেনি। মোবাইলের স্পোর্টস মোডে নড়ে যাওয়া রঙ্গোলি।
কাশতে কাশতে গলার কাছে মাফলার শক্ত হতে থাকে। বুঝি শ্বাসনালিতে চাপ পড়ছে লালচে কড়াপাক ঠান্ডার। দৌড়ে নেমে চা এনে দিয়েছে ছেলেটি। আমি আরামের নিঃশ্বাসে মিশে না থেকে সিটে মাথা রাখি। সারারাত জেগে থাকা ভুলে একটা কাফসিরাপ শেষে জানলার ভোর বড় ক্লান্ত। গুলি ট্রেন থামতেই ছেলেটিকে নিয়ে এগিয়ে যায়। রাঙ্গাপানি, চটের হাট। দার্জিলিং মেল দাঁড়িয়ে আছে। কে যেন বলছিল কানাডিয়ান ইঞ্জিনের কথা। বিধাননগর দিয়ে যাবার সময়ে সেই কানাডিয়ান ইঞ্জিন লাগানো দার্জিলিং মেল বনগাঁ লোকালে ধাক্কা মারে। শ দুয়েক লোক মহাপ্রস্থানের পথে। এখন সেই ট্রেনটায় বসে। বি থ্রি সব থেকে পুরনো এসি। ওই যে এনজেপি। দুজন সঙ্গী জানলার রডে নাক লাগিয়ে। শুকনো কাশির দমকে হিমশিম খেতে খেতে নেমেছি নিউ জলপাইগুড়ি। মিটার গেজ, ব্রডগেজ আর ন্যারোগেজের একটুকরো ছোটবেলা। ওই যে কালো রঙের মিটার গেজ রেখে দিয়েছে স্টেশনের বাইরে। এখন আর চলে না। পুরনো সিনেমা হল যেন। একটুকরো ছায়ামহল।
একটুকরো ছায়ামহল … (ছবি; ঈশানী বসাক)
ছয়
গুরুংজি বলেছেন গাড়ি পাঠাবেন। চলে এসেছে গাড়ি। ওষুধের দোকানে গিয়ে বললাম ম্যাজিক দিন। সারারাত কেশেছি। এবার ম্যাজিক চাই। মেঘের দেশে যাব বলে কথা। তা দিলেন কাকা, আর সঙ্গে স্ট্রেপসিল। ম্যাজিক ওষুধ দুপুরের পর। ততক্ষণে স্ট্রেপসিল মহানন্দার উপর। উত্তেজনায় গিলে ফেললাম। দু পাশে জঙ্গল, প্রায় চার মাস বাদে এ পথে। ঘরে ফেরার তাড়া…
বোলেরোর প্রচন্ড হাওয়া। এগিয়ে আসছে জঙ্গল। দুদিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ রঙের চোখ। কলকাতার রাস্তায় মরে যাওয়া কাঠবিড়ালিটা ছুটছে এ গাছ থেকে ও গাছ। আমরা ঈশ্বরের কাছে যাচ্ছি। আমার ছবির খাতার মেঘেরা মাটির কাছে নেমে আসছে। হাত পিছলে পড়ে যাচ্ছে তিস্তা। পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নদী পাশ ফিরে শুয়ে থাকে।
–ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
বলো কোথায় তোমার দেশ?
বাগরাকোটের রাস্তায় কাশিমবাজারের সাদা থাম। আমরা পাখির ডানা হয়ে ছুটি সেই ব্রিজে। নদী সরে যেতে যেতে বলে, খোদা হাফেজ।
আমরা পাখির ডানা হয়ে ছুটি সেই ব্রিজে (ছবি; অর্ণব বসু)
সাত
চায়ের দোকানে ভিড়। এলাচদানা, কফির কাপ, লিকার। সঙ্গী দুজন ঘুমোচ্ছে। অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বাড়িয়ে দিলাম কাপ।
–খেয়ে নে, এরপর চড়াই।
আকাশের ভার্টিগো। উঁচু থেকে দেখতে ভয় পায়। খাদের দিকে তাকাস না গুলি। সে হাত বাড়ায় সামনের সিটে।
–শয়তান, এখনি মনে করাতে হল?
যদিও এখন আর ভয় করে না। উঁচুতে উঠতে উঠতে ভুলেই গেছি সমতলের কথা।
অর্ণবের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ: “হোয়েন ইউ আর ইন দ্য হিলস ফরগেট দোজ হু আর ইন প্লেনস।”
বাইরে অ্যাভোক্যাডো পাইনের সারি। নীল আকাশের নীচ দিয়ে ঝরনার কলকল। কাকে ভুলব? কীভাবে ভুলতে পারি? যা কিছু প্রেম সব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। এই প্রতারণাদক্ষ কালো দীঘির সঙ্গে জমে থাকা যে সিঁড়ি তা বেয়ে পালিয়েছি দূরে। ব্যর্থতা নিয়ে চলে এসেছি এক কাপড়ে। খাদের কিনারে একা থাকব বলে। আমার কলেজের বাগানে এসব মনখারাপের কোনও প্রশ্রয় নেই। যদিও সঙ্গে কালো টিপের পাতা আনিনি। ছেলেটি কিনে রেখেছে দু পাতা। কিন্তু মন্দিরে হালখাতার পুজো দিতে গিয়ে টিপ লাগিয়েছে খাতায়। ভেঙে যাওয়া নৌকোর নজর না পড়ে। অর্ণব ঘুমাচ্ছিল এতক্ষণ। একটা উঁচু বাঁকে এসে হঠাৎ উঠে পড়ে। সতর্ক হই। না ওর এই আনন্দ নষ্ট যেন না হয় এতদিন বাদে। আমার হাতের উপর হাত রেখে দূরের ধ্বসের দিকে তাকিয়ে ও বলে ওঠে, ইটারনাল।
দূরে তখন ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে, এতদিনের…
ধ্বস বলতেই রেগে যায়। এই ভয় করে, অমন বলিস না।
হোয়েন ইউ আর ইন দ্য হিলস ফরগেট দোজ হু আর ইন প্লেনস (ছবি; ঈশানী বসাক)
আট
কবিতা নাকি গান? অন্তরা নাকি সঞ্চারী। সামনে সবুজ রঙের বাড়িটা যেন সঞ্চারী। দুরে সাড়ে চার হাজার ফুট নীচে শিলিগুড়ি, ডুয়ার্স।
–ইহাঁ নেটওয়ার্ক নেহি মিলেগা দিদি?
–না জি ইহাঁ বিএসএনএল সিরফ।
তাইপো খেতে খেতে বাইরে তাকাই। ছোট ভোলু পাশে এসে বসে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। আমরুটের ম্যাকিনটশ সহযোগে তাইপো। এ শুধু উত্তরবঙ্গের কামাল। যতবার এসেছি এই ডিমের কুসুম দেওয়া চিকেন বল একেবারে প্রেম। যদিও সঙ্গে ডোল্লের চাটনি ভোলা যাবে না। আগুন ঝরানো ঝাল। খেয়ে দেয়েই বলে ওঠা “একঘর”।
ইহাঁ নেটওয়ার্ক নেহি মিলেগা … (ছবি; আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়)
নয়
রিয়ান নদীর কাছে এসে আমি আর ছেলেটি মিশে গেলাম। সব ভুলের শেষে পাহাড় থাকে। আড়াল করে সব দোষ। নদীর সাদা ফেনার বুকে গর্জন। আকাশ তাকিয়ে সেদিকে। তার প্রেমিকাকে দেখায় জলের ছুটে যাওয়া।
–আসবি আমার সঙ্গে জয়িতা?
ওদের ইচ্ছে করে ভালোবাসতে। পাথরের কাছে নরম রোদে পোড়া মস। মেঘ ঘুরছে চারদিকে। নদীর মাঝখানের পাথরটায় গিয়ে বসি। জলগুলো পায়ের কাছে এসে বলে, আদর কোরো না আমাদের, ভয় করে। জয়িতার ইচ্ছে করছিলো বলতে, মন কেমন মন কেমন। আকাশ সিগারেটটা নিভিয়ে ওকে বলে, তোর ফোনটা বাজে। নেটওয়ার্ক থাকে না।
নদী রোজ বয়ে যায়। আমরা কালেভদ্রে হইহই করে আসি। নইলে সে একাই থাকে। সে জানে শব্দ ছাড়াই সে কথা বলতে পারে। আমরা যারা নদী না হতে পেরে মানুষ হলাম তারা ছবি দেখি, সমালোচনা করি, গান গাই, অবাক হই। পাশের দোকানে ম্যাগি হচ্ছে। তার মধ্যে চিকেন কিমা, ডিম। এইসব একলা জলের কিনারায় যাদের জীবিকা তারা কি মণীন্দ্র গুপ্তর নুড়ি বাঁদর পড়েছে? ভালোবাসাবাসি ফেলে রেখে গাড়িতে উঠলাম। কিছু লোক এগিয়ে আসছে। ভিড় দেখলে আমরা তিনজনেই পালাই।
নদীর সাদা ফেনার বুকে গর্জন (ছবি; আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়)
দশ
নামথিং লেকের ধারে সাইনবোর্ড, “হিলস হিল ইউ”। টিলার উপর শুয়ে আছি। মাটির গায়ে শুয়ে থাকার মজা আলাদা। দু পাশে খাদ। অসাবধানে এপাশওপাশ। একদম নীচে। জানি হে পাথর বেশি ভালবাসা তুমি নিতে পারো না। যদি দৈবাৎ পেরে যাও তাহলে তো আমাকে তোমার অন্ধকারেই নিয়ে নেবে। কোথা থেকে গানটা বাজে, স্বর্গ ইহা, নরক ইয়াহি, উসকে সিবা জানা কহা।
… উসকে সিবা জানা কহা (ছবি; অর্ণব বসু)
মনে পড়ে তার কথা। সে দেড় বছর আগে হাত ধরে বলেছিল, জানিস নীলকণ্ঠের খুব ব্যথা করে। তার বিষ কণ্ঠে হাত বোলাই। বলি চলে যেতে চাই না। ঝরনার কাছে পা ভিজিয়ে বসি। চলেই এসেছি। সংসার ফেলে নতুন ঘরে। আর বছরে ছেলেটি আমাতে লাল রং দেবে। লাল ফাগুনের হাওয়ার মধ্যে তার মুখ। বন্ধুটি কাঁধে হাত রাখে,
–তোর দোষ নেই, শান্ত হ।
শান্ত সবুজ ঝিঁঝিঁ আওয়াজ, মেঘ ঘিরে ফেলছে।
–নতুন ঘরে চল রে।
খুব জোরে বৃষ্টি নামল। শুনতে পাচ্ছি জটা থেকে জল নামছে সমতলে। নমঃগঙ্গে।
শান্ত সবুজ ঝিঁঝিঁ আওয়াজ, মেঘ ঘিরে ফেলছে (ছবি; অর্ণব বসু)
এগারো
ভাইয়া মোমবাত্তি চাহিয়ে।
হালকা আলোয় জানালায় মেঘ। ওইটুকুই। তারপর আর কেউ নেই, কিচ্ছু না। এটুকুই সীমানা। ভাত বেড়ে দিতে থাকে গুলি। আমি আর অর্ণব ডাল নেব বলে ভাত ভাঙি। লক্ষ্মীকে নিয়ে কাছে বসি। তার উষ্ণতার কাছে শীতল বাতাস বইছে। ওই দেখ শহরের আলো দূরে। সে হাসে।
–ফিরে যাবার আলো দেখতে ভালো লাগে না আজকাল…
বারো
পাহাড়ের পাশে কাঁটাতার। অর্ণব কাঁদছে। মা বাবা কিছু খায় না সন্তানকে ছেড়ে। আজ মা বলল, কোনওরকমে দুটো ভাত ফুটিয়েছে। তার চোখের জল থেকে সরে আসি। আমার তো বাড়িতে কারও অপেক্ষা নেই। চোখে জল নেই। শুকনো পাথরের উপর শুধু ঘুমিয়ে থাকা আছে। সে আমার হাত ধরে রাখে। উঠতে দেয় না। কাঁটাতারের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। এইটুকু ভাগবাটোয়ারা সেরে নিচ্ছি সবাই। এটুকু বর্ডারের নাম দেশ। মা ছেলের কান্না। এখনও বিস্মিত নই আমি। বুঝি চিরকাল পাথর কেন প্রিয় আমার।
পাহাড়ের পাশে কাঁটাতার (ছবি; ঈশানী বসাক)
তেরো
দার্জিলিং ওঠার পথে খুব শীত। অর্ণব চাদর নিতে বলেছিল। ওর কথা ভাবাই হয়ে ওঠে না আজকাল। কাঁধে মাথা রেখে সে সরলভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। দার্জিলিঙের ম্যালে তিনজন ঘুরছি। কত মানুষ, কত শীত। লাল একটা ছাতার কাছে সাদা কালো মেঘ। এই শীতে কাঁপতে কাঁপতে দেখি আকাশ জ্যাকেট বার করল। পরে নে এটা। আমি আর অর্ণব ওকে লক্ষ্মীর ঝাঁপি ডাকব ঠিক করেছি। ঠিক দরকারের সময় ওর ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে স্নেহ। গ্লেনারিজের গরম পর্কস্যান্ডউইচ। একটি সাদা সোয়েটার পরা এলোচুল মেয়ে। আকাশ তাকিয়ে তার দিকে। চোখে তার ঘন নীল রঙ। চশমার ফাঁকে জল।
–কাঁদছিস?
–নাহ্ রে কাল ফেরা। সব নিস্তব্ধতা, একা থাকা ফেলে রেখে ফেরা। বাড়িতে পা দিতেই কুকুরটা পায়ের কাছে এসে বসবে। পাখিরা ডাকবে, কিচকিচ। আমার সন্তানেরা পথ চেয়ে বসে…
চোদ্দো
ডাও হিল আসছে…
দিনের আলো থেকে অশরীরীরা দূরে থাকে। পুরনো অন্ধকার নিয়ে কিছু বলার নেই তাই প্রত্যেকটা গাছ লাগানোর আগে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো রেখে দিই যাতে কখনও গাছটা বড় হলে ওই কাগজটায় নিজের কথা লিখতে পারে। আমার দেওয়ার মতো কিছু নেই বলে একটা জেলখানার অন্ধ কুঠুরির মধ্যে বসে থাকা অপরাধীর মতো জামাকাপড় হাতড়াচ্ছি। সেখানে কী একটা ছোট অরণ্য নেই যা আমি দিতে পারি তোমাকে? এই যে রাস্তাটা ঘুরে যাচ্ছে মেঘ নিয়ে ঠিক এইখানে তুমি বলছিলে হাঁটতে আসো রোজ আমাকে নিয়ে। আর এই যে এই ভাগ হয়ে যাওয়া রাস্তাটা সেটা দেখে তুমি বলে উঠলে রবার্ট ফ্রস্টের ‘দ্য রোড নট টেকন’ কবিতাটা। তুমি এই বাঁকের কাছে আসলে জানলা হয়ে যাও। এর থেকে বেশি এগোতে পারো না কারণ তুমি এই পাহাড়ি সংসারটার সদস্য নও। তাই হুড়হুড় করে আমি উঠে যাই ওই ডেথরোড দিয়ে। এই রাস্তায় ফোন নট রিচেবল। তুমি নীচ থেকে দেখে নিলে একবার। এই ছবিটুকু দেওয়া ছাড়া কোনও ক্ষমতাই ছিল না আমার। তাই তোমার অসহায় মিশে যাওয়াগুলো বাগানের মধ্যে ছড়াচ্ছে। অথচ সেসব ফল আমি এসে নিতেও পারছি না। কেন না গাছ ছুঁতে গেলে ভালোবাসা দিতে হয়। কিন্তু মেঘ আর ওই ডেথরোড ছেড়ে কী করে আসব আমি? তাই তোমাকে রোজ নিজের মনমতো একটা করে আমিকে দেখতে হয়। ঠিক এই পাইনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি আসলে আমি ভয় পাচ্ছি না। কে যেন আঙুল দিয়ে বলছে এই চুপ করে যাওয়া, একা মিলিয়ে যাওয়া একে মৃত্যু বলে। তবু জন্মের পর থেকে কিছুতেই এই একলা হারানোটা মানতে পারলাম না বলেই আমরা মূর্খ তবে সামাজিক নয়। সে জন্য এখান থেকে পালাতে চাইছি না। চলে যেতে হলে কখনও মুখ ফেরাতে নেই।
ডাও হিল আসছে (ছবি; ঈশানী বসাক)
পনেরো
কার্শিয়াং স্টেশনে নেমে যাচ্ছি। ওরা চলে যাচ্ছে। আকাশ অর্ণবকে বলে নেমে দাঁড়াতে। কাছে টানার জন্য সে পাশে দাঁড়ায়।
অভিমানে বলে ওঠে— তোর থেকে যাবার তাড়া।
–তাড়াতাড়ি ফিরিস।
আকাশ অর্ণবকে বলে লাগেজ নামাতে। গুলি তুই কাঁদছিলি জানি, সমস্ত পাহাড় ছেড়ে চলে যাবার কান্না।
ষোলো
কদিন কার্শিয়াংয়ে থাকলাম। কিন্তু সেই ফিরে আসার ডাক। কিছু না লেখা থাক। নামার সময়ে সব সা রে গা মা পা ছেড়ে দু হাত মেললাম চা বাগানে। তোমার কাছে দু দণ্ড বসে সমস্ত অশান্তি রেখে গেলাম। রাতের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। ঘুম চোখে বারান্দার মেঘকে বলি, যাইইইইইইইই।
তোমার কাছে দু দণ্ড বসে সমস্ত অশান্তি রেখে গেলাম (ছবি; অর্ণব বসু)