Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দহনদিনের দোয়েল অথবা এক প্রেতকাহিনী

শতাব্দী দাশ

 

প্রথাগত ছবির রিভিউ লিখতে হয়ত নারাজ হতাম৷ সুবিধে হল, ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’-এর মাসিক মেল ট্রেনে ফিল্ম রিভিউ বিভাগ নেই আপাতত। অতএব স্রেফ গদ্য হিসেবেও লেখা চলে। রিভিউ না লেখার কারণ বিবিধ। প্রথমত, ফিল্ম রিভিউ আমার ক্ষেত্র নয়। দ্বিতীয়ত, এরকম একটি ছবি, যার বহুরকম পাঠ সম্ভব, একবার মাত্র দেখে তার রিভিউ লেখা প্রায় অসম্ভব ঠেকে। তৃতীয়ত, (এই কারণটির সূত্র দ্বিতীয় কারণের মধ্যেই নিহিত) এ আমারই ব্যর্থতা যে ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ একবার দেখে, চিত্রনাট্য, সংলাপ, ক্যামেরা, অভিনয়, সঙ্গীত, সম্পাদনা, পরিচালনা ইত্যাদি কম্পোনেন্টে ছবিটিকে নির্মোহভাবে চটজলদি ভেঙে নিয়ে, আতসকাঁচের তলায় ফেলতে পারিনি। পারতাম হয়ত, যদি শেষ আধঘণ্টা বিহ্বল না করত। ছবিটিকে ঘিরে যা কিছু বোঝাপড়া, তা সাবজেক্টিভ। জীবনানন্দ যে ব্যক্তিগত ‘বোধ’-এর কথা বলেছিলেন, তেমন। ‘স্বপ্ন নয়— শান্তি নয়— ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়।’

তবে কিনা ব্যক্তিগত বোধের কথা লিখতে গেলেও নিজেকে খুঁড়তে হয়৷ হাতড়ে দেখতে হয়, কেন ভূতগ্রস্ত হলাম। আক্ষরিক অর্থেও ‘ভূতগ্রস্ত’ বলা যায়। মনে পড়ল, ‘বুকমাইশো’-তে রিভিউ সেকশনে বেজায় ক্ষেপে কেউ একজন লিখেছিলেন– ‘Is it a ghost story or what?’

ভূতেরা সচেতনের গণ্ডি ছাড়িয়ে অবচেতনে কোথাও তাড়া করছিল বলেই নির্মোহ হওয়া গেল না৷ সংলাপ-নির্মাণে ছিল কিছু মেদ। ডাবিং-এ ছিল কিছু অসঙ্গতি৷ এসব নিয়ে যে মাথা ঘামালাম না, তা ছবিটির হল পাওয়া নিয়ে দীর্ঘ সমস্যা তৈরি হল বলে নয়। পাঁচদিনের মাথায় উঠে গেল বলেও নয়। এইসব কারণে সচেতনভাবে ঝান্ডা উড়িয়ে ছবিটিকে ‘সমর্থন’ করতে হয়, অ্যাজেন্ডা হিসেবে। তেমন করিনি এক্ষেত্রে। আবার নিখুঁত ছবি-টবি মুগ্ধ প্রশংসা দাবি করলেও, ‘তাড়া’ নাও করতে পারে। এক্ষেত্রে তাড়া করছিল বিষয়, আর বিষয়কে এই আঙ্গিকে ফেলা হল বলেই তাড়া করছিল বেশি৷

আঙ্গিক নিয়ে এ ছবি অতিসচেতন হয়নি, বরং এলোমেলো আগোছালো থেকেছে। ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ বা তারা চ্যানেলে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের টেলিছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন প্রদীপ্ত নিজের মতো করে এক সিনেভাষা গড়ে নিয়েছেন৷ একেবারে তাঁর সিগ্নেচার ল্যাঙ্গুয়েজ৷ এখানে সময় আগুপিছু চলাচল করে। বাস্তব মিশে যায় যাদুবাস্তবের সঙ্গে। তাই শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত আর রাজলক্ষ্মীকে দেখার জন্য প্রদীপ্তর ছবি দেখতে যাওয়া প্রায় বাতুলতা৷ নিজস্ব ভাষায় তিনি শরৎচন্দ্র কীভাবে অনুবাদ করেন, সেইটেই ছিল দেখার।

যখন শোনা গেছিল ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-র আধুনিকায়ন হয়েছে, তখন কর্পোরেট-কলে আটকা পড়ে যাওয়া এক নাগরিক শ্রীকান্তকে আশা করাই গেছিল, যে শ্রীকান্ত দুইখানি পা পেয়েছে যাযাবরের, তাই চাকরিকে হেলায় ফেলে পাড়ি দিতে পারে অনির্দিষ্টের দিকে। তাই তার আইকার্ড ছুঁড়ে ফেলা-টেলা আশ্চর্যের না, বরং প্রেডিক্টেবল। আশা করাই গেছিল যে রাজলক্ষ্মী একালে দামি এসকর্ট৷ যৌনতার আগে প্রয়োজন মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত বা আখতারিবাঈ শুনিয়ে হাইপ্রোফাইল কাস্টমারদের সন্তুষ্ট করে। এসবও চমকপ্রদ নয়। বরং ক্লিশে৷

ছবিটি নিয়ে প্রথম খটকা লাগে, ছবিটি শ্রীকান্তর ‘Bildungsroman’ হয়ে ওঠে না বলে৷ বিলডাংসরোমান মানে, যে কাহিনীতে থাকে মূলচরিত্রের শৈশব থেকে বড়বেলা পর্যন্ত অভিজ্ঞতার নির্যাস, এমনকি তার বৌদ্ধিক, দার্শনিক বিকাশের ধারাও বর্ণিত হতে পারে। পুরুষের বিলডাংসরোমান অজস্র আছে সাহিত্য-সিনেমার পরিসরে, পৃথিবী জুড়ে। যেহেতু এই ছবি শ্রীকান্তর বিল্ডাংসরোমান হয়ে ওঠে না, তাই তার ভবঘুরেপনাও ছবির পরিধিতেই থাকে, কেন্দ্রে আসে না৷ সে কি অভাব বা অপ্রাপ্তি? কিন্তু এই ‘না হওয়ার’ কারণ যদি খুঁজি, তাহলে শ্রীকান্তর রাজলক্ষ্মীর ‘পার্সোনাল’ হয়ে যাওয়াতে পৌঁছই। ছোটবেলায় ‘শ্রীকান্ত’ পড়ে অনেকেই শ্রীকান্ত হতে চেয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, নানারকম সমাজনির্মাণ আমাদের থেকে রাজলক্ষ্মীর ভূমিকা প্রত্যাশা করে। শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মী-অভয়া-কমললতায় অনায়াস চলাচল করে, যদিও রাজলক্ষ্মী তার ফেরার ঠিকানা৷ একশ বছর আগে লেখা আখ্যানেও রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তর ‘ফোকাস’ নয়৷ হলে, তার ভবঘুরে হওয়া হত না৷ প্রদীপ্তর ছবি শ্রীকান্তর বিল্ডাংসরোমান হওয়ার বদলে দুটি সমান্তরাল হেটেরোসেক্সুয়াল প্রেমের গল্প বলে । এইখানে ‘প্রেমের গল্প’ কথাটিও গোলমেলে। প্রেমের আখ্যানগুলিকে সযত্নে নির্মাণ করা  হয়, যাতে তারা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার কালে অভিঘাত তীব্রতর হয়। সে কথায় আসছি পরে। মোদ্দা কথা, এ গল্প নায়কের বিল্ডাংসরোমান না হয়ে রাজলক্ষ্মী আর অন্নদাদিদিরও গল্প হয়ে ওঠে। এখানে দেহপসারিনী রাজলক্ষ্মী খোলা ছাদে প্লেন দেখে বালিকা হয়ে যায়, বাংলাদেশি ডায়লেক্টে ফেরে, বাংলাদেশের জলমাটিতে ফিরতে চায়। ঋত্বিক ঘটকের অনসূয়ার কথা মনে এসেই মিলিয়ে যায়। অন্নদাদিদির বাপের বাড়ির ঠিকানা আমরা জানি না৷ কিন্তু তার কথাতেও বাংলাদেশি টান শুনি৷ তাদের ছিন্নমূল সত্তা আর নারীসত্তা মিলেমিশে যায়। নারীমাত্রই একজীবনে বহুবার ছিন্নমূল।

জ্যোতিকা জ্যোতির চরিত্রচিত্রণ নিয়ে কথা হচ্ছে প্রচুর। অন্য তিনজন মূল অভিনেতার তুলনায় অবশ্যই অভিব্যক্তিতে ঘাটতি আছে তাঁর, কিন্তু সঙ্গত করার চেষ্টা করেছেন। যা সমালোচনা হচ্ছে, তার অধিকাংশই কিন্তু ভাষায় বাংলাদেশি টান নিয়ে। ছোট রাজলক্ষ্মীর আগমনের মুহুর্তে আমরা জেনেছিলাম, ওরা বেড়া ডিঙিয়ে এসেছে৷ বাংলাদেশের মেয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসে, তারপর পাচার হয়ে যায়। কলকাতা, লখনৌ এবং আরও নানা শহরে সে ঘুরেছে বলে জানায়। শহুরে অ্যাক্সেন্টে বাংলাদেশি টান কানে লাগলেও মেনে না নেওয়ার কারণ থাকে না৷ এই রাজলক্ষ্মী বাঈজি নয়, প্রস কোয়ার্টারে পাচার হয়ে যাওয়া বেশ্যা। গান শেখা তার খেয়াল, রোজগার বাড়ানোর উপায়ও বটে৷ ‘সাওরে আইযাইও’ বা ‘জোছনা করেছে আড়ি’ আধুনিক বেশ্যার গলায় কীভাবে মানানসই, কেনই বা সে বাঈজি-পোশাকে, সেসব খুঁটিনাটি প্রশ্নের উৎস হল রিয়ালিজম নিয়ে অহেতুক মাথাব্যথা। আমার কাছে, ছবির আঙ্গিকের কথা মাথায় রাখলে, এইভাবে ‘রিয়াল’-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টাটি শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত: প্রথম পর্ব’-এর সঙ্গে ছবিকে মেলানোর চেষ্টার মতোই অবান্তর প্রচেষ্টা। ড্রোন ক্যামেরায় এরিয়াল ভিউতে শ্রীকান্ত হুকুমচাঁদের ডেরায় যখন প্রবেশ করছে আস্তে আস্তে, তখন ‘সাওরে আইযাইয়ো’ যথার্থ আবেশ সৃষ্টি করে এবং সেটুকুই কাঙখিত ৷ পোড়-খাওয়া বেশ্যার হয়ে উঠতে হলে অবশ্যই জ্যোতিকার আরও সূক্ষ্ম হওয়ার কথা ছিল অভিব্যক্তিতে৷ কিন্তু নিশ্চিন্দিপুরের সমুদ্রতটে বা বাড়ির ছাদে পুনর্বার বালিকা হয়ে ওঠা জ্যোতিকাকে বেশি সাবলীল লাগে।

শরৎচন্দ্রের অন্নদাদিদির চরিত্রটি ছিল দৃঢ় কিন্তু অত্যাচারিত এক নারীর৷ সেই দৃঢ়তার আরেক নাম ‘স্টোয়িসিজম’। দৃঢ় অন্নদাদিদি দৃঢ়তার সঙ্গে অত্যাচার গা-সওয়া করে নিয়েছিল। সাপে-কাটা শাহজির লাশ কোলে তাকে শেষবার দেখা গেছিল, যে শাহজির ছলে ভুলে সে কুলত্যাগিনী হয়েছিল। স্বামীকে সে শত নির্যাতনের পরেও ছেড়ে যেতে পারেনি৷ প্রদীপ্তর অন্নদাদিদি কুলত্যাগিনী হয় দ্বিতীয়বারের জন্য। এই অন্নদাদিদি শাহজি খুন হওয়ার পর  নির্বিকারভবে শাঁখা-পলা ভাসিয়ে দ্যায়। আঁজলায় জল তুলে মুছে দ্যায় নিজের সিঁদুর। তারপর করুণ,ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় নৌকায়৷ অন্নদাদিদি আর ইন্দ্রর যৌনতা দর্শকের কাছে আসে শব্দে, খিলখিল হাসিতে, শীৎকারে। আর জানলার ফাঁকে শ্রীকান্তর চোখই ক্যামেরা হয়ে ওঠে। আলো-ছায়ায় সে যৌনতা আমরা স্পষ্ট দেখি না, তার ইম্প্রেশন পাই মাত্র। আমার ‘আড়াল’ বা ‘দ্বিধা’ মনে হয় না৷ প্রদীপ্তর ঘরানাই যেখানে অনুরাগ কশ্যপ বা দিবাকর ব্যানার্জির ঘরানা নয়, সেখানে যৌনতাকে তিনি পুঙখানুপুঙ্খ দেখাবেন কেন? অপরাজিতা নিজেকে ভেঙে এক অদ্ভুত অভিনয় বের করে আনেন৷  কথার টানে বা বসার কায়দাটিতেও গ্রাম্যতা। অন্নদাদিদি পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক যাতনা থেকে সাময়িক মুক্তি পায়। কিন্তু বারজগতে আরও সংঘবদ্ধ, সিস্টেমেটিক পিতৃতান্ত্রিক নৃশংসতা তার জন্য অপেক্ষা করে।

উপন্যাসে শাহজির সাপে-কাটা আকস্মিক মৃত্যু আর এ ছবিতে তার ঘটনাচক্রে খুন হয়ে যাওয়ার মধ্যে বহুযোজন দূরত্ব৷ শাহজির খুনের অ্যান্টি-ড্রামাটিক ট্রিটমেন্ট মুহুর্তের জন্য সাফোকেট করে। একটা ভোঁতা শব্দ, কিছু চাপ চাপ রক্ত, মাছিদের ঘোরাফেরা- এটুকুই বৈ তো নয়। ভায়োলেন্সকে আমরা প্রথমবার দেখি ছবিতে৷ ভায়োলেন্সকে দেখি সমকালের স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবে।

কৈশোরের শ্রীকান্ত(সোহম) ইন্দ্রর ছায়াসঙ্গী। ইন্দ্র চলে গেলে রাজলক্ষ্মীর আগমন হয়। এক কর্তৃত্বকামী,সেক্সিস্ট কিন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীন শ্রীকান্তকে আমরা দেখি। তার প্রান্তিকতার প্রতিশোধ সে নেয় কিশোরী রাজলক্ষ্মীর(গার্গী) উপর কর্তৃত্ব ফলিয়ে তাকে দিয়ে ভারি বস্তা বওয়ানো প্রায় স্যাডিজম ছুঁয়ে যায়। রাজলক্ষ্মীকে শ্রীকান্ত নিজের সম্পত্তি, খিদমতগার ভেবে নেয়, দেবদাস প্রভৃতি শরৎচন্দ্রের কিশোর নায়করা যেমন প্রায়শই করে। বড় শ্রীকান্ত চাকরির মায়া ত্যাগ করে হুকুমচাঁদের নিমন্ত্রণে জঙ্গলে যায়। এই বোহেমিয়ানিজমের রোমাঞ্চও সাংস্কৃতিকভাবে এক পুরুষসুলভ রোমাঞ্চ।  একডাকে হুকুমের বিলাসব্যসনের আখড়ায় হাজির হলেও এই শ্রীকান্তর কিন্তু শিকার আর আর ভাল লাগে না, বাঈজিতে মন ওঠে না। কীভাবে এইসব পরিবর্তন আসে, তা আমরা চলচ্চিত্রের পরিসরে দেখতে পাই না। আমরা দেখতে পাইনা কবে সে ‘মর্দ ডরতা নহি হ্যায়’-র মতো ছেঁদো কথা শুনে ‘ধুর বাল’ বলতে শিখল। কিন্তু আইফোন, বাড়ি-গাড়ির প্রস্তাবে না বললেও রাজলক্ষ্মীকে একরাতের জন্য পাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বাজি রেখে নিশুত জঙ্গলে সে যায় যখন, সেখানেও তার পৌরুষই তাকে চালিত করে৷ আবার সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন, নন-কমিটেড পৌরুষই রাজলক্ষ্মী দ্বিতীয়বার পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে অরাজি হয়৷ কিন্তু  তারা পালাতে বাধ্য হয়, ঘটনাচক্রে। এইসব ওঠাপড়া ঋত্বিক ফুটিয়ে তোলেন শরীরভাষা দিয়ে, হাঁটাচলা, হাসি, মুখভঙ্গি দিয়ে। কারণ ডায়লগ এ ছবির ফোর্টে নয়। নিজের কবরের দিকে চেয়ে বসে থাকা ধ্বস্ত, রক্তাক্ত, খড়ি-ওঠা ঠোঁটের শ্রীকান্ত তার হেরে যাওয়া দ্যাখে স্বচক্ষে৷

হুকুমচাঁদের খলনায়ক হিসেবে একমাত্রিক হওয়ারই কথা ছিল। এমন কোনও সিচুয়েশন বা ডায়লগ রাহুল স্বাভাবিক কারণেই পান না, যাতে তিনি অন্য কিছু হয়ে উঠতে পারেন৷ পৌরুষের ছায়ায় ঘাপটি মেরে থাকা দুর্বলতা, ইন্সিকিওরিটিগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য রাহুলের হাতে ছিল নেশার ঘোরে বলা অসংলগ্ন প্রলাপ আর শেষ দৃশ্যের কিছু মুখমণ্ডলীয় অভিব্যক্তি। দক্ষতার সঙ্গে রাহুল তা ব্যবহার করেন।

এ গল্প ইন্দ্রনাথেরও গল্প, কিন্তু শরৎচন্দ্রীয় কায়দায় নয়। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্রথম পর্বে অবশ্যই আছে ইন্দ্রর কর্তৃত্ব৷ অসমসাহসী ইন্দ্র, যে কৈশোরেই হারিয়ে গেছিল শ্রীকান্তর জীবন থেকে৷ কিন্তু যতক্ষণ সে থাকে, ততক্ষণ সব ‘এজেন্সি’ তারই৷ ছায়াছবির শ্রীকান্ত বয়সে কিছু বড়। অন্নদাদিদির সঙ্গে তার প্রণয়। এ কাহিনীতে সে অকুতোভয় যুবক মাত্র নয়, তার ভ্রান্তি আছে, ঠকে যাওয়া আছে, কান্না আছে, নিষ্ফল রাগ আছে। শরৎ-উপন্যাসে অন্নদাদিদি শাহজির মৃত্যুর পর হারিয়ে যায়। একখানি চিঠি লিখে যায়। সেও ইন্দ্রকে নয়, শ্রীকান্তকে। এ’ ছবিতে, ইন্দ্র আর অন্নদাদিদি একসঙ্গে পালায়৷ ‘এক মরণে দুজন মরে’। শ্রীকান্তর জীবননায়ক ইন্দ্রকে আমরা পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় দেখি, পরিত্যক্ত জমিতে তাকে সরিসৃপের মতো বুকে ভর দিয়ে অসহায় দেখি। সেই দৃশ্যে সায়নের অভিনয় ভোলার নয়। সায়ন এ ছবির সবচেয়ে বড় আবিষ্কার৷

ছোট ছোট চরিত্ররা দাগ কেটে যান, যেমন রাজলক্ষ্মীর ম্যানেজারের চরিত্রে অমিত। কিংবা মদ্যপ পুরোহিতের চরিত্রটি। তাঁবেদারি, ভ্রষ্টাচার ও বিকৃতির সঙ্গে প্রথাগত ধর্মব্যবসাকে মেলাতে প্রদীপ্ত কয়েকটি মাত্র আঁচড়ে চরিত্রটি আঁকেন৷ ছোট চরিত্রের ক্ষেত্রে কাস্টিং বিশ্বাসযোগ্য, রাজলক্ষ্মীর অতীতের স্বামী, শ্রীকান্তের গাড়ির চালক, অন্নদাদিদির স্বামী…সকলেরই ক্ষেত্রেই প্রায়। চরিত্রদের মেক-আপ মিনিমালিস্টিক,টোন ডাউন করা।

শুভদীপ দে-র ক্যামেরার ব্যবহার প্রশংসনীয়। ড্রোন ক্যামেরাকে ব্যবহার করা হয় মৌসুনি দ্বীপ আর পুরুলিয়ার  ল্যান্ডস্কেপকে ধরতে, অথচ ঝাঁ চকচকে ফিনিশিং নেই, ফিল্টার নেই। আবার ক্লোজ আপে ক্যামেরার লেন্স অভিনেতার মুখের রুক্ষ্মতা পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলে৷ সমুদ্রের ধারে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার ঝাঁকুনির মধ্যে কিশোর ছুটে চলে।

সিনেমাটি এক মিউজিকাল সফরও।

গানগুলিতে কিন্তু রিভার্ব নেই, সাউন্ড কারেকশন নেই। সাত্যকি ব্যানার্জির আবহসংগীতে বাঁশির কান্না কখনও, কখনও উড-এর সুর৷ গানগুলো রিফ্রেইনের মতো বারবার ফিরে আসে। সে ‘এমন প্রেম নদীতে সই গো…’ হোক বা  ‘আমার এটুক শুধু চাওয়া…’। খালি গলায় দ্বিজেন্দ্রগীতি, ‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই…’ যখন বাজে, তখনই আমাদের মায়ামাখা চরিত্ররা বাস্তব থেকে মুক্ত হয়।

প্রেম ও রাজনীতি নিয়ে দু-এক কথা বলা দরকার। ছবিটি কি প্রেমের? না এবং হ্যাঁ৷ প্রেম আর রোম্যান্টিকতার টুঁটি কামড়ে ধরার জন্য অপেক্ষা করে  তিক্ততা, ক্রূরতা, ভায়োলেন্স৷ ভায়োলেন্স শেষ আধঘণ্টার চালিকাশক্তি৷ ভায়োলেন্স গোঙানিতে, আর্তনাদে, ছেঁড়া ব্লাউজে, প্যান্টের চেইন টানায়, কবরে মাটি পড়ার শব্দে৷ শেষ আধঘণ্টা সোচ্চারে বলে, প্রেম, নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের কথা বলার জন্য এই ছবি তৈরি হয়নি। এই আধঘণ্টায় ছবিটি মুহুর্মুহু ট্রিগার ঘটায়। এই আধঘণ্টায় ছবিটি স্পষ্টত রাজনৈতিক। এই আধঘণ্টাতেই সমকালে চরিত্রগুলোর সংস্থাপন সম্পূর্ণ হয়৷ পরিচালক ইতিহাসবিচ্ছিন্ন হতে দ্যান না ন্যারেটিভকে। উনবিংশ শতকে লেখা একটি উপন্যাসের পক্ষে গণধোলাই আর গণধর্ষণের নৃশংসতা দেখার দূরদৃষ্টি থাকা সম্ভব ছিল না। আমরা  সকালে রাজগীরের গণধর্ষণের ভাইরাল ভিডিও দেখি। আমরা আসরাফুলের মৃত্যু দেখি। আমরা কাঠুয়া, উন্নাও দেখি৷ এই আমাদের সমকাল। এখানে প্রেম ঘর পাবে, পরিণতি পাবে এমন কি সম্ভব হত? আমরা এনআরসিও দেখি, আরও অনেক কিছু দেখার জন্য প্রহর গুনি। আমরা দেখি রাষ্ট্র যৌথযাপন ভেঙে দেয়৷ রাজলক্ষ্মীর বেড়া ডিঙিয়ে আসার ইতিহাস আমাদের হন্ট করে, তাড়া করে অন্নদাদিদির ফেলে আসা ওপারের অতীত। নাগরিকপঞ্জি থেকে তারা বাদ পড়বে কি? বেশ্যাপাড়ায় কত জায়গা থেকেই তো পাচার-হওয়া-মেয়েরা আসেন, তাঁরা থাকবেন নাগরিক-পঞ্জিতে? মৈনাক বিশ্বাস ‘নিও-ভদ্রলোক দর্পণ’-এ আধুনিক বাংলা সিনেমার রাজনীতি থেকে বিচ্ছেদের ও বিচ্যুত হওয়ার কথা বলেছিলেন। এই ছবি উচ্চকিত ভাবে না হলেও, ছবিকে সেমিনার বানিয়ে না তুলেও, রাজনৈতিক হয়ে উঠল।

ছবিটি ট্রিটমেন্টেও অ্যান্টি-রোম্যান্টিক৷ তবু কেন চন্ডীদাস আর রজকীনীর কথা ফিরে ফিরে আসে? কেন ওই গানগুলো? কেন ট্রেলার শুরু হয়েছিল দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মধ্যে  ‘এমন প্রেমের নদীতে সই গো ডুব দিলাম না…’ দিয়ে? ছবিও কেন শুরু হল সেভাবেই? কেন ইন্দ্র বলে, ‘কাউকে ভালোবাসলে না, মনটা তুলতুলে হয়ে যায়…’? আমি মানি এ ছবি অ্যান্টি-রোম্যান্টিক৷ কিন্তু এক  বিমূর্ত প্রেমের ধারণা তাকে জড়িয়ে থাকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। সেই প্রেম বাস্তবের মাটি পায়না৷ মৃত্যুদৃশ্যের ঠিক পরেই ড্রোন ক্যামেরা আবার ধরে পুরুলিয়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে,নিশ্চিন্দিপুরগামী হওয়া গাড়িখানিকে। রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত-ইন্দ্র-অন্নদারা পরাবাস্তবে পাড়ি দেয়।

‘ইজ ইট আ ঘোস্ট স্টোরি অর হোয়াট?’ লিখেছিলেন বুকমাইশোতে কেউ। প্রেতকাহিনীই বটে। নিশির ডাক ফিরে আসে দু’বার। শ্রীকান্তর ছোটবেলায় আর  বড়বেলায়। মোহগ্রস্ত শ্রীকান্ত তার পিছু নেয়। অমোঘ ভবিতব্যের দিকে ধেয়ে যাওয়া এড়াতে পারে না শ্রীকান্ত ও তার সহচরিত্ররা। শ্মশানে চড়চড় করে যে বৃক্ষপতনের শব্দ, সে শব্দের সঙ্গে প্রেম, কমনীয়তা, সৌন্দর্য আর একান্ত  ‘তুলতুলে’ যা কিছু, তারাও ভেঙে পড়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত যে প্রেতসকল স্ক্রিন দখল করে, তারা এক রকম ইউটোপিয় পরিপূর্ণতার দ্যোতক হয়ে ওঠে। তাদের প্রেম পূর্ণতা পায়। প্রেম পূর্ণতা পায়, কারণ ইউটোপিয়া এবং ইউটোপিয়ান প্রেতগণ শুধু রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা থেকে মুক্তি পায়নি, এমনকি জীবৎকালের চারিত্রিক খামতিগুলো থেকেও মুক্তি পেয়েছে। প্রেমিকরা তাদের ভঙ্গুর পৌরুষ থেকে মুক্ত হয়। প্রেমিকারা মুক্ত হয় ধর্ষণ ও নির্যাতন যন্ত্রণা থেকে৷ প্রেমের ধারণা ও ধারণার প্রেম পিতৃতন্ত্র, ক্ষমতাতন্ত্র, ধনতন্ত্রের বাস্তবতা থেকে ছাড়া পায়। বিদেহী আত্মার মতো মুক্ত হয়ে যায়৷ সাগরতীরে আপনমনে ঝিনুক কুড়ায়। ‘হাওয়ার মতন, ঢেউয়ের মতন, নেশার মতন’ ভেসে যায়। একটি একান্ত দোয়েল আছে অতএব ছবিটির, যদিও সে দগ্ধদেশে ধ্বংসস্তূপের দোয়েল।