লিখন অনিরুদ্ধ
ভিন্নমত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন একের পর এক বিতর্ক চলছে তখন ব্যক্তিগত মতপ্রকাশ ও ছাত্রশিবির কর্মী সন্দেহে সরকার-দলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলিগের হাতে খুন হয়েছে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ। এই যখন অবস্থা, তখন শুরু করছি কবীর সুমনের একটি গানের কথা দিয়ে–
বিরোধীকে বলতে দাও…
তোমার ভুলের ফর্দ দিক
বিরোধীকে বাঁচতে দাও…
বিরোধীর দৃষ্টি দিয়েও সবাই নিজের হিসেব নিক।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার ফাহাদ। আবরার থাকতেন শের-এ-বাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। ৬ই অক্টোবর রবিবার রাত আটটার দিকে তাঁকে একই হলের ২০১১ নাম্বার কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কক্ষে আবরারকে নির্যাতন করে বুয়েট ছাত্রলিগের নেতা-কর্মীরা। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে একতলা ও দোতলার মাঝামাঝি সিঁড়িতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ এসময় ছাত্রদের আবাসিক হলে প্রবেশের চেষ্টা করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলিগের বাধার মুখে পড়ে। ডাক্তার এসে আবরার ফাহাদকে মৃত ঘোষণা করলে হল প্রশাসনের উপস্থিতিতে পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য আবরার ফাহাদের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যায়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ফাহাদকে শক্ত কিছু দিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা বুয়েট ক্যাম্পাস। আবরার হত্যাকাণ্ডের ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না আসায় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে। এদিকে সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করার পর বেরিয়ে আসতে থাকে আবরার হত্যার নেপথ্যে কারা ছিল। সোমবার সকালে আবরার ফাহাদের বাবা বরকতুল্লাহ বাদী হয়ে ঢাকার চকবাজার থানায় ১৯ জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লিগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় পার্টি। এদের ছাত্রসংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলিগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামি ছাত্রশিবির, ছাত্র সমাজ। এছাড়াও বাংলাদেশে বামপন্থী ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রমৈত্রী অগ্রগণ্য। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলিগের সঙ্গে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের দীর্ঘ সঙ্ঘাতের ইতিহাস রয়েছে। বিএনপি ও জামাত-এ-ইসলামি জোট ক্ষমতায় থাকলে যেমন ছাত্রলিগের ওপর চড়াও হয় ঠিক তেমনি আওয়ামী লিগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের প্রতি মারমুখী আচরণ করে থাকে। যদিও বর্তমানে দেশের কোনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সহাবস্থান নেই এবং যে দল ক্ষমতায় থাকে তারাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
৫ই অক্টোবর শনিবার বিকেল ৫.৩২ মিনিটে আবরার ফাহাদ ফেসবুকে তাঁর শেষ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসটিতে তিনি, ফেনী নদীর পানি বণ্টন, গ্যাস রপ্তানি ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির সমালোচনা করেন। তবে কি বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই? পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসতে থাকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুরুতেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় বুয়েট শাখা ছাত্রলিগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদকে। পরবর্তীতে ভিডিও ফুটেজ দেখে খুনের সঙ্গে জড়িত বাকি অভিযুক্তদের শনাক্ত করা হয়। আবরার ফাহাদ হত্যার তদন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার কাছ হস্তান্তর করা হয়েছে। ৮ই অক্টোবর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা গ্রেপ্তারকৃত ১০ জন আসামীকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন মেজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। বিচারক শুনানি শেষে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। রিমান্ড মঞ্জুর করা আসামীরা হলেন বুয়েট ছাত্রলিগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, দ্বিতীয় বর্ষ), সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, দ্বিতীয় বর্ষ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, তৃতীয় বর্ষ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ), মো. মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ (ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, তৃতীয় বর্ষ) এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির ও একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না। এদিকে আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা রাস্তায় বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করে।
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মঙ্গলবার বুয়েটের আরও তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরা হলেন- মনিরুজ্জামান মনির (২১), মো. আকাশ হোসেন (২১) ও শামসুল আরেফিন রাফাত (২১)। মনির বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ষোড়শ ব্যাচের তৃতীয় বর্ষে, আকাশ একই ব্যাচের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষে এবং রাফাত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সপ্তদশ ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আবরার হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার আদালতে দেওয়া এক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন বুয়েট শাখা ছাত্রলিগের সমাজসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল। তাঁর কক্ষেই ৬ অক্টোবর রাতে শিবিরকর্মী সন্দেহে পেটানো হয় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন ইফতি। ইফতি বলেন, বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ক্রিকেটের স্টাম্প আর প্লাস্টিকের মোটা দড়ি (স্কিপিং রোপ) দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন ছাত্রলিগের নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি। তাঁকে মাটি থেকে তুলে আবারও পেটাতে থাকেন তাঁরা। ঘণ্টা কয়েক পর বমি করতে শুরু করেন আবরার। তিনবার বমি করার পর নিস্তেজ হয়ে যান। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ইফতিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। আবরার ফাহাদের বিরুদ্ধে ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্টতার সুস্পষ্ট প্রমাণ তারা কেউ দেখাতে পারেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ সংগঠন নয় এবং যদি আবরার ফাহাদ শিবিরকর্মীও হতেন তাহলে কি তাকে খুন করার লাইসেন্স দেয়া যায়?
জিজ্ঞাসাবাদে ইফতি আরও বলেছেন, ৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলিগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শের এ বাংলা হল ছাত্রলিগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, আবরার শিবির করে, তাঁকে ধরতে হবে। এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়া দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলিগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় তিনি ইফতিকে বলেন, ‘ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।’ এদিকে আবরার হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামী হিসেবে শুক্রবার আদালতে জবানবন্দি দিলেন মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন।
শিক্ষার্থীরা আবরার হত্যার ঘটনায় খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি, বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা সহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে। বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা আলটিমেটাম দিয়েছিলেন, উপাচার্য যদি শুক্রবার বেলা ২টার মধ্যে তাঁদের সঙ্গে দেখা না করেন, তাহলে বুয়েটের সব ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেবেন। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার বিকেলে বুয়েট অডিটোরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম আলোচনায় বসেন। সেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস প্রদান করেন। যদিও বৈঠক শেষে রাত পৌনে ১১টার দিকে বুয়েট শহিদ মিনারের পাদদেশে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন।
স্বাধীনতার পর প্রায় প্রত্যেক সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র খুনের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আবাসিক হলগুলোকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করেছে। যে দলই রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে তারাই তাদের ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলছে। টেলিভিশন টকশোতে কার আমলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে কয়টি খুন হয়েছে তার ফিরিস্তি নিয়ে আলোচনার টেবিল গরম করছে সরকার ও বিরোধীপক্ষ। আমরা কেউ জানি না আর কত রক্ত ঝড়লে রাজনীতিবিদদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে! তাই তো নানামহল থেকে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জোর আওয়াজ উঠছে! আবরার ফাহাদ তাঁর ফেসবুক বায়োতে লিখেছেন, অনন্ত মহাকালে মোর যাত্রা অসীম মহাকাশের অন্তে! আবরার নেই, তবু বিচারহীন এই ত্রাসের দেশ লজ্জাহীন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।