Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একটি হত্যা চক্রান্ত: প্রসঙ্গ বিএসএনএল

সুজন ভট্টাচার্য

 

ভারতের টেলিফোনির বাজারে বর্তমানের তিন প্রধান খেলোয়াড় জিও, এয়ারটেল আর ভোডাফোন। বর্তমানে বাজারের সিংহভাগ এই তিন কোম্পানির দখলে। আবার জিও-র দাপটে এয়ারটেল আর ভোডাফোনও খুব চাপে পড়ে যাচ্ছে। আর সরকারি বিএসএনএল আর এমটিএনএলের কথা তো উঠতেই পারে না। সরকারি মাল মানেই যে ফালতু সেটা সদ্যজাত শিশুরাও জানে। তাহলে আসুন, আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক।

আপনার-আমার হাতের মোবাইল সেটে তার থাকে না বলেই যেখানে সেখানে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারি। মোবাইল টাওয়ার দেখে হয়তো ভাবেন, বেতার ব্যবস্থা প্রাইভেট কোম্পানির গুণে আপনার কত্ত সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল, টাওয়ারের কিন্তু তার লাগে সিগনাল আদানপ্রদানের জন্য। সেই তারকে বলা হয় অপটিকাল ফাইবার কেবল বা ওএফসি। কাজেই ওএফসি-র জাল কতটা ছড়ানো, তার উপর নির্ভর করে আপনার মোবাইল কতটা জোরদার হবে। তাহলে নিশ্চয়ই এই জিও-এয়ারটেল-ভোডাফোন, এই ত্রয়ীর হাতেই গড়ে উঠেছে ভারতের ওএফসি নেটিওয়ার্ক। অবশ্যই তাই। আসুন দেখা যাক এদের ও এফ সি নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ, অর্থাৎ কত কিমি তার তারা পেতেছে:

নিশ্চয়ই ভাবছেন ভাগ্যিস, এরা এসেছিল, তাই আমি যেখানে সেখানে বসে মোবাইলে গুলতানি করতে পারি। সরকারি কোম্পানি পারত নাকি এমন কাণ্ড করতে!

তাহলে জেনে নিন, শুধু বিএসএনএলেরই ওএফসি নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য হল ৭,৫০,০০০ কিমি। অর্থাৎ তিন প্রাইভেট কোম্পানির মোট নেটওয়ার্কের থেকেও বেশি। এবং সবাই সবার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। ব্যবহারকারীর সংখ্যার ভিত্তিতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিন কর্পোরেট কোম্পানি যে পরিমাণে বিএসএনএলের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, বিএসএনএল অন্যদের ব্যবহার করে অনেক কম। আপনি অবশ্য বলতেই পারেন, তাতে আমার কী? আমি দেখব সার্ভিস কেমন। বিএসএনএল-এর সার্ভিস বলে যে কিছুই নেই, সেটা তো সব্বাই জানে। তাহলে আসুন, এর পিছনের গল্পটা একবার শুনে নিই।

ভারতে মোবাইল টেলিফোনি প্রথম এনেছিল কমান্ড কোম্পানি। নানা হাত ঘুরতে ঘুরতে এয়ারটেল আর হাচ (বর্তমানের ভোডাফোন) হয়ে ওঠে দুই প্রধান খেলোয়াড়। বিএসএনএল-কে মোবাইল সার্ভিসে নামতে দেওয়া হয় এর পরে। সেই সময়ে ইনকামিং কলেও চার্জ লাগত যা আউটগোইং কলের প্রায় সমানই ছিল। আমি যখন প্রথম মোবাইল নিতে বাধ্য হই (২০০২ সালে) তখন আউটগোইং চার্জ ছিল ১.৯৯ টাকা/মিনিট আর ইনকামিং চার্জ ১.৭৫ টাকা/মিনিট। কারণ তখন ইন্টার-কানেকটিভির জন্য অন্য কোনও কোম্পানির ওএফসি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করলে তার দাম দিতে হত। বোঝাই যাচ্ছে, এই ব্যবস্থার সুফল যেত বিএসএনএলের ঘরেই। কারণ প্রায় পুরো নেটওয়ার্কটাই ছিল বিএসএনএল-এর। নিজেদের দুই গ্রাহকের মধ্যে কথা চালাতেও এইসব কোম্পানিকে বিএসএনএলের দ্বারস্থ হতে হত। বিএসএনএল গাঁটের কড়ি খরচ করে সেই পরিকাঠামো বানিয়ে চলল, যার বাণিজ্যিক সুবিধা নিল প্রাইভেট অপারেটররা।

ইতিমধ্যে CDMA প্রযুক্তি নিয়ে ভারতে ব্যবসা শুরু করল রিলায়েন্স। কিছুদিন পরেই TRAI অর্থাৎ টেলিফোন রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া নির্দেশ দিল ইন্টার-কানেকটিভিটির জন্য কোনও দাম নেওয়া চলবে না। এই নির্দেশের ফলে প্রবল ক্ষতির মুখে পড়ল বিএসএনএল। পরিকাঠামোয় যে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছিল, সেটা হয়ে গেল অনুৎপাদক। তার থেকে মুনাফা আদায়ের আর রাস্তা রইল না। অন্যদিকে বিএসএনএল-এর পরিকাঠামো বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ায় প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর লাভের বহর গেল বেড়ে। এই পরিস্থিতিতে বিএসএনএল নিজের ক্ষতি সামলাতে পারত একমাত্র মোবাইল ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে।

এই সময় পর্যন্ত ভারতে ছিল টু-জি টেলিকম সার্ভিস। তার লাইসেন্স প্রদান নিয়ে পরবর্তীকালে বিশাল কেলেঙ্কারি হয়। ইতিমধ্যে চলে এসেছে থার্ড জেনারেশন বা থ্রি-জি মোবাইল প্রযুক্তি। ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিল বিএসএনএল-কে থ্রি-জি স্পেকট্রাম ব্যবহার করতে দেওয়া হবে পরীক্ষামূলকভাবে। অর্থাৎ সেই একই গল্প। পরিকাঠামো গড়ে তোলা এবং দায় বিএসএনএল-এর। থ্রি-জি মোবাইল সার্ভিসের প্রসারের জন্য বিএসএনএল নতুন নতুন গ্রামীণ এক্সচেঞ্জ গড়ে তোলে। এরপর সরকার থ্রি-জি স্পেক্ট্রাম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। স্বভাবতই বিএসএনএলও যে অন্যতম খরিদ্দার হবে, সেটাই স্বাভাবিক। না, বিএসএনএল-কে নিলামে দর হাঁকার সুযোগটাই দেওয়া হল না। তার আগেই থ্রি-জি স্পেক্ট্রামের একটা অংশ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হল। শর্ত হল, নিলামে প্রতিটি টেলিকম সার্কলে যে সর্বোচ্চ দর উঠবে, বিএসএনএল-কে সেটাই দিতে হবে। আরও শর্ত দেওয়া হল, এক বছরের মধ্যে এক কোটি নতুন ব্রডব্যান্ড গ্রাহক বানাতে হবে।

বলতেই পারেন, বিএসএনএল-কে তো স্পেক্ট্রাম দেওয়াই হল। তাহলে আর অসুবিধে কোথায়? অসুবিধা এটাই যে লাভজনক সার্কল বেছে শুধু সেখানেই লাইসেন্স নেবার সুযোগ আর থাকল না। অন্য যাবতীয় কোম্পানি কিন্তু সেই সুযোগটা পেল। আবার বাড়তি এক কোটি ব্রডব্যান্ড গ্রাহকের শর্ত পূরণের জন্য গ্রামীণ এক্সচেঞ্জগুলোকে ঢেলে সাজাতে হল। সরকারের যুক্তি ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিএসএনএল-এর দায়িত্ব আছে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলেও টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা পৌঁছে দেবার।

এর পরে পরেই চলে এল ফোর-জি সার্ভিস। ২০১৪ সালে ফোর-জি স্পেক্ট্রাম নিলাম করা হল। সারা ভারতেই ফোর-জি স্পেক্ট্রাম পেল রিলায়েন্স জিও। বিভিন্ন সার্কেলে সেই অধিকার পেল এয়ারটেল, ভোডাফোন এবং আইডিয়া। বিএসএনএল-কে সেই নিলামে অংশগ্রহণ করতেই দেওয়া হল না। অনেকেই ভেবেছিলেন থ্রি-জি স্পেক্ট্রাম নিলামের মতই পরবর্তীকালে সর্বোচ্চ দামেই বিএসএনএল-কে স্পেক্ট্রাম দেওয়া হবে। না, অদ্যাবধি সেটা হয়নি। ২০১৯-এর নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে নির্বাচনী সংযোগের জন্য সরকার বিএসএনএল-কে ফোর-জি স্পেক্ট্রাম দিতে বাধ্য হয়েছিল। বাণিজ্যিকভাবে ফোর-জি সার্ভিস দেবার অনুমতি বিএসএনএল এখনও পায়নি। কেবল চণ্ডীগড়ে সরকারি দপ্তর ও আধিকারিকদের কেবল দপ্তরসংক্রান্ত যোগাযোগের জন্যই সেই সীমিত অধিকার পেয়েছে। স্বভাবতই বিএসএনএল ক্রমাগত গ্রাহক হারাচ্ছে। যে বিপুল মূলধনী বিনিয়োগ করানো হয়েছিল সরকারি চাপে, তার দায় চেপে বসেছে ঘাড়ের উপর।

প্রাইভেট অপারেটররা যাতে ফাইভ-জি সার্ভিসে নিজেদের তুলে আনতে পারে, তার জন্য হাই ফ্রিকোয়েন্সি স্পেক্ট্রাম তাদের হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনা চলছে। আর বিএসএনএল-কে আটকে রাখা হয়েছে থ্রি-জি-র স্তরে। তাই বিএসএনএল-এর আর্থিক ক্ষতি ছিল অনিবার্য। সেই ক্ষতি বিএসএনএল-এর অকর্মণ্যতা কিংবা অপদার্থতার জন্য হয়নি। হয়েছে সরকারের নীতির কারণে। আজ ৭৪,০০০ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্যের দায় নিতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজি নয়। অথচ ৯০,০০০ কোটি টাকার বিনিময়ে বিএসএনএল বন্ধ করে দিতে রাজি। অর্থাৎ প্রাইভেট অপারেটরদের প্রতিদ্বন্দ্বী কমানোই যে এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

এই ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের পিছনে পরপর চারটি কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা কমবেশি একই। কেউ ছুরিটা খুব চালাকি করে চালিয়েছে যাতে আঘাতের চিহ্নটা নজরে না পড়ে। আর কেউ, হয়তো স্পনসরদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি বজায় রাখার দায়ে, আর ধৈর্য ধরতে পারছে না, দ্রুত কুড়ুল চালাতে শুরু করেছে।