তানিয়া লস্কর
গুয়েন্তানামো বে-র কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। আমেরিকার অনেকগুলো পাপকার্যের একটি। ২০০২ সালে জর্জ ডাব্লিউ বুশ তার “ওয়ার অন টেরর” বা “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে এইটি তৈরি করেছিলেন। আজকে পর্যন্ত সেখানে প্রায় ৮০০ লোক বন্দি হয়েছেন। যাদের ৯৯% মুসলমান। আমেরিকান মিলিটারিদের দেওয়া তথ্য মতে তাদের বেশিরভাগই নাকি আফগানিস্তানের যুদ্ধে গ্রেফতার হয়েছেন। অথচ সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের মতে আসলে এদেরকে বাউন্টি বা সুপারি কিলাররা টাকার বিনিময়ে আমেরিকান মিলিটারিদের কাছে বেচে দিয়েছে। এরকম একজন হলেন চিনের উগের রিফিউজি আদিল নুর। তিনি বহুবছর জেলে কাটানোর পর ২০০৮ সালে নিজের কেস জিতে বেরিয়ে আসেন। এদের কথা জানা আমাদের জন্য কেন জরুরি? কারণ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশে এরকম কয়েক হাজার আদিল নুর তৈরি হতে পারে। কারণ অসম সরকার এবং ভারত সরকারের যুগলবন্দিতে গোয়ালপাড়ার মাটিয়া অঞ্চলে প্রায় ২.৫ হেক্টর জুড়ে এমন একটি “গুয়েন্তানামো বে” প্রায় তৈরি।
এই ক্যাম্পটিতে প্রায় ৪৬ কোটি ব্যায় করে তিন হাজার মানুষের জন্য তৈরি হচ্ছে বন্দিশালা। সেখানে থাকবে একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি হসপিটাল, নবজাতক এবং মায়েদের জন্য একটি নার্সিং সেন্টার। ১৫টি চারতলা বিল্ডিং-এ বন্দিরা থাকবেন এবং তাতে ১৮০টি বাথরুম থাকবে। আর থাকবে একটি কমন রান্নাঘর। বর্তমানে সারা অসম জুড়ে এমন ছয়টি ডিটেনশন ক্যাম্প আছে। সেখানে প্রায় হাজারখানেক লোক বন্দি হয়ে আছে। এর মধ্যে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্প বিশেষভাবে পুরুষদের জন্য এবং কোকরাঝাড় মহিলাদের জন্য। আপাতত সেন্ট্রাল জেলগুলোর একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে ক্যাম্প বলে ডেজিগনেটেড করে রাখা হয়েছে। গত আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে বলা হয়েছে যে ডিটেনশন ক্যাম্পে যারা ৩ বছর থেকে বেশি সময় ধরে বন্দি হয়ে আছেন, তারা ২ জন জামিনদার এবং দুই লক্ষ টাকার বেইল বন্ড দিলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট পুলিশ থানায় নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যেতে হবে। এমনকি নিজের বায়োমেট্রিকস ডাটা সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে। তবুও একথা শুনে নগাঁও জেলার হালিমা খাতুনের বৃদ্ধ মা-বাবা খুব উচ্ছসিত হয়ে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন এখন হয়তো মেয়েকে কাছে পাবেন। একজন জামিনদার পেয়েছেন কিন্তু গত তিনমাস থেকে আরেকজনের খোঁজ চলছে। চরের লোক, জমির কাগজ তারা কোথায় পাবেন? তাছাড়া বিদেশি ট্যাগ লাগানোদের জামিনদার হয়ে কে-ই বা রাষ্ট্রের চক্ষুশূল হতে চায়। ষাটোর্ধ্ব বাবা মা দুজনই ভারতীয়। মায়ের সম্প্রতি চোখের অপারেশন হয়েছে। মেয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধার চোখে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। এই কান্না শোনার কেউ নেই। সবাই এখন অঙ্ক নিয়ে বসেছেন। কত কোটি খরচা হয়েছে ক’হাজার বাদ পড়েছেন। আর ডিটেনশন ক্যাম্পের ভিতরের গল্প, সে তো আরও করুণ। রতন চন্দ্র বিশ্বাস, গত দুবছর থেকে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন। তিনি গতবছর নভেম্বর মাসে হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাকে তখন গোয়ালপাড়া সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়েছে। অমৃতলাল দাশ গত এপ্রিল মাসে হঠাৎ ডিটেনশন ক্যাম্পেই মারা গেছেন। তার স্ত্রীর মতে তিনি দু’দিন আগেই স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। চিড়ে মুড়ি গুড় ইত্যাদি শুকনো খাবার দিয়ে এসেছিলেন। তাকে দেখতে সুস্থই লাগছিল। কিন্তু তিনি যখন বলেছিলেন ক’দিন পরে তোমাকে ঠিক বার করে নিয়ে যাব, অমৃত তার দিকে চেয়ে মৃদু হেসেছিলেন। কেমন যেন নিরুত্তাপ ধরনের হাসি। দুদিন পরে হঠাৎ ফোন করে তাকে মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়। এমনই মাঝে মাঝে অসমের দু’একটি গ্রামে দু’চারটি লাশ এসে ঢোকে। কান্নার রোল ওঠে কিন্তু সেসব খবর কাগজের ভিতরের পৃষ্ঠার কোনও এক কোণায় ছাপা হয়। তবে সহ্যের বাধ ভাঙছে বোধহয়। চারদিন আগে তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি দুলাল চন্দ্র পাল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গৌহাটি মেডিকেল কলেজে মারা যান। কিন্তু তার পরিবার মৃতদেহটি সমঝে নিতে অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি আগে তাকে ভারতীয় ঘোষণা করা হোক তাহলেই মৃতদেহ গ্রহণ করবেন তারা। পরিবারের সন্দেহ দুলালবাবুর মৃত্যু আসলে ক্যাম্পের অমানবিক নির্যাতনের জন্য হয়েছে। তাকে পাগল সাজিয়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। অথচ ভারতের প্রথম সারির খবরের কাগজগুলোতে প্রায় শিরোনাম দখল করে কত কোটি খরচে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে। কোথা থেকে কত টাকা আসছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে কী কী ফেসিলিটি থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি সেলুকাস!
যে আমেরিকার গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই গল্পতেই ফিরে যাওয়া যাক। জানেন তো বিশ্বের জেলবন্দিদের প্রায় ২২% আমেরিকার জেলগুলোতে বন্দি হয়ে আছেন। যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪.৪% লোক সেখানে বসবাস করেন। বলাই বাহুল্য যে এদের প্রায় ৭০% অ্যাফ্রো-আমেরিকান। আমেরিকার প্রিজন সিস্টেম নিয়ে যারাই অল্প পড়াশুনা করেছেন তারা জানেন যে এর অন্যতম কারণ হল আমেরিকার জেলগুলো বেসরকারি জেল। সেগুলো খালি থাকলে সরকারকে সেগুলো লিজ নেওয়া করপোরেশনগুলোকে একটি নির্ধারিত ভর্তুকি ফিস দিতে হয়। সুতরাং সরকার নানারকম ইনসেনটিভ ইত্যাদি পাঁয়তারার মাধ্যমে সবসময় জেলগুলো ভর্তি করে রাখেন। ২০১৮ সালে শেইন বুয়ের নামে এক আমেরিকান একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম “আমেরিকান জেল— শাস্তি ব্যবসায় চোরাগোপ্তা যাত্রার গল্প”। বইটি লেখার আগে তিনি কয়েকমাস এমনি একটি জেলে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করেন এবং সেখানে তার স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এই বইটি লিখেছেন। জেল অধিকারিকরা কয়েদিদের সঙ্গে কীরকম অমানবিক ব্যবহার করে। তারা অসুস্থ লোকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না পয়সা বাঁচানোর জন্য। তাদের অত্যাচারের ফলে লোকের মৃত্যু হলে তারা সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়। গতবছর জানুয়ারি মাসে বড়দা ট্রাম্প গুয়েন্তানামো বে-র দরজা খুলে দিয়েছেন। সেখানে এখন অব্দি ৪৪ জন নতুন মুসলিম কয়েদিকে ট্রান্সফারও করা হয়ে গেছে। অসমেও ৯৩৮ জনের মধ্যে ৯৮ শতাংশ বাঙালি। এখনও পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে আবার পঞ্চাশ শতাংশ মানে ১৩ জন হিন্দু। অথচ আমাদের ড্যাশ হৃদয় সম্রাটের এতে কোনও ট্যা ফু নেই। তিনি নিশ্চয় বড়দাকে অনুসরণ করতে পেরে গদগদ হচ্ছেন। আর সারা ভারতে নতুন নতুন ডিটেনশন ক্যাম্প খোলার ফন্দিফিকির আঁটছেন। আর বড়দার দেশের কর্পোরেট বন্ধুরা ব্যাবসার নতুন সুযোগ দেখতে পাচ্ছেন। এদেশে বন্ধু আম্বানি আডানিরাও নিশ্চয় জিভের জল ফেলতে শুরু করে দিয়েছেন। এবার আমাদের উপর দায়িত্ব। আমরা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শক হয়ে থাকব? নাকি রুখে দাঁড়াব? চলুন আর কিছু না পারলে অল্প আর্তনাদ করি। বরপেটার মিঞা কবি গাজী রহমানের ভাষায় বলি—
আংগো মা আমারে মেলা বালোবাসে
এহন বাসে না
কিবা কৈরা বাসপো
আংগো মা তো বাইত্তেই নাই…..
ঐ জেলে আংগো মা থাকে!
আংগো মা বোলে বিদেশি
ঐ দ্যাশ থিকা আইছে
আংগো খালা, আংগো মামা
হেনেই থাকে
আংগো নানি তো নাই
নানা মৈরা গেছে মেলা বছর অয়
আমি দেহি নাই
নানার নামে কাগজ আছে
ওরা বিদেশি ন্যে
খালি আংগো মা…..!আংগো মার বান হুকাইয়া গেছে গা
এবি আংগো মার শইললে মাংস নাই
খালি কয়টা হাড্ডি..
আমি আংগো মার বগলে যামু
আমিও জেলেই থাকমু
আমি কমু যে আমি বিদেশি
হ আমিও বাংলাদেশি
কেরা নিয়া যাব আমারে
আংগো মার বগলে?
বাবারে মেলা বার কৈছি
নিয়া যায় না
বাবার বোলে কান্দা আহে
আইব তো
আংগো বাবা আংগো মারে
মেলা বালোবাসে
আমিও বাসি
আংগো মাও বাসে
এহন বাসা হারে না
কিবা কৈরা বাসপো
আংগো মা তো হেনে নাই
ঐ জেলে আংগো মা থাকে!(ঐ জেলে আংগো মা থাকে / গাজী রহমান)