শৈলেন সরকার
এ বছরের গত ৯ সেপ্টেম্বরের পিটিআই-য়ের একটি খবরে প্রকাশ, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে সাত জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এরা নাকি সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। অভিযোগ তো গুরুতর, তা হলে ঘটনাটা কী জানা যাক। ঘটনা, উত্তরপ্রদেশের বিজনোর অঞ্চলের বাসি গ্রামের। সে দিন ঘটনাটা ঘটলেও, তার একটা পূর্ব ইতিহাস আছে। আগের মাসে এক দলিত পরিবারের কন্যা স্থানীয় এক হাত-পাম্পের কল থেকে জল আনতে গেলে উচ্চবর্ণের মানুষজন বাধা দেয়, এবং তাকে শারীরিক নিগ্রহ করে। মেয়েটির বিধবা মা পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে, পুলিশ সাময়িকভাবে একটা মিটমাট করে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। মেয়েটির মা জল আনতে গেলে বাধা পান। এবার অসহায় মহিলা একটি কাগজে ‘আমার বাড়ি বিক্রি হবে’ লিখে বাড়ির দেওয়ালে পোস্টার আটকান। ঘটনাটি সাংবাদিকদের চোখে পড়ে। সাংবাদিকরা তাদের কাজ শুরু করা মাত্র গ্রামের উচ্চবর্ণ শক্তি ও প্রশাসনের রোষে পড়েন, এবং অভিযোগ ওঠে সাংবাদিকরা নাকি সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত।
আমাদের পশ্চিমবাংলায় একেবারে একই কায়দায় প্রাক্তন এক সাংবাদিক ও বর্তমানে কংগ্রেসের এক রাজনৈতিক কর্মী সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হল। অভিযোগের তরিখা অনেক, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৬৫ ধারা (প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি), ৪৬৯ ধারা (সুনাম নষ্টের উদ্দেশ্যে জালিয়াতি), ৫০০ ধারা (মানহানি করা), ৫০৪ ধারা (উস্কানিমূলক বক্তব্যে শান্তিভঙ্গ করা), ৫০৫(১)(বি) ধারা (জনসাধারণের ক্ষতি করে এমন বিবৃতি দেওয়া) ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ নম্বর ধারা (জাল ইলেক্ট্রনিক নথি তৈরি করে গুজব ছড়ানো)। সাধারণভাবে সন্ময়বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নাকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্মানহানি করে সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করছেন। দেখা গেল প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জনের একটি দল, ধরা যাক তাঁদের অনেকেই ছিলেন পুলিশকর্মী, ধরা যাক বলছি এ কারণেই, যে, সন্ময়বাবুর বাড়ির লোক জানাচ্ছেন তাদের সঙ্গে বেশ কিছু পরিচিত তৃণমূল কর্মী ছিলেন। তা ছাড়াও সন্ময়বাবুর বিরুদ্ধে পুলিশের করা অভিযোগ অনুসারে সব ক’টাই জামিনযোগ্য ধারা, অর্থাৎ তিনি সাঙ্ঘাতিক কোনও খুনি বা সন্ত্রাসবাদী নন, তা হলে কেন ওই রাতে পঞ্চাশ-ষাট জনের বাহিনি যাবে? বা সংবাদপত্রের ছবিতে তাঁকে একটি পাজামা পড়া অবস্থায় দেখা যাবে, অর্থাৎ তাঁকে রাতের পোষাক পাল্টাবার সুযোগও দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আর পশ্চিমবাংলার পুলিশের মধ্যে তফাতটা কোথায়?
সন্ময়বাবু গত বিশ বছর ধরে স্থানীয় পুর কমিশনার, সেটা অবশ্য বড় কোনও কথা নয়। সেই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসি আমলে বা ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাম আমলে বা ২০১১ থেকে এই ২০১৯ পর্যন্ত তৃণমূল আমলে আমরা অনেক কমিশনার, পঞ্চায়েত প্রধান বা এমএলএ বা এমপিকে গায়ের জোরে দশ-বিশ-পঁচিশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকতে দেখে অভ্যস্ত। সন্ময়বাবু কিন্তু গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকা মানুষ নন। সিপিএমের আমলে যখন পানিহাটি মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে মার্কসবাদের পবিত্রতা ও প্রায় সব পুর ওয়ার্ড দখলের জন্য নির্বাচনের দিন পুর এলাকার উত্তর দিক থেকে এক এমপি-র নেতৃত্বে আর অন্য দিকে দক্ষিণে কামারহারটির দিক থেকে এক এমএলএ-এর নেতৃত্বে সিপিএম কর্মী ও/বা দুষ্কৃতকারীরা বুথ দখল অভিযান করত, সেই যুগেও সন্ময়বাবুর জয় কেউ আটকাতে পারেনি। পারেনি কারণ, তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল এবং আজও প্রশ্নাতীত। জনপ্রিয়তার কারণ এই নয় যে, তাঁর হাতে আর পাঁচজন এমএলএ-এমপি বা পুর প্রধান বা কমিশনারদের মতো প্রচুর দুষ্কৃতি আছে। আবার সাম্প্রতিক বাংলায় আগন্তুক এক ফ্যাসিবাদী পার্টির মতো মিটিং-এ যাওয়ার জন্য বা ভোট দেওয়ার জন্য তিনি গোছা গোছা নোটও বিলি করেন না। সন্ময়বাবুর জনপ্রিয়তার কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে পিছিয়ে যেতে হবে। তখন বাম বা ডানপন্থী রাজনীতিকদের মধ্যে এমন শিক্ষিত, নম্র, সমাজসেবী মানুষ মিলত। এমনকী সন্ময়বাবুর বাসস্থান পানিহাটিও এককালে সন্ময় ঘোষ বা তপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিককে দেখেছে।
সন্ময়বাবু বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে খুবই সক্রিয়। সুযোগ পেলেই তিনি বর্তমান সরকার ও সরকারের বিভিন্ন নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। আর এটাই তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ। তা হলে তাঁর দোষটা কোথায়? তাঁর দোষটা আসলে অন্যত্র। একটি খুবই স্থানীয় ঘটনায়। বলছি স্থানীয়, কিন্তু ঘটছে সর্বত্রই। প্রতিবাদের রাস্তায় না গিয়ে, মানুষ ভয় পেয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেদের, বা ভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মীরা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পাওনা-গণ্ডার ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। সন্ময়বাবু এমন ভাগ-বাটোয়ারায় যাওয়ার বা ভয়ে গুটিয়ে যাওয়ার লোক নন। অসুবিধা ছিল এখানেই। এমনিতেই সিপিএমের আমল থেকেই এলাকার পুকুর বা মৃত কারখানার জমি নিয়ে অবৈধ ভরাট বা বিক্রি চলছেই। তৃণমূলের আমলে তা বেড়েছে বই কমেনি এতটুকুও। সাধারণ মানুষ সব দেখেও ভয়ে নির্বাক। কিন্তু সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্বাক রাখা যায়নি। অতি সম্প্রতি স্থানীয় এক পুর কমিশনার মিউনিসিপ্যালিটিতে গিয়ে মহাতাণ্ডব করে নিজের পেশী প্রদর্শন করেন। মিউনিসিপ্যালিটির অফিসাররা অফিস ছেড়ে বাইরে গিয়েও পালাবার জায়গা পাননি। সন্ময়বাবুর দোষ এই ঘটনা তিনি সামাজিক মাধ্যমগুলির সাহায্যে খুবই গুরুত্ব দিয়ে জনসমক্ষে আনেন। আর এতেই স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের রোষে পড়েন তিনি।
কিন্তু এই সব ঘটনায় লাভ হচ্ছে কার? এক কথায় বাংলায় আগন্তুক ধর্ম ও জাত-পাত ভিত্তিক রাজনীতির প্রবক্তা এক ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির। এই মুহূর্তে জার্মানির হিটলারের উত্থানের কথাই তো মনে আসা উচিত। যখন সবাইকে এক জোট হয়ে মানবতা বিরোধী-সভ্যতা বিরোধী এক শক্তির বিরুদ্ধে লড়ার কথা, তখন বাংলার তৃণমূল-সিপিএম বা কংগ্রেস নিজেদের মধ্যে লড়ছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে এখানে তৃণমূলের দায়ই বেশি। তারা সরকারে আসীন, ও এখনও তারা প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করছে না। তৃণমূলের উচিত ছিল সন্ময়বাবুর অভিযোগ পুলিশকে দিয়ে তদন্ত করানো, ও অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে সেই পুর কমিশনারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তা না করে সরকারপক্ষ যা করল, তাতে একমাত্র আগন্তুক ফ্যাসিবাদী শক্তিরই উৎফুল্ল হওয়ার কথা। হয়েছেও। এই দলের রাজনৈতিক নেতারা ভালোমানুষের মুখোশ পড়ে সন্ময়বাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছেন।
১৯৪০ সালে জার্মানের সাধারণ মানুষ যখন হিটলারের উগ্র দেশপ্রেম ও জাতিবিদ্বেষের সুড়সুড়িতে আবেগে বিহ্বল ও দেশপ্রেমে ভাসমান, ১৪ জুন বার্টোল্ট ব্রেখট লিখলেন, ‘ভবিষ্যতে এটা বোঝা খুবই দুষ্কর হবে, যে আজকের দিনগুলিতে এত পুরুষত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে কেন আমরা শুধু নিজেদের মধ্যে লড়ে গেলাম?’
কে জানে, আমাদের কোনও কবি হয়তো কোনও জেলখানায় বসে একদিন এই কথাগুলিকেই স্বগোতক্তির মতো করে উচ্চারণ করবেন।