সিসিফাস
অজয় নদ। বীরভূম-বর্ধমানের সীমান্তের উপর এক সাক্ষ্য। ১৮০৩ সাল থেকে রাজনৈতিকভাবে এই সীমান্ত ঘোষণা হলেও সামাজিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে নদী যদিও এই দুই জেলাকে দেখে এসেছে জন্মাবধি। পর্যটন শিল্পের বিকাশের বেশ কিছু সাক্ষ্য রেখেছে নদীমাতৃক বীরভূম-বর্ধমান। অতীতের সেনপাহাড়ি পরগনা। বর্ধমানের রাজা চিত্রসেনের সময়কালে (১৭৪০ থেকে ১৭৪৪ সাল পর্যন্ত) এই সেনপাহাড়ির পুনর্গঠন শুরু হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, সেন রাজবংশের পূর্বপুরুষেরা দাক্ষিণাত্য থেকে বাংলায় এসে প্রথম এই অঞ্চলেই বসতি গড়েন, পরে রাজনগরের দিকেও যান। সুকুমার সেনের মতে, এই সেন বংশের থেকেই সেনপাহাড়ি নামটির জন্ম।
অযোধ্যা-বনকাটি যাওয়ার রাস্তা, সাতকাহন গ্রাম
এই অজয়ের তীরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক গ্রামেই স্থাপত্য কথা বলে। তৈরি হয় আঞ্চলিক শৈলী। কিংবদন্তী মন্দির গবেষক ডেভিড ম্যাককাচ্চনের ভাষায় যা ‘বীরভূম বর্ধমান টাইপ’। আজকের বর্ধমান জেলার এইসব গ্রাম কখনও লোকসমারোহে কখনও প্রত্যন্ত এক স্মৃতির ভেতর পড়ে থাকে। এককালীন গালা ও কাঠকয়লা শিল্পের পীঠস্থান আজ সব হারিয়ে সবার অগোচরে।
অযোধ্যা-বনকাটি। বর্ধমানের কাঁকসা থানার অন্তর্গত দুই যমজ গ্রাম। মন্দির-গ্রাম। অতীতের সেনপাহাড়ি পরগণার অন্তর্গত এই যমজ গ্রাম এখন সাতকাহন মৌজার মধ্যে পড়ে। একটু এগোলেই এই সাতকাহন নামে কাছেই বিখ্যাত একটি নাট্যগ্রাম চোখে পড়বে। বীরভূম-বর্ধমানের শক্তিপীঠ বা মুষ্টিমেয় দুএকটি বিখ্যাত মন্দিরের তুলনায় এই দুটি গ্রাম এবং স্থাপত্যগুলি লোকচক্ষুর অন্তরালেই। বনকাটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মন্দির পঞ্চরত্ন গোপালেশ্বর শিবমন্দির। দশ মহাবিদ্যার অপরূপ টেরাকোটা কাজ। বাংলার মন্দির গাত্রে দশমহাবিদ্যার এত বিপুল সমারোহ বিরল। ১৮৩২ সালে পঞ্চরত্ন বন্দোপাধ্যায় তাঁদের পুরনো ম্যানসনের পাশে তৈরি করেন এই মন্দির। অদ্ভুৎ এক ধ্বংসাবশেষের পাশে সৃষ্টির নিদর্শন। সেইসব দিন, বাড়ি, হাঁটাচলা— নেই। অথচ পোড়ামাটি কথা বলছে।
বনকাটিতে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পরিত্যক্ত ম্যানসন
পঞ্চরত্ন গোপালেশ্বর শিবমন্দির
পঞ্চরত্ন গোপালেশ্বর শিবমন্দিরের টেরাকোটার কাজ
দুবছর পর অর্থাৎ ১৮৩৪ সালে ঠিক পাশেই একইরকম পঞ্চরত্ন রীতির এক পিতলের রথ। নিচে লোহার চাকা। রথের গায়ে অনবদ্য এনগ্রেভিং। হাতির মাথা, ঘোড়ায় চাপা সৈন্য, অথবা রামায়ণ, মহাভারতের দৃশ্য। বাংলার মন্দির ও স্থাপত্যে খুব বিরল এরোটিক দৃশ্যের কিছু এই রথের গায়ে। এই এনগ্রেভিং টেনে এনেছে মুকুল দে, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু, তারাপদ সাঁতরার মতো মানুষকে। এই রথের অলঙ্করণ থেকেই শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত কালো বাড়িতে বেশ কিছু ম্যুরাল তৈরি করেন নন্দলাল। যোগ দিয়েছিলেন কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা।
পিতলের পঞ্চরত্ন রথ
রথের এনগ্রেভিং
কাছেই বনকাটির রায়পরিবারের কালীবাড়ি প্রাঙ্গন। বিরাট এক কদমগাছ। নিচে পোড়ামাটির ঘোড়া। কেন? জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, এসমস্তই গ্রামদেবতার কাছে অর্পিত।
গ্রামদেবতার কাছে অর্পিত পোড়ামাটির ঘোড়া
আধুনিক এক কালীমন্দিরের সামনেই ১৭৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত দুটি উত্তরমুখী চালামন্দির। প্রবেশপথের ওপরে টেরাকোটা রিলিফ। তান্ত্রিক ও শৈব মোটিফের প্রাধান্য চোখে পড়ল। কখনও দেবী ত্রিপুরেশ্বরী। কালীমন্দির এলাকায় তন্ত্রসাধনার ইতিহাসের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তবে এগুলির অধিকাংশই এখন ধ্বংসের মুখে। পঞ্চাশ বছর পর অর্থাৎ ১৮৩৪ সালে তৈরি হয় পূর্বমুখী তিনটি দেউল। কালীমন্দিরের প্রতিমার কাঠামো, লোকবিশ্বাস, শ্রুতি, একাকী এক বৃদ্ধ— মনে হয় একখণ্ড ইতিহাস সময়ের ভুলে এখনও আঁকড়ে পড়ে আছে বনকাটির মাটি।
রায়বাড়ি কালীমন্দির প্রাঙ্গনের দুটি চালা মন্দির
রায়বাড়ি কালীমন্দির প্রাঙ্গনের তিনটি দেউল মন্দির
টেরাকোটায় দেবী ত্রিপুরেশ্বরী
এখনও টিকে থাকা এই মন্দির প্রাঙ্গনের পাশেই অদ্ভুত দোটানায় ধ্বংসের চিহ্ন। আশ্চর্য শান্ত এক অরণ্য। গাছেদের নিবিড় আশ্রয়। শোনা যায় বল্লাল সেনের তন্ত্রগুরু মহেশ্বরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তন্ত্রসাধনার জন্য বনকাটির অরণ্যে আসেন। তার উত্তরসূরি লক্ষ্মীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে তৈরি হয় মন্দিরগুলি। অদ্ভুত এক আলো আঁধারি আরণ্যক পরিবেশে সেইসব দিনের সাক্ষ্য রেখে যায় মন্দিরগুলি। রায়বাড়ির মন্দির প্রাঙ্গনের কাছেই একটি সমতল ছাদবিশিষ্ট বিষ্ণু মন্দির। ভাঙন। একাকিত্ব। কাছেই দুটি দেউল। প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ‘বরানগরের দিদি’ নামে কথিত এক নারী নির্মাণ করেন এগুলি। টেরাকোটা কাজ আজ প্রায় কিছুই নেই। রিলিফ খুলে ফেলা হয়েছে। নাকি প্রাকৃতিক ভাঙন? দূর থেকে দেখলে মনে হবে, মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকা দুই বৃদ্ধের কথোপকথন। নির্বাক।
বনকাটির একটি সমতল ছাদের বিষ্ণু মন্দির
বরানগরের দিদির দেউল
দেউল গাত্রের ধ্বংসপ্রাপ্ত টেরাকোটা
এইসব ধ্বংসের কথা উত্তরসূরি বৃদ্ধ অনিল কুমার রায়ের মুখে শুনলাম। শিল্পের কথা, ইতিহাসের কথা, হলেও হতে পারত এক পর্যটন পীঠস্থানের কথা তার চোখে, স্বপ্নে, স্মৃতিতে। দেউল, চালা সবকটি মন্দিরেই উপরের ছাদ ভেঙে জল পড়ছে। অর্থ নেই। বৃদ্ধ ভিক্ষায় বেরোবেন। বনকাটি, অযোধ্যা বা আশেপাশে যতটুকু পারেন। করুণ এক মাধুকরী। প্যাথোস …
রায়বাড়ির উত্তরসূরি অনিল কুমার রায়
সমগ্র অযোধ্যা-বনকাটিতেই ছড়ানো বেশ কিছু মন্দিরে আধুনিকতা ও পাশাপাশি জরার নিদর্শন। অযোধ্যার ময়রাপাড়ার পঞ্চরত্ন শিব মন্দিরের প্রাচীনতা এবং কাজ রং করে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ। নতুন প্লাস্টার। কুখ্যাত মোহান্ত-এলোকেশীর ঘটনার সাক্ষ্য রাখা একটি বিরল রিলিফ চোখে পড়ার মতো। প্রবেশপথের ওপরে টেরাকোটা কাজ। রেড অক্সাইডের প্রলেপ। পাশেই দেউল রীতির শিবমন্দির। টেরাকোটা রিলিফ কিছুই বোঝা যায় না। সময়ভেদে পার্থক্য নেই তেমন। অথচ পরিণতি?
কাছেই অযোধ্যার কামারপাড়ার পরপর চারটি রেখদেউল। প্রতিটির প্রবেশপথের ওপরে টেরাকোটা কাজ। রামের রাজসভা। অশ্বারোহী সৈন্য। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে তৈরি হওয়া এই মন্দিরগুলির পেছনে রয়েছে কর্মকার পরিবারের হাত। যারা পরবর্তীকালে বীরভূমের কোটা-শিরশায় চলে গিয়ে সেখানেও এক মন্দির-গ্রাম তৈরি করেন। মন্দিরগুলির প্রবেশপথের উপরে চুনের প্রলেপ। আশ্চর্য এক অবিবেচকতা। পিছনের দিকগুলি ধূলিসাৎ প্রায়। সামনে গ্রামজীবন, তুলসীমঞ্চ, গোয়ালঘর। স্তব্ধ, শান্ত, হারানো আর থেকে যাওয়ার মাঝে এক মধ্যবর্তী লোকায়ত পৃথিবী।
অযোধ্যার কামারপাড়ার রেখদেউল
এই সমস্ত মিলিয়েই অযোধ্যা-বনকাটি। স্থাপত্যের থেকে যাওয়া অথবা হারানো, প্রজন্মের ব্যবধানে ভুলে যাওয়া কিছু ঐশ্বর্যের যমজ গ্রাম। আলো আসবে, এ আশা নেই। সঠিক সংরক্ষণে ইতিহাসের ম্যাজিক ফিরে পাবে হৃত গৌরব, এ আশাও আকাশকুসুম। অজয়ের পার ধরে আসি। জলধারা। বয়ে যাওয়া। নিরবধি। এইসব স্থাপত্যের যতটুকু দেখে যেতে পারে, দেখুক। এটুকুই…
ঋণস্বীকার –
অধ্যাপিকা শ্রীলা বসু, আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক প্রণব ভট্টাচার্য, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়