জিয়াদ আলী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
এ সম্পর্কে আরও জোরালো যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে কোরানের চতুর্থ অধ্যায় ‘নিসা’-র ৩৫ অংশে। নিসা শব্দটা নারীর বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ বিধি সম্পর্কে কোরানে সর্বশেষ আর একটা অধ্যায় আছে। সেই অধ্যায়েরই নাম ‘তালাক’ (The Divorce)। সেই অধ্যায়ে উল্লেখিত বিধান পড়লেও জানা যায় যে, এক আসরে (মজলিশে) পর পর এক হাজারবার তালাক বললেও তালাক বৈধ হবে না। কিংবা যে কোনও অবস্থাতে তালাক বললেও তালাক সাব্যস্ত হবে না। রাগের বশে বা মত্ত অবস্থায় তালাক দেওয়া যায় না। চিঠি দিয়েও নয়। অন্যের মারফতও নয়।
কোরান বর্ণিত তালাকের প্রকৃত নিয়ম হল:
একসঙ্গে দাম্পত্য জীবন বজায় রাখা একেবারেই সম্ভব না হলে স্বামী প্রথম মাসে স্ত্রীকে সতর্ক করার জন্য একবার তালাক দেবে। এক মাস অপেক্ষা করে দ্বিতীয় মাসে আবার দ্বিতীয়বার তালাক শব্দটা উচ্চারণ করবে। আবার এক মাস অপেক্ষার পর তৃতীয় মাসে শেষবারের মতো তালাক শব্দ উচ্চারণ করবে। এভাবে পরপর তিন মাসে (Three Consecutive Months) আলাদা আলাদাভাবে তিনবার তালাক দিয়ে মোট চার মাস তাদের অপেক্ষা করতে হবে। এই চার মাস অপেক্ষা করার স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সুরা বাকারাহ্-র ২২৬ অংশে। আর এই চার মাসের মধ্যে স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত না হয় বা পুনর্মিলনের সম্ভাবনা একেবারেই না থাকে তবেই তালাক বৈধ হবে। তবে স্ত্রী যখন ঋতুবতী থাকে বা যখন তার মেনস্ট্রুয়েশন পিরিয়ড চলতে থাকে তখনও তাকে তালাক দেওয়া যায় না। পরপর তিন মাস স্ত্রীর দৈহিক সুস্থতাযুক্ত অবস্থাতেই তালাক দেওয়া যায়। যাতে প্রতিপন্ন হয় যে পুরুষ বা স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ার পূর্ণ সুযোগ পেয়েও আগ্রহী হয়নি।
কোরানে উভয়কে বুঝে দেখার ও চিন্তা করার কথাও বলা হয়েছে। এর জন্য কোনও লোকের মধ্যস্থতার সুযোগ নেওয়ার কথাও ব্যক্ত হয়েছে কোরানের চতুর্থ অধ্যায় ‘নিসা’র ৩৫ অংশে। সেখানে বলা হয়েছে:
আর যদি তোমরা স্বামী ও স্ত্রীর বিরোধের আশঙ্কা করো তাহলে স্বামীর পরিজনদের মধ্য থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিজনদের থেকে একজন বিচারক নিযুক্ত করবে। (তাতে তারা) উভয়ে যদি শান্তি ও মিলনের প্রয়াসী হয় আল্লাহ তাদের মিলিয়ে দেবেন।
কোরানে এ ব্যাপারে সমাজবিদদের সম্বোধন করেও বলা হয়েছে:
তোমরাও যদি দেখো যে বাস্তবিকই তাদের আশঙ্কা অমূলক নয়, ভবিষ্যতে ঈশ্বরের বিধান মেনে চলা তাদের পক্ষে অসম্ভব, কেবল সেই অবস্থায় স্থায়ী বিচ্ছেদ গ্রহণীয়।
কোরানে এরপর পুরুষের পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর যেটুকু উল্লেখ পাওয়া যায় তা একেবারে কোরানের পঁয়ষট্টিতম অধ্যায়ে ‘তালাক’ শীর্ষক আলোচনায়।
এই অধ্যায় সৃষ্টির একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। ইবন উমর তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সময় পদ্ধতিগতভাবে কিছু ভুল করে ফেলেন। এ ঘটনা হিজরি সনের ষষ্ঠ বছরের। অর্থাৎ ৬২৮ খিস্টাব্দ নাগাদ বা অব্যবহিত আগে-পরের ব্যাপার। এ সময়েই ‘তালাক’ শীর্ষক অধ্যায় সৃষ্টি হয়।
এই অধ্যায়ের প্রথম অংশে জনসাধারণকে নয়, নবীকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে:
হে নবী, তোমরা (পুরুষেরা) যখন বেয়াদব স্ত্রীদের বর্জন করবে, তাদের (স্ত্রীদের) বৈধ সময়কাল (তিন ঋতুকাল)-এর দিকে লক্ষ রেখে বর্জন করবে আর সেই সময়কালের ঠিক হিসাব রাখবে এবং তোমার প্রভু আল্লাহ-র প্রতি কর্তব্য পালন করবে। তাদের (স্ত্রীদের) বাসগৃহ থেকে বের করে দিও না কিংবা তারা খোলাখুলি নৈতিকতাবিহীন না হয়ে পড়লে তাদের বের হয়ে যেতে দেবে না। (১)
(২) কিন্তু কোনও মাসের যে কোনও সময়ে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া যাবে না। নারীরা দেহগত দিক থেকে যে সময়ে অশুচি থাকে সেই ঋতুস্রাবের সময় হাজারবার তালাক বললেও তালাক বৈধ হবে না। একমাত্র মাসের শুচিকাল (তোহ্রা) চলাকালীন অর্থাৎ নারী যখন দৈহিক মিলনের উপযোগী থাকে, সেই সময়েই (আগে উল্লেখিত) যাবতীয় নিয়ম মেনে তালাক শব্দ উচ্চারণ করা যাবে। তার মানে স্ত্রীর প্রতি সত্যিই যে পুরুষের অনাসক্তি জন্মেছে এই ঋতুস্রাবহীন সময়েই তা পরীক্ষিত হতে পারে।
(৩) এইটুকু নিয়ম মেনে তালাক দিলেও তালাক বৈধ হবে না। এর সঙ্গে অবশ্যপালনীয় আরও নিয়মের কথা বলা হয়েছে। যেমন, প্রথম মাসে যেদিন স্বামী তালাক শব্দ উচ্চারণ করবে তারপর তাকে স্ত্রীর সঙ্গে এক ঘরেই থাকতে হবে। অর্থাৎ স্ত্রী সম্পর্কে স্বামী যে সত্যিই বীতশ্রদ্ধ, একসঙ্গে থেকেও দৈহিক সম্ভোগ না করে তার প্রমাণ দিতে হবে। সেই স্বামী যদি এই এক মাসের যে কোনও সময় স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত হয় তাহলে স্বামীর দেওয়া তালাক ভেঙে যাবে। তালাক কার্যকর হবে না। এভাবে প্রথম মাসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই দ্বিতীয় মাসে আবার তালাক দেওয়া যাবে। দ্বিতীয় মাসেও একইভাবে স্বামীকে অনাসক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। তবে তৃতীয় মাসে শেষবারের মতো তালাক দিয়ে স্ত্রীকে সতর্ক করা যাবে এবং এক মাস অপেক্ষা করতে হবে একইভাবে। কোনও মাসে স্বামী যদি তালাক দেওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাহলে সে আবার তালাক দিতে চাইলে একেবারে গোড়া থেকে আবার তিন মাস ধরে কোরান বর্ণিত নিয়ম মেনেই তালাক দিতে পারবে। অর্থাৎ মোট চার মাস স্ত্রীর সঙ্গে একসঙ্গে বাস করেও স্ত্রী সম্পর্কে অনাসক্তি বজায় থাকলেই তালাক সাব্যস্ত হবে।
আবার এই নিয়ম মেনে প্রথম মাসে তালাক দেওয়ার পর দ্বিতীয় মাসে কেউ যদি তালাক না দিয়ে নীরব থাকে বা দ্বিতীয় মাসেও তালাক ঘোষণার পর তৃতীয় মাসে যদি তালাক না দেয় তাহলেও তালাক বৈধ হবে না।
বোঝাই যায় তালাক খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বিশেষ মুহূর্তে পুরুষ পরপর তিনবার কেন হাজারবার তালাক বললেও তালাক সাব্যস্ত হবে না।
দাম্পত্য জীবনে ভুল বোঝাবুঝি ঘটলে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটানোর আগে কিন্তু স্ত্রীর চরিত্র খারাপ বলে একতরফা মিথ্যে অভিযোগ এনে স্ত্রীকে বাতিল করার নিয়ম নেই ইসলামের মধ্যে। এ সম্পর্কে কোরানের চব্বিশতম অধ্যায় ‘নূর’ (আলো)-এর চতুর্থ থেকে নবম অংশে বলা হয়েছে:
যে পুরুষ সৎ চরিত্রের নারী সম্পর্কে অপবাদ দেয়, কিন্তু (তার পক্ষে) চার জন সাক্ষী হাজির করতে পারে না তাকে আশিবার কশাঘাত করো আর কখনওই তার প্রমাণাদি গ্রহণ করবে না— তারাই (সেই পুরুষরাই) তো দুষ্কৃতকারী। (৪)
যদি একবার কেউ মার্জনা চায় ও নিজেদের সংশোধন করে তাহলে তার প্রতি আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (৫)
আর যারা নিজেদের স্ত্রী সম্পর্কে অপবাদ দেয় অথচ নিজে ছাড়া (এই অপবাদের) কোনও সাক্ষী থাকে না আল্লাহর কাছে তাকে চারবার শপথগ্রহণ করে বলতে হবে যে সে সত্যি কথা বলছে, তাহলে সেটাই হবে তার প্রমাণ বা সাক্ষী স্বরূপ। (৬)
আর তাকে পঞ্চমবার বলতে হবে যে, সে মিথ্যা কথা বলে থাকলে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসবে। (৭)
তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত করা হবে যদি সে (স্ত্রী) চারবার আল্লাহর নামে শপথ করে স্বীকার করে যে তার স্বামীই মিথ্যাবাদী। (৮)
আর (সেই স্ত্রী) পঞ্চমবার যদি বলে যে তার স্বামী সত্যবাদী তবে তার নিজের (স্ত্রীর) ওপর আল্লাহর ক্রোধ নেমে আসুক। (৯)
এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্যণীয় যে চারিত্রিক অধঃপতনের ব্যাপারটা প্রমাণের জন্য প্রথমে চারজন পার্থিব সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে। আর পরে বলা হয়েছে আল্লাহর নামে শপথ করে নিজের বিবেকের কাছে নিজের স্বীকারোক্তির কথা। নিজের শুভবোধ ও চৈতন্যের ওপর জোর দেওয়ার রীতি সমস্ত ধর্মেরই মূল কথা।
কিন্তু চৈতন্য বা শুভবোধ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় আনা না হলে বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যায় না।
ভারতবর্ষ ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। তাই ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন এখানে উঠতেই পারে না। সেজন্যই ধর্মের নামে কোরান-বিরুদ্ধ কোনও ব্যাপার নিয়ে রাষ্ট্রের তরফে নাক গলানো মুশকিল। মুসলমানের মধ্যে কেউ কেউ ধর্মের নামে তাই অধার্মিক রীতিনীতিকে আঁকড়ে থাকার সুযোগ পেয়ে যায়। কোরানে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাতে একথা কোনওভাবেই মনে করার কারণ নেই যে, বিচ্ছেদের ব্যাপারটা খুব ভালো বা অভিপ্রেত কর্ম। বরং বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক যাতে না ঘটে তার জন্য কোরানে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ঠিকঠিক নিয়ম মেনে চললে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক ঘটানো খুবই কঠিন। সেজন্যই আবু দাউদ, ইবন মাজা, হাকেম প্রমুখ ইসলামি আচার ও আইন-বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, “তালাক হল সবচাইতে ঘৃণিত বৈধ কাজ।” এ সম্পর্কে বলা হয়েছে “দাসকে মুক্তি দেওয়া যেমন সবচাইতে প্রিয় কাজ, তেমনই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হল সবচাইতে ঘৃণিত কাজ।”— মনছুর (২-২৭৮)। কাদি নুমানের নথিবদ্ধ ঘটনাবৃত্ত থেকে জানা যায় ইমাম হাসানের একাধিক নারী বিয়ে করা ও তালাক দেবার অভ্যাস ছিল। এর জন্য তার বাবা হজরত আলী কুফাবাসীদের নিষেধ করে দেন এই বলে যে তাঁরা যেন ইমাম হাসানের সঙ্গে তাঁদের কন্যাদের বিয়ে না দেন। (Cadi Numan Dadim, 11, Page 979, Fat Law, P. 200)।
তাই পুরুষের দিক থেকে স্ত্রী বর্জনের বিষয়টা হাঁড়ি বাসন বদলের মতো স্বাভাবিক ঘটনার পর্যায়ে পড়ে না। যে কোনও অবস্থায় তিনবার তালাক শব্দ উচ্চারণ করলেই তালাক হয়ে যায় না। এমনটা চলতে থাকলে ইসলামেরই অবমাননা করা হয়। মুসলমান মানবিক দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়। ধর্ম, ঈশ্বর, অলৌকিকতা ইত্যাদি বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বীকার করা এক জিনিস। কিন্তু ধর্মের নামে বিকৃত চিন্তা ও অভ্যাসের দাসত্বকে প্রাধান্য দেওয়াটা যে মারাত্মক অপরাধ তা কি অস্বীকার করা যায়?
ইরানের কেউ কেউ নাকি ‘মুতা’ বিয়ের সমর্থক। মুতা শব্দের আভিধানিক অর্থ হল আনন্দ বা Pleasure (ফয়জির বই— Outline of Muhammadan Law, P. 117)। মানুষের ইতিহাসে বিবাহ ব্যবস্থার উদ্ভব কি শুধু আনন্দ-ফূর্তির জন্য? আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থার অবাধ যৌনতার পর্ব অতিক্রম করে এক পতি-পত্নী ব্যবস্থার উদ্ভব হয় কীসের ভিত্তিতে? সম্পত্তি-সম্পর্ক ও উত্তরাধিকার নির্ধারণের প্রশ্ন বাদ দিয়ে? আর আনন্দ কি কখনও জ্ঞান ও শুভচিন্তা নিরপেক্ষ ব্যাপার? অন্তত ভারতীয় দর্শন তো কখনওই তা বলে না। বিবাহ নামক ঘটনার সঙ্গে মনুষ্য প্রজন্মের পরম্পরাগত বিকাশভাবনা, সম্পত্তি-সম্পর্ক, শৃঙ্খলা ও সংসার ইত্যাদি বিষয়গুলো জড়িয়ে আছে।
এ কারণেই একাধিক বিয়ের ব্যাপারটাও সুশীল সমাজ কখনওই অনুমোদন করে না। ইসলামেও বহুবিবাহের ঢালাও অনুমোদন নেই। সপ্তম শতকে খোদ আরব দেশে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের সময় এরকম বদভ্যাস পরিত্যাগের ওপর জোর দেওয়া হয়।
ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে সপ্তম শতকে ওহোদের যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান নিহত হন। সে যুদ্ধ হয় ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে। যুদ্ধে নিহত মুসলমানদের সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব নেবে কে— এই প্রশ্নেই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেই অনাথ শিশুদের মায়েদের মধ্যে এক, দুই, তিন বা চার জনকে বিয়ে করার বিষয়টা উঠে আসে। তাই বলে স্বাভাবিক অবস্থাতে চার স্ত্রী নিয়ে জীবনযাপন করার কথা কোরানের কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যায়?
এ বিষয়টা কোরানের চতুর্থ অধ্যায় ‘নিসা’তে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে দ্বিতীয় অংশের মধ্যে। সেখানে আছে:
অনাথদের সম্পত্তি অনাথদেরই দিয়ে দাও। আর উৎকৃষ্ট বস্তুর বদলে নিকৃষ্ট বস্তু দিও না, কিংবা তোমাদের সম্পত্তির মধ্যে তাদের সম্পত্তি গ্রাস করে নিও না। সেটা হবে ভয়ানক দোষণীয়।
এভাবে সমস্যার সুবিচার দুরূহ হয়ে উঠতে পারে ভেবে ‘নিসা’র দ্বিতীয় অংশের ঠিক পরের অংশেই অন্য পরামর্শ ব্যক্ত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে:
আর যদি আশঙ্কা করো যে, অনাথদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা করতে পারবে না, তাহলে সেই অনাথদের মায়েদের মধ্যে তাদের বিয়ে করে নাও যাদের তোমার পছন্দ হয়— দুজন, তিনজন বা চারজন। কিন্তু যদি আশঙ্কা করো যে তাদের ওপর ন্যায়বিচার করতে পারবে না তবে একজনকেই (বিয়ে করো) অথবা তোমাদের অধীনে আসা দাসীদের। এটাই অধিকতর সঙ্গত যে, তোমরা অবিচার করবে না।
এই অংশের মর্মার্থ কী? একাধিক বিয়েকে এখানে সমর্থন করা হয়েছে? বরং একজন পুরুষের পক্ষে একাধিক স্ত্রীর প্রতি ন্যায়বিচার করা সম্ভব নয় মনে করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে নিহত স্বামীদের বিধবা স্ত্রীদের মধ্যে থেকে একজনকেই বেছে নিয়ে বিবাহের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। আর সেটাও তাদের অনাথ সন্তানদের প্রতি যাতে অবিচার না হয় সেই প্রেক্ষিতেই। সুরা ‘নিসা’র এই অংশ সৃষ্টি হয় যুদ্ধকালীন অবস্থাতে।
অথচ সাধারণ স্বাভাবিক অবস্থায় কিছু মুসলমান একাধিক বিয়ের পক্ষে সওয়াল করে থাকে। এরকম সওয়াল একেবারেই কোরান-বিরোধী। আসলে এর পেছনে নারীকে শুধু যৌনতার উপাদান ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বলে ধরে নেওয়ার এক সামন্ততান্ত্রিক মনোভঙ্গি বিদ্যমান।
এক সময়ে জমিদার জোতদাররা খামারে ধান তোলা ও ঝাড়াই-মাড়াইয়ের জন্য পটপট করে গরীব ঘরের একগাদা মেয়ে বিয়ে করে ফেলত। তাদের দিয়ে এভাবে বিনা মজুরিতে কয়েক মাস কাজ করিয়ে নেবার পর ঝটাপট তালাক দিয়ে দিত।
এ নিয়ে বাংলার গ্রামীণ হেঁয়ালিও তৈরি হয়েছে। যেমন— ‘পেটের জ্বালায় বিয়ে করনু, / সামনে এল রোজার মাস।’ রমজানের রোজা মানে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত টানা এক মাস নিরম্বু উপবাস। এভাবেই নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা চলে আসছে এখনও এই আধুনিক যুগেও। নারীর কোনও স্বাধীনতা নেই। স্বাতন্ত্রও নেই। নারীর ওপর পুরুষের এই স্বেচ্ছাচার চলে আসছে বিবাহ-ব্যবস্থার উদ্ভবের সময় থেকেই। সেজন্যই বলা হয়, মনুষ্য সমাজে যখন থেকে এক পতি-পত্নী ব্যবস্থার উদ্ভব হয়, সেই প্রথম স্বাধীন নারী হয়ে যায় ‘ঘরোয়া ঝি’। তখন থেকেই নারীকে শোষণের শুরু। বস্তুত, মনুষ্য প্রজন্মের বিবর্তনের ইতিহাসে নারীই হল প্রথম সামাজিক শোষণের শিকার।
ইসলাম ধর্মে এই নারীকে সেই সপ্তম শতকে অনেকটাই অধিকার দেওয়ার কথা ঘোষিত হয়। দাসী নারীকে মুক্তির কথাও উচ্চারিত হয় ইসলামে। নারীকে সম্পত্তির অধিকারও দেওয়া হয় ইসলামীয় বিধিতে। মহানবীর স্ত্রী আয়েশা যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। মধ্যযুগেও দাস বংশের মেয়ে সুলতানা রিজিয়া তলোয়ার হাতে দেশরক্ষা করেছেন। সে দেশের নাম ভারতবর্ষ।
অথচ সেই দেশেরই মুসলমান ধর্মের নামে বিবাহিত নারীর স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রকে অস্বীকারের ঔদ্ধত্যে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত নয়। তালাকের নামে নারীর ওপর স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যেতে লজ্জাবোধও করে না। এ মুসলমান ঠিক ঠিক না মানে দ্বীন (ধর্ম) না বোঝে দুনিয়াদারি। এ মুসলমান মনে রাখতে চায় না সেই অষ্টম শতকেই মুসলমান চিন্তাবিদরা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন— পৃথিবী চ্যাপ্টা, না গোলাকার! থালার মতো, না বলের মতো! স্পেনের মুসলমান দার্শনিক ইব্ন্ হাজ্ম্-এর তত্ত্বে বলা হয়েছে পৃথিবী থালার মতো ফ্ল্যাট হতে পারে না, তা হলে পৃথিবীর যে কোনও দেশে একই সময়ে একইভাবে সূর্যোদয় দেখা যেত। সাহী-তালাকের ফতোয়া নিয়ে যারা জীবন নির্বাহ করে তারা বুঝতে চায় না আল মামুদি (৯১০-৯৫৭), ইব্ন্ হাজ্ম্ (৯৪৪-১০৬৪), আল গাজ্জালি (১০৫৫-১১১১), ইব্ন্ রুশ্দ্ (১১২৬-১১৯৮) বা আবু আল ফিদা (১২৭৩-১৩৩১)-র মতো দার্শনিক ব্যক্তিত্বের মুক্তচিন্তার ধারাকে। স্বয়ং মহানবী বেঁচে থাকলে এ মুসলমানের দুর্দশা দেখে হয়তো বলে উঠতেন ‘এমন স্থবির মুসলমান লইয়া আমি কী করিব!’
সমাপ্ত