অবিন সেন
পূর্ব প্রকাশিতের পর
পনেরো
দিন দুয়েক পরে প্রবালের বসার ঘরে আলোচনা চলছিল। প্রবাল বসেছিল একদিকের একটা সিঙ্গল সোফায়। উল্টোদিকের লম্বা সোফাটায় বসেছিল তন্ময় সামন্ত আর প্রবীর পাল। তনুকা রান্নার মাসিকে কফি আর নোনতা জাতীয় কিছু বানাবার নির্দেশ দিয়ে এসে প্রবালের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। প্রবালের হাতে একটা ছোট নোটবুক। সেটা উল্টে সে কয়েকটা পাতার উপরে চোখ বুলিয়ে নেয়। তার পরে শুরু করে,
–এই ঘটনাগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন খুনের ঘটনা নয়। এগুলো এক ধরনের স্পেশাল টাইপের সিরিয়াল অফেন্স বা বলা ভালো সিরিয়াল কিলিং-এর ঘটনা। এখন পর্যন্ত আমার তেমনটাই মনে হয়েছে এবং আমি ভুল ভাবছি বলেও আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত। আপনার কী মনে হয় সামন্তবাবু?
সামন্ত তার নোটবইতে কিছু লিখে রাখছিল। মাথা তুলে বলল,
–আগে স্যার আপনি বলে নিন।
প্রবাল একটু মৃদু হাসল। রান্নার মাসি কফি দিয়ে গিয়েছিল। একটা কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে তাতে একটা চুমুক দিয়ে সে শুরু করে,
–এই ঘটনার তদন্ত আমরা কোথা থেকে শুরু করেছিলাম? আমরা শুরু করেছিলাম রাহুল বৈদ্যর খুন আর বিশাখা দত্তর অন্তর্ধানের ঘটনা দিয়ে। তখন মনে হয়েছিল রাহুল খুন হয়েছে আর সেই খুনের সঙ্গে বোধহয় বিশাখা জড়িত। আপনারাও তেমনটাই ভেবেছিলেন? তাই না?
সামন্ত আর প্রবীর দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দেয়। তারা মুখে কিছু বলে না। প্রবাল আরও কয়েক চুমুক কফি খেয়ে তার ব্যাখ্যা শুরু করে।
–কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে আগে বিশাখা দত্তকে অপহরণ করা হয় তারপরে খুন করা হয় রাহুল বৈদ্যকে। কিন্তু কেন? হোয়াট ইজ দ্য মোটিভ? সে বিষয়টা কিন্তু এখনও পরিষ্কার নয় আমার কাছে। এখন যদি ধরে নেওয়া হয় এটা একটা সিরিয়াল কিলিং-এর ঘটনা তাহলে তার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন থাকার কথা। কিন্তু এখানে সেই প্যাটার্নটাও এখনও ক্লিয়ার নয়। তবে প্যাটার্ন নিশ্চয়ই একটা আছে। আর সেই প্যাটার্ন-এর সঙ্গেই খুনের মোটিভও লিঙ্কড হয়ে আছে। তা যদি হয় তবে ফার্স্ট ক্রাইম যেটা, সেটা থেকেই আমাদের তদন্তকে একটা ধারাবাহিক পদ্ধতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখানে ফার্স্ট ক্রাইম কোনটা? প্রথমে মনে হয়েছিল বিশাখা দত্তর খুন বোধহয় ফার্স্ট ক্রাইম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা নয়। অন্তত এখন পর্যন্ত যা আমরা জেনেছি তাতে করে মনে হয় ফার্স্ট ক্রাইম এখানে বছর দেড়েক আগে কালিঘাটের বেশ্যাপল্লীতে জনৈক অরুণ নামক যুবকের খুন হওয়াটা। যদিও তার আগেও ঘটে যাওয়া কোনও ক্রাইম এই ধারাবাহিক খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু সেটা এখনও আমরা জানতে পারিনি। এখন সামন্তবাবু বলুন অরুণের কেসটার বিষয়ে আপনি কী কী জেনেছেন?
তন্ময় সামন্ত টেবিলে রাখা একটা দড়িবাঁধা ফাইল কোলের ওপরে নিয়ে, সেটা খুলতে খুলতে বলল,
–স্যার, অরুণের আসল নাম তারানাথ রানা। জাতে সদগোপ। সাবেক বাড়ি হুগলি জেলার পুড়শুড়া থানার আন্ডারে। তাদের বাড়ির অবস্থা ছিল স্বচ্ছল, পৈতৃক ধানচালের ব্যবসা। তিন ভাইয়ের মধ্যে তারানাথ ছিল ছোট। পুড়শুড়া থানা থেকে যা ইমফর্মেশন পাওয়া গিয়েছে তাতে করে সে ছোট বয়েস থেকেই ছিল বখাটে। গোঁফ উঠতে না উঠতেই সে দু-তিনবার মেয়েঘটিত কেসে জড়িয়েছে। তার বাবা পলিটিকাল প্রভাব খাটিয়ে, টাকা পয়সা দিয়ে সেই সব কেস মিটমাট করেছে। তার পরে সতেরো-আঠারো বছর বয়সেই সে আবার একটা যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়ায়। সেবার তার নাম উঠল পুলিশের খাতায়। কোনওভাবেই আর রেহাই পাচ্ছে না দেখে সে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যায়। এ ব্যাপারে হয়ত পুলিশের উপর পলিটিকাল প্রভাব খাটানো হয়েছিল। ফলে পুলিশও তাকে আর বিশেষ খোঁজার চেষ্টা করেনি। প্রায় সাত আট বছর সে কোথায় ছিল কী করেছে তার কোনও রেকর্ড নেই পুলিশের কাছে।
প্রবাল তাকে থামায়। বলে,
–রেকর্ড নেই বললেই তো হবে না! সম্পূর্ণ অনুসন্ধান করতে হবে। আপনি নোট করে রাখুন, আর কালকে থেকেই এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন।
সামন্ত তার ছোট ডাইরিতে বিষয়টা লিখে নিয়ে আবার শুরু করে,
–টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়ায় একটা অরুণ কর নামে এক তরুণ ছোটখাটো কয়েকটি টেলি সিরিয়ালে অভিনয় করে। এই অরুণ কর ওরফে তারানাথ রানা কিন্তু এখানেও তমালিকা ঘোষ নামে একটি মেয়ের শ্লীলতাহানির কেসে জড়িয়ে পড়ে। এবার আর সে ছাড়া পায় না। মাস তিনেক হাজতবাস করতে হয় তাকে। তমালিকা ছিল সিনেমা লাইনেরই এক প্রভাবশালী ইউনিয়ন নেতার ঘনিষ্ঠ। ফলে টালিগঞ্জ পাড়ায় অরুণ করের কাজ চলে যায়। অভিনয়ের কেরিয়ার খতম হয়ে গেলেও অরুণ কর টালিগঞ্জ পাড়া ছেড়ে চলে যায় না। এই লাইনের কিছু দালালের সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ভিতরে ভিতরে ইউনিয়নের সঙ্গে তার একটা সেটেলমেন্ট হয়। তার চেহারা তখন দারুণ সুন্দর। নিজেকে ঘষেমেজে দারুণ স্মার্ট হয়ে সে আবার ফিল্ডে নামে। অর্থাৎ অভিনয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সুন্দর সুন্দর মেয়েদের সে টালিগঞ্জ পাড়ায় আমদানি করত। সেই সব মেয়েরা প্রথমে দু-চারটে ছোটখাটো টেলিছবি কিংবা অ্যাড ভিডিওতে মুখ দেখাবার সুযোগ পেত। তার পরে তাদেরকে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে হাই-পেড কলগার্ল প্রফেশনে নামানো হত। সাকুল্যে সে প্রায় এগারোজন মেয়ের সর্বনাশ করেছে। এই কাজ করতে করতেই সে ডাইরেক্ট নারীপাচারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়।
সামন্তকে থামিয়ে প্রবীর বলে,
–নারী পাচারের ব্যবসায় নামার আগে সে অঞ্জলি সরখেল নামে এক কলগার্লকে বিয়ে করে। তখন অরুণ করের বয়স পঁচিশ আর অঞ্জলির বয়স বত্রিশ। দু-জনে মিলে কালিঘাট রেডলাইট এলাকায় একটা একতলা বাড়ি ভাড়া নেয়। সেখান থেকেই নারীপাচারের ব্যবসা শুরু করে তারা।
সামন্ত তার কথায় সায় দেয়। প্রবাল বলে,
–অঞ্জলি সরখেল এখন কোথায়?
সামন্ত বলে,
–আমি স্যার আসছি তার কথায়। ফ্লেশ ট্রেডের ব্যবসায় অরুণ করের কাজ ছিল তার নায়কোচিত চেহারা ভাঙিয়ে বিভিন্ন মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফাঁসানো। তাদের ভাষায় ‘মেয়ে তোলা’। কখনও সে সিনেমায় নামাবারও লোভ দেখাত। ‘ফেসবুক’ ইত্যাদি স্যোশাল মিডিয়া এসে যাওয়ায় তার কাজ আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল। মূলত ফেসবুকের মাধ্যমেই সে ‘মেয়ে তুলত’। আস্তে আস্তে তাদের ব্যবসা বাড়ছিল। প্রায় আটজন ছেলে ছিল তাদের দলে। ব্যবসা যখন ডালপালা ছড়াচ্ছে তখনই অরুণ খুন হয়। তার পরে প্রায় পুরো দলটাই ধরা পড়ে একসেপ্ট অঞ্জলি সরখেল। অঞ্জলি স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়। আজও তার কোনও হদিস আমরা করতে পারিনি।
প্রবাল বলে,
–এই লটে কতগুলো মেয়ের সর্বনাশ করেছিল তারা?
প্রবীর উত্তর দেয়,
–প্রায় সাতজন মেয়েকে তারা এই ভাবে প্রস্টিটিউশানে নামিয়েছে বলে আমাদের কাছে ইনফর্মেশন আছে। এর মধ্যে দু-জন মারা গেছে। আর দু-জন কোথায় পাচার হয়ে গিয়েছিল বিহারে, পরে তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। যারা ধরা পড়েছে তাদের জেরা করেও অঞ্জলি বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা যায়নি।
প্রবাল বলল,
–এই সব মেয়েদের ডিটেল জানাটা দরকার। কারণ অরুণ করের হত্যার বীজ কোথায় লুকানো সেটা আমাদের বার করতে হবে। তা আপনাদের পুলিশের তদন্ত কী বলছে? অরুণ করের খুন হয়ে যাবার কারণ কী?
প্রবীর বলল,
–সেই সময় পুলিশের যে তদন্ত হয়ে তাতে রিপোর্টে উল্লেখ ছিল নিজের দলের মধ্যে কোনও বিবাদের জেরে তাকে খুন হতে হয়েছে। আর পুলিশের প্রাইম সাসপেক্ট ছিল তার বউ অঞ্জলি সরখেল। অবশ্য পুলিশ তদন্ত শেষ করেনি। প্রথমে কিছুদিন তদন্ত হয়েছিল তার পরে সব ধামাচাপা পড়ে যায়। কারণ তদন্তের ফলে বেশ্যাপাড়ায় নাকি স্বাভাবিক ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছিল।
প্রবাল একটা সিগারেট ধরায়। বলে,
–অরুণ করের খুনের ধরন বা তাকে ওইভাবে খুন করা হল কেন? সেই নিয়ে আপনাদের কী মতামত?
সামন্ত বলল,
–এই পিছনে দারুণ কোনও আক্রোশ কাজ করেছে বলে মনে হয়।
–শুধু তাই কী? তাকে খুন করা হল শূলে চড়িয়ে। কেন? আসুন তার সেই খুনের দৃশ্যটাকে কল্পনা করা যাক। একটা প্রশ্ন উত্তরের খেলা খেলা যাক।
প্রবীর আর তন্ময় সামন্ত ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
প্রবাল শুরু করল,
–অরুণ কর যেদিন খুন হয় সে দিন কী বার ছিল?
–শনিবার।
–আর কিছু?
–অমাবস্যা। পাশে ছোট একটা ক্লাবে কালীপূজো হয়েছিল খুব বাজি টাজি পুড়িয়ে।
–তারপর?
–অরুণ কর পাশের একটা ঠেকে বসে রাত এগারোটা পর্যন্ত মদ খায়।
–অঞ্জলি কোথায় ছিল?
–অঞ্জলিকে রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ কালীমণ্ডপের কাছে দেখা গিয়েছিল। তার পরে এক পশলা বৃষ্টি আসতে সে চলে গিয়েছিল। তার পরে আর তাকে দেখা যায়নি।
প্রবাল আবার রিপিট করে।
–সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল?
–হ্যাঁ স্যার। প্রায় অনেকক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিল।
–সেদিন অরুণ করের বাড়িটায় কোনও খরিদ্দার ছিল?
–ছিল। সেই কম বয়েসি মেয়েটি ছিল তার ঘরে।
–কতক্ষণ ছিল?
–মেয়েটি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল। কখন সেই খরিদ্দার চলে যায় সেটা সে বলতে পারেনি।
–রুবি পালের ঘরে কেউ ছিল?
–না। তার ঘর তালা দেওয়া ছিল। আর তাকে নেশার ওষুধ দিয়ে বেঁহুশ করিয়ে রাখা ছিল।
–এবার বলুন অরুণ করের মৃত্যুর সময় কখন?
–ডাক্তারের মতে, রাত বারোটা থেকে চারটে।
–অরুণ মদের ঠেক থেকে বের হয়ে সোজা তার ঘরে ফিরে গিয়েছিল না অন্য কোথাও গিয়েছিল?
–প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সোজা বাড়ি গিয়েছিল।
–ওদের বাড়িতে কটা ঘর ছিল?
–পাঁচটা।
–অরুণ করকে কি তার নিজের ঘরে খুন করা হয়?
প্রবীর বলে,
–এখানে একটা খটকা আছে। অরুণ করকে অঞ্জলির ঘরে খুন করা হয়। মানে যে ঘরটায় অঞ্জলি কাস্টমার নিত। খুনি তার সঙ্গে করে শূলটা নিয়ে এসেছিল। তারপরে সে সেটা অঞ্জলির ঘরে রাখা একটা কাঠের চেয়ারের সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে ফিট করে। সেটার উপরে অরুণ করকে চাপিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। এক জন লোকের পক্ষে কি তা সম্ভব?
প্রবাল বলল,
–সম্ভব। ডাক্তারি রিপোর্টে দেখছিলাম, যখন তার চোখ খুবলে নেওয়া হয়েছিল তখনও সে বেঁচে ছিল। এমনকি তার জিভ ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছিল তার বেঁচে থাকাকালীন। খুনির মানসিকতা বুঝতে পারছেন? খুনির মধ্যে বোধহয় তখন এক অসুর ভর করেছিল। এ কোনও দলবাজির ফলে ঘটে যাওয়া খুন নয়। এই খুনি এক সাইকো। ছবিতে দেখলাম ঠিক অরুণ করের মুখোমুখি আর একটা চেয়ার রাখা ছিল। আমার ধারণা খুনি সেই চেয়ারে বসে অরুণের মৃত্যু দেখছিল। আমি যেন মনে মনে দেখতে পাচ্ছি খুনি বসে বসে অরুণ করের বিচার করেছে, তার পরে তাকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। শূলে চড়িয়ে কখন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় জানেন?
প্রবীর আর তন্ময় সামন্ত পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
প্রবাল বলে,
–হিন্দু ধর্মে যে আঠাশ রকমের শাস্তির বিধান আছে তাতে চব্বিশ নম্বরে “শূলপ্রথা”-র উল্লেখ আছে। যারা ছলচাতুরির মধ্যমে নিরীহ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে পরে তাদের হত্যা করে তাদের শূলে চড়াবার বিধান আছে। অরুণ করের হত্যার পদ্ধতির পিছনেই তার হত্যার কারণ লুকিয়ে আছে।
তন্ময় সামন্ত বলল,
–কিন্তু স্যার। এত রিস্ক নিয়ে এত সময় নিয়ে খুনি তার কাজ সারল যেখানে চারপাশে লোক জেগে আছে, হইহল্লা চলছে, তার তো ধরা পড়ে যাবার সম্ভবনা ছিল। অঞ্জলি কি ঘরে ছিল না?
প্রবাল বলল,
–সেইজন্যই তো কালিপুজোর দিনটা বেছে নিয়েছিল সে। আচ্ছা অরুণ করের বাড়ির দরজা পর্যন্ত কি গাড়ি পৌঁছায়?
প্রবীর বলল,
–হ্যাঁ, পৌঁছায়।
–খুনি নিশ্চয়ই গাড়িতে এসেছিল।
–ঠিক স্যার। হলুদ ট্যাক্সি এসেছিল মাঝরাতে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান আছে।
প্রবাল যেন একটা কিছু ভাবছিল। নিজের মনে বলল,
–হলুদ ট্যাক্সি! স্ট্রেঞ্জ!
তারপরে বলল,
–আমার যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে তবে এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডে, খুনির প্রথম শিকার অরুণ কর আর দ্বিতীয় শিকার অঞ্জলি সরখেল।
প্রবীর আর তন্ময় তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
কেউ কোনও কথা বলছিল না। সবাই প্রবালের দিকে তাকিয়ে ছিল। এই অবসরে প্রবালও কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে পরপর কয়েকটা লম্বা টান দেয়। তার এই চেহারাটা তনুকার চেনা। তনুকা জানে প্রবাল এভাবে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকবে। একটা দুটো সিগারেট ওড়াবে কিন্তু কোনও কথাটি বলবে না। তাই সে একবার কিচেনের দিকে গেল। তাদের রান্নার মাসি রান্নাবান্না করে দিয়ে আটটা নাগাদ চলে যায়। ফলে এই সময়ে চা-কফি খাবার ইচ্ছা হলে নিজেদেরই বানিয়ে নিতে হয়। সে ভাবল, প্রবাল গুম হয়ে থাক সেই ফাঁকে সে এক রাউন্ড কফি বানিয়ে নিতে পারবে।
তনুকা কফি বানিয়ে নিয়ে এসে দেখল তন্ময় সামন্ত আর প্রবীর নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে। প্রবাল সেই একইভাবে সিগারেট টেনে চলেছে। তনুকা একটা কফির পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকল। প্রবাল যেন নড়েচড়ে বসল। এক মুহূর্ত তনুকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল তারপরে নিজের মনে বলল,
–ও তুমি!
–হ্যাঁ মশাই। কফিটা খেয়ে নেওয়া হোক। না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
প্রবাল সিগারেটের বাটটা অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে কফির পেয়ালাটা টেনে নেয়। তার পরে সে আবার শুরু করে,
–সামন্তবাবু, এখনও পর্যন্ত তা হলে কটা খুনের ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি?
তন্ময় সামন্ত হিসেব করে বলল,
–রাহুল বৈদ্যর ভাইকে ধরে ছয় জন।
প্রবাল ঘাড় নাড়ল। বলল,
–রোহন বৈদ্যকে এর মধ্যে ফেলার কোনও কারণ আমি দেখছি না। সেটা অন্য কেস বলেই আমার মনে হয়। যদি প্রয়োজন দেখি তা হলে পরে ভাবা যাবে। তা হলে দাঁড়াচ্ছে পাঁচজন। অন্তত এখনও পর্যন্ত আমরা যে ইনফর্মেশন পেয়েছি। এর বেশিও হতে পারে। দু-জন মহিলার লাশ এখনও পর্যন্ত আমরা ট্রেস করতে পারিনি। হয়ত এরকম আরও মহিলা তার শিকার হয়ে থাকতে পারে। কারণ অরুণ করের মৃত্যুর প্রায় সতেরো মাস পরে রাহুল বৈদ্য খুন হয়। এতটা সময় কি খুনি চুপ করে বসেছিল? সিরিয়াল কিলিং-এ এমনটা সাধারণত হয় না। প্রতিটা খুনের পরে খুনির রক্তের নেশা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সুতরাং এক্ষেত্রেও খুনি নিশ্চয়ই চুপ করে বসে ছিল না।
সামন্ত বলল,
–স্যার, খুনির উদ্দেশ্য কী? কিসের দ্বারা সে স্টিমুলেটেড হচ্ছে?
–আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম খুনির উদ্দেশ্য জানতে হলে প্রথমেই আমাদের ভিকটিমের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। কিন্তু সিরিয়াল কিলিং-এর তদন্ত করতে হলে এর সঙ্গে সঙ্গে খুনের পদ্ধতি, খুনের স্থান এবং কারা খুন হচ্ছেন সেই বিষয়েও থরোলি অ্যানালিসিস করতে হবে। যেমন অরুণ করের খুনের বিষয়ে আমরা কী কী জানতে পারছি। অরুণ করের শত্রু কে? তার শত্রুর অভাব ছিল না। যে সব মেয়েদের সে সর্বনাশ করেছে তাদের অত্মীয়পরিজন, বন্ধু ইত্যাদি। তাছাড়া যে অন্ধকার রাস্তায় সে বিচরণ করছিল সে রাস্তায় চারপাশে চোরাগোপ্তা শত্রু।
প্রবাল থামল।
তন্ময় সামন্ত অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেনি। চুপ করে শুনছিল আর তার ছোট ডাইরিতে টুকটাক নোট নিচ্ছিল।
প্রবাল থামতে বলল,
–এখন স্যার আমরা কোনদিক দিয়ে এগোব?
–আপনারা দুজনে দুটো দিকে অনুসন্ধান চালান। সামন্তবাবু আপনি স্টুডিওপাড়ায় অরুণ করের কী কী কানেকশন ছিল সেই নিয়ে তদন্ত করুন আর প্রবীরবাবু আপনি কালিঘাটের রেডলাইট এলাকায় তদন্ত করুন। যে যে মেয়েদের অরুণ করের দলবল পাচার করেছিল বা অন্ধকার পথে নামিয়ে এনেছিল তাদের ডিটেল জোগাড় করুন। আমি সেদিন যে যে তথ্য পাওয়া গেল সেগুলি নিয়ে একটু ভাবি। খুনির একটা প্রোফাইল বানাবার চেষ্টা করি।
প্রবাল একটু থামল। তারপরে বলল,
–এক সপ্তাহ পরে আমরা আবার আজকের মতো বসব।
এরপর আগামী সংখ্যায়