Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্তেবাসী — অষ্টম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

সপ্তম পর্বের পর

আপ ট্রেন চলে যাবার পর শুরু হয় নিরাকার সময়। কেননা কেউ ট্রেন থেকে নামেনি। শেষ হয়ে যাওয়া ট্রেনের লেজটা মিলিয়ে যাবার পর মা অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ, তারপর বাবলুকে পাঠাল স্টেশনে গিয়ে খবর আনতে তার জামাইবাবুর কাছ থেকে। বাবলু ফিরে না আসা পর্যন্ত মা একটাও কথা বলবে না কেননা তার মধ্যে চলছে নিজের ভেতরে যে দুশ্চিন্তাগুলি চলছে তাদের ওজন করা। যে দুশ্চিন্তা সবচেয়ে ওজনে ভারি তাকে সবার প্রথমে রাখা, আর যে দুশ্চিন্তা ওজনে কম, হালকা, কখন যে খসে পড়ে তা নিজেই বুঝে উঠতে না পেরে এক অসহায় মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায় নিজেও জানে না। তখন আমার একমাত্র কাজ ঘড়ির টিকটিক শব্দ গোনা বন্ধ রেখে বোনকে পাহারা দেওয়া যার মধ্যে অবশ্যই আছে ফিডিং বোতলের কৌণিক অবস্থান বজায় রাখা। দুধ যেন কোনওমতে গলায় না আটকে যায়। মা শুধু অবস্থানটি ঠিক করে আমাকে বলেছিল— ও যতই নড়াচড়া করুক তুই স্থির থাকবি।

অবশেষে ডাউন ট্রেন চলে যাবার পর মেসোমশাই বাবলুকে নিয়ে কোয়ার্টারে ফিরে আসে। গম্ভীর মুখচোখ চেয়ে থাকা পুতুলের মতন। দীর্ঘদেহী পুতুলও একসময়ে কথা বলে, “ওরা ফিরছে বাই রোডে।”

বিকল্প রাস্তা যে আছে এখানে পৌঁছাবার জন্য তা জানাই ছিল না। ট্রেনে আসবার সময়ে নজরে ছিল গভীর খাদের দৃশ্য। অতলে তলিয়ে যাবার ভয়ে চোখ বন্ধ করেই ছিলাম। এখন বুঝি এ হচ্ছে সপ্ত পাতালের অন্যতম ভয়।

শেষ পর্যন্ত ছোট্ট বাসে করে সবাই ফেরে, সকলেই এতটা ক্লান্ত যে বাস থেকে নামতে অনেকটা সময় নেয়। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আসাতে বাসের ইঞ্জিনের অনেক ধকল গেছে, তার মধ্যে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়াতে ইঞ্জিন শ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। গতির মধ্যে থাকলে এসব প্রশ্ন উঠতই না। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আবার স্টার্ট করতে হবে কেননা সামনের পথ চড়াই। প্রচুর কালো ধোঁয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এক সময়ে সরেও যায়। বাবলু বারান্দা থেকে চিৎকার করে ওঠে “ওই তো মা!”

বাবলুই জানে এটা দার্জিলিং যাবার শেষ বাস। ঠিকঠাক ছুটতে না পারলে বিপত্তির সম্ভাবনা যে থাকে তা ওর জানা বলেই আবারও বলে— বাস আর স্টপেজে সময় দেবে না, কেবলই দৌড়াবে। কিন্তু কালুদারা নিজেদের চলার প্রতি এতটাই সাবধানী যেন রেল লাইনের পাথরে পা হড়কে না যায়। তার ফলে ধাতব শব্দ উঠে আসছে ক্রমশ। পাথর যে ধাতু নয় তা জানা সত্ত্বেও অজানা একটা ভয়ে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। এরপর আরও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম যখন জানলাম ধাতুর কোনও স্বাদ নেই। কিন্তু এই ধাতুই আমাকে পঁচিশ বছর ধরে দাঁতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে।

এসব অন্য কথা, কেননা সেই সময়টাতে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠবার পদধ্বনি শুনবার জন্য এতটাই উদগ্রীব ছিলাম যে কখন মেজমাসিরা বাড়ির অন্য দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে বুঝতেই পারিনি। বোন এখানে আছে বলেই এই ব্যবস্থা। যাতে করে স্যানেটোরিয়ামের কোনও স্পর্শই যেন না পায় শিশু। শিশুর রক্তে প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনও গড়ে ওঠেনি। ও ঘরে খুউব চাপা স্বরের কথাবার্তার মধ্যে মা দৌড়ে এলেও থমকে দাঁড়ায়। মুখে বলে— তুই একটু সামলা, আমি কাপড়টা বদলে আসি। এ কথা বলা হয় অত্যন্ত চাপা স্বরে। স্বরধ্বনির মধ্যেও যেন থেকে যাচ্ছে রোগের সম্ভাবনা…

কালুদা কিন্তু সটান এ ঘরে ঢুকে বন্দুকটাকে দু ভাঁজ করে টোটা দুটো বের করে নেয়। অর্থাৎ বন্দুক এতক্ষণ লোডেড ছিল। মার সঙ্গে চোখে চোখে কথা হয়ে গেলে কালুদা বলে ওঠে— লক করা ছিল, টেনশনে আনলোড করতে ভুলে গেছি। কান ধরছি, এ ভুল আর কোনও দিন হবে না…

এবারে মা শব্দ না করে হেসে উঠে চলে যায় কিন্তু তার পিছন পিছন যায় কালুদার সংবাদ— রক্ত দিতে হবে ওকে। চলা থামিয়ে— কোন গ্রুপের রক্ত? মা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

–কাল জানা যাবে।

তারপর স্টোভের সাঁই সাঁই শব্দ বাড়িটার চাপা স্বরের কথাবার্তাকে দমিয়ে দেয়।

কিন্তু বেলুদির যে কার রক্তের প্রয়োজন সেটা ঠিক হবে আগামীকাল। ছোটদের যে রক্ত নেওয়া হয় না সে সম্পর্কে বাবলু ওয়াকিবহাল থাকার জন্য ফিসফিসিয়ে ‘তুই আর আমি বাদ’, কিন্তু কিছুটা উচ্চস্বরে যাতে ডলিদির কান পর্যন্ত পৌঁছায়— ‘এবার ছোড়দির পালা’ বলেই ডলিদির মুখের দিকে তাকায়। মুহূর্তে ডলিদি রক্তশূন্য হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মুখের কোনও মেকআপ কাজ করছে না। তখনই কালুদা হেসে ওঠে। “অত চিন্তা করার কী আছে— আমি আছি না!” মা তার সঙ্গে জুড়ে দেয় সে নিজেও আছে।

মেসোমশাই সমস্ত কথাবার্তা চাপিয়ে দেয় আগামীকালের ওপর কেননা বেলুদির রক্তের গ্রুপ জানা নেই, কার সঙ্গে যে মিলবে তারও ঠিক নেই, অতএব অপেক্ষা…

মেজমাসি এমনভাবে বসেছিল যেন দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ফিরে এসে দেখছে জীবনের যে সব সুখস্মৃতি ছিল তা সব ভুলে গেছে। এমনকি প্রথম সন্তান বেলুদির জন্মকথাও। এত সবের মধ্যে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই মা তার দিকে এমনভাবে তাকাল, ‘অত চিন্তার কিছু নেই’ এরকম সান্ত্বনার স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে।

তারপর রাত্রির গভীরতা অবারিত হয়ে মিশে যায় ঘরের ভিতর।

খুউব আবছা মনে আছে, আবছা কেননা আমি নিজেই মুছে ফেলতে চাইছিলাম সেই দৃশ্য: বাড়ির কালীপুজোতে প্রবল ঢাকের শব্দের ভিতর ছাগবলি হয়ে যাওয়ার পর ফিনকি দেওয়া রক্তের স্রোতকে একটি সরার পাত্রে রেখে তার মধ্যে একটি কলা, ফুল-বেলপাতা রেখে দেবীকে নৈবেদ্য দেবার প্রচলন। দেবী যখন পান করতে পারে মানুষ কেন পারবে না? সেই সময়ে বেলুদির সর্বক্ষণের সঙ্গী রামছাগলের মুখটা বারবার ভেসে ওঠে। তাই আমি মস্তিষ্কের অন্তঃস্থলে বুঝে উঠতে পারছিলাম না মানুষের জন্য কি কেবল মানুষেরই রক্তের প্রয়োজন? আমার দৃষ্টিশূন্যতায় কেবলই ধরা পড়ছিল সেই ধন্দ। এই অকপট ধন্দই আমাকে তাড়িত করেছে বাদবাকি সারাটা জীবন। পশুর রক্ত দেবীর প্রয়োজন, তাই মানুষই বিলিব্যবস্থা করে, হিংস্র হয় আর একটা অসম্ভবকে করে তোলে সম্ভব। আবার শেষ পর্যন্ত সমস্যার কোনও মীমাংসা না করেই পৌঁছে যায় জীবনের শুভ্র মেরুতে।

 

সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম শোয়া মাত্রই। কিন্তু একটা স্বপ্ন দেখে অন্ধকারের মধ্যে জেগে উঠি। বোনের জন্য যে বাতিটা সারা রাত্রি জ্বলে থাকে তা বোধহয় নিভে গেছে তেলের অভাবে। মা হয়তো ভুলেই গেছে তেল ভরতে সারাদিনের উৎকণ্ঠায়।

সে স্বপ্নে ছিল বিশাল এক সরা, গভীরতা নিশ্চয়ই অনেক। রক্তে টইটম্বুর সরাতে দেবী জলকেলি করছেন।

জেগে ওঠার পরেও রক্তের জলকেলির রক্ত নড়াচড়ার শব্দ এমনই ছাপ ফেলে যায় আমি যে আবার ঘুমিয়ে পড়ব তার কোনও উপায় ছিল না।

 

আবার আগামী সংখ্যায়