Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সংবাদ ক্ষমতা বিসংবাদ — তৃতীয় বর্ষ, সপ্তম যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর অক্টোবর সংখ্যার মলাট-কাহিনি উপমহাদেশের গণতন্ত্রের হাল-হাকিকত খুঁড়ে দেখতে গিয়ে ও বিষয়ের গভীরতায় হাবুডুবু খেতে খেতে অতৃপ্ত সম্পাদকমণ্ডলীর ইচ্ছে হয়েছিল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভটিকে পরেরবার আরেকটু কাছ থেকে দেখার। সেই ভাবনা অনুযায়ী নভেম্বর সংখ্যার রিজার্ভড বগি-র বিষয় ঠিক করা হল– সংবাদ ক্ষমতা বিসংবাদ, যা আদতে সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকের দায়িত্ব ও ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যেকার মিথষ্ক্রিয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা।

বাংলাভাষায় সাংবাদিকতার ইতিহাস আলোচিত হলে সবচেয়ে প্রথমে যে মানুষটির কথা মনে আসে, তিনি শ্রীযুক্ত হরিনাথ মজুমদার। লালন ফকিরের শিষ্য, সাধক, কবি ও বাউল গানের রচয়িতা ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত কাঙাল হরিনাথের আরেকটি বড় পরিচয় তিনি বাংলায় সাংবাদিকতার আদিপুরুষদের একজন। ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুষ্ঠিয়া জেলার কুমারখালি গ্রাম থেকে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন হরিনাথ। এই পত্রিকার মাধ্যমে অত্যাচারী জমিদার (যাদের মধ্যে ঠাকুর পরিবারের জমিদাররাও ছিলেন), নীলকর ও পুলিশ প্রজাপীড়নের কাহিনি মানুষের সামনে তুলে ধরতেন হরিনাথ৷ স্বাভাবিকভাবেই, সেকালের সমাজপতিদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’। হরিনাথকে নানা সময়ে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছিল। প্রথমে ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি কিঞ্চিৎ আনুগত্য থাকলেও পরবর্তীকালে তাদের শ্রেণিচরিত্র হরিনাথের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন তিনি দেখেন নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে করা রায়তের মামলায় বিচারপতিরা খোলাখুলিভাবে নীলকরের পক্ষ নিচ্ছেন, তাদের অপরাধকে লঘু করে দেখছেন। শাসক, নীলকর, জমিদার, সমাজপতিদের কাছে হরিনাথ ঘোর শত্রু প্রতিপন্ন হলেও সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত তাঁকে ও তাঁর পত্রিকাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল।

হরিনাথ মজুমদার সম্পর্কে এতগুলি শব্দ খরচ করার কারণ সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কাজ বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে নির্ভীক সাংবাদিকতার উচ্চ আদর্শ আজ থেকে দেড়শো বছরেরও বেশি আগে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছিল। একইভাবে, এই কাজ করতে গিয়ে হরিনাথকে যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যেসব আক্রমণ সামলাতে হয়েছিল, তা যেন এই ‘আধুনিক’ ‘গণতান্ত্রিক’ ভারত রাষ্ট্রের আচার-ব্যবহারের হুবহু প্রোটোটাইপ। মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি একুশ শতকীয় প্রগতিশীল ধ্যানধারণাগুলি আত্মস্থ করার পরেও দু হাজার উনিশ সালের ভারতীয় সংবাদজগত সামন্তপ্রভু ও তার পদলেহনকারী সংবাদগোষ্ঠীর আন্তঃসম্পর্কের ঝা-চকচকে ডিজিটাল সংস্করণ।

তা বিশ্বের বৃহত্তম ‘ফাংশনাল’ গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের অবস্থানটা এই মুহূর্তে ঠিক কেমন?

সাংবাদিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মঞ্চ, প্যারিসের ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস’ তাদের ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী জানাচ্ছে, সংবাদ মাধ্যমের বাকস্বাধীনতার নিরিখে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪০ তম, ২০১৮-এ একই সূচকে ভারতের স্থান ছিল ১৩৮, অর্থাৎ গতবছরের তুলনায় দু ধাপ হড়কে নেমে গেছি আমরা। আরেকটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা, নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট’ (সিপিজে)-এর সমীক্ষার ফল আরও মর্মান্তিক। এই সংস্থা প্রতি বছর দুনিয়ার ব্যর্থতম দেশগুলিকে বেছে নেয়, যে দেশ তাঁর সাংবাদিকদের হত্যার কিনারা করতে পারে না। এই নিয়ে ভারত দ্বাদশতম বারের জন্য এই কুখ্যাত তালিকায় স্থান পেল। সমীক্ষাটির ফল প্রকাশ হয়েছে মাত্র তিন দিন আগে, ২৯শে অক্টোবর। তালিকায় ভারতের স্থান ১৩তম। সেপ্টেম্বর ২০০৯ থেকে অগাস্ট ২০১৯-এর মধ্যে আমাদের দেশে ১৭ জন সাংবাদিকের হত্যা নথিবদ্ধ হয়েছে, যাদের খুনিদের এখনও ধরা যায়নি বা অপরাধের কিনারা হয়নি। নিহত সাংবাদিকদের তালিকায় গৌরী লঙ্কেশ ও শুজাত বুখারির মতো সাংবাদিকরা রয়েছেন। সবার মৃত্যু ঘটছে বা মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে এমনও নয়। ‘কাশ্মিরিয়ৎ’ সংবাদ পোর্টালের সম্পাদক কাজী শিবলিকে পুলিশ এবছর জুলাই মাসের ২৫ তারিখে তাঁর অফিস থেকে তুলে নিয়ে যায়। অপরাধ– তিনি তাঁর পোর্টালে কাশ্মিরে সেনাবাহিনীর গতিবিধি প্রচার করছিলেন। আগস্ট ৪ অবধি শিবলির পরিবারের লোকজন তাঁর ফোন থেকে মেসেজ পেয়েছেন, আশায় ছিলেন পুলিশ তাঁকে দ্রুত ছেড়ে দেবে, কিন্তু তারপর থেকে তাঁর আর কোনও খোঁজ নেই৷ অবশ্য আর কোনও খোঁজখবর পাওয়ার কথাও ছিল না, কারণ ঠিক তার পরদিন অর্থাৎ আগস্টের পাঁচ তারিখ থেকে কাশ্মিরে কী ঘটল তা আমরা সবাই জানি।

এতক্ষণ আমরা যেসব সাংবাদিকদের কথা আলোচনা করলাম, তাঁরা নিজের কাজ করছিলেন, নিজের পেশাটির সততা ও পবিত্রতা বজায় রাখতে আক্ষরিক অর্থে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, তাই রাষ্ট্র বা ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি তাঁদের সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আশার কথা, এখনও আমাদের দেশে এইসব সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি, তাঁরা এখনও পর্যন্ত নিজের কাজটুকু সততার সঙ্গে করতে চাইছেন। কিন্তু এইসব সংবাদকর্মী ছাড়াও সংবাদজগতের শীর্ষে গেঁড়ে বসেছে একটি গোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে কর্পোরেট পুঁজি ও ক্ষমতাকেন্দ্রগুলির রফা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। এই আঁতাত ভারতীয় মিডিয়ায় নতুন না হলেও এমন দিগন্তপ্রসারী আগে কখনও ছিল না। এই সংবাদমাধ্যমগুলি থেকে এমন কোনও সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে না যা সরকার বা রাষ্ট্রকে কোনওরকম অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। তাঁদেরই একটা অংশকেই আমরা দেখতে পাই আমাদের বৈঠকখানার প্রাইম টাইমে, সাংবাদিকতার নামে গলার রগ ফুলিয়ে যাঁরা ক্ষমতার কাছে নিজেদের আনুগত্য জানায়। চুলোয় যাক সাংবাদিকতার নীতিবোধ!

এবারের মলাটে আমরা দেখতে, দেখাতে চাইছি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মুখোশের আড়ালে থাকা এই মুখটাকে। সেই পর্দা উন্মোচন করেছেন বাংলার অভিজ্ঞ ও বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা। এই সংখ্যায় লিখেছেন শুভাশিস মৈত্র, স্বাতী ভট্টাচার্য, গৌতম সরকার, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত। প্রাসঙ্গিক বোধে প্রকাশ করা হল রমন ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত সাংবাদিক রবীশ কুমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার অনুবাদ এবং নিয়েমান ল্যাবের জোশুয়া বেনটনের একটি লেখার অনুবাদ।

প্রচ্ছদকাহিনি ছাড়াও গল্পপ্রবন্ধগদ্যকবিতা ও অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ নিয়ে সুসজ্জিত আমাদের এই হেমন্ত সংখ্যা। পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দুটি বিষয় উল্লেখনীয়। প্রয়াত হলেন গুরুদাস দাশগুপ্ত। স্মরণ বিভাগে তাঁকে স্মরণ করলেন প্রশান্ত ভট্টাচার্য। এবং স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে আমরা ছাপলাম মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে এবারে সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্ত পেটার হান্‌ট্‌কে-র একটি দীর্ঘকবিতার অংশবিশেষ।

পরিশেষে আরেকবার ফিরে আসি হরিনাথ মজুমদারের জীবনকাহিনিতে। একবার হরিনাথের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বিব্রত ও ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে উত্তমমধ্যম দিতে ভাড়া করা লেঠেলবাহিনী পাঠিয়েছিল বাংলার জমিদারশ্রেণি। খবর পেয়ে নিজের অনুচরদের নিয়ে ছুটে এসেছিলেন স্বয়ং লালন সাঁই, রক্ষা করেছিলেন তাঁর শিষ্যকে। ২০১৯ সালের ভারতবর্ষে লালনের মতো কোনও রক্ষাকবচ নেই এদেশের নির্ভীক সাংবাদিকদের, দেশ থেকে লালনের সমন্বয়ের আদর্শকেই মুছে ফেলতেও মরিয়া একদল মানুষ। অন্ধকার বেশ গাঢ়, তবু ঘরে বসে অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়ার চেয়ে অন্তত একটা প্রদীপ জ্বালানোর চেষ্টা করা যাক। আপনারা কী বলেন?