সমরজিৎ সিংহ
ত্রিপুরায়, এই আন্দোলন, তিপ্রাল্যাণ্ডের দাবি, সন্ত্রাসবাদ বা সেই নয়ের দশকের টালমাটাল সময় নিয়ে, কেউ যদি আলোচনা করতে চায়, তাকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসে।
ব্রিটিশ আমলে রাজন্য শাসিত এই ত্রিপুরার রাজাদের ছিল দ্বৈত পরিচয়। একদিকে, ত্রিপুরার রাজা, স্বাধীন বলা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ, অপরদিকে, ব্রিটিশ অধিকৃত কুমিল্লা বা রৌশনাবাদের জমিদার, কর দিতে হয় ব্রিটিশকে। ভারত যখন স্বাধীন হয়, রাজাদের জমিদারি চলে যায় পূর্বতন পূর্বপাকিস্তানে। পাহাড়ি ত্রিপুরার, স্বভাবতই, আয় কম। তাছাড়া, সে সময়, ছোট ছোট রাজ্যগুলি ক্রমে যোগ দিচ্ছে ভারতের সঙ্গে। ত্রিপুরাও যোগ দিতে বাধ্য হয় পরিস্থিতির চাপে।
পরিস্থিতি বললাম, তখন রাজবাড়ির অন্দরমহলের একাংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
ততদিনে, রাজা মৃত। মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের বিধবা পত্নী, মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী তড়িঘড়ি করে ভারতের সঙ্গে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর, ত্রিপুরা ভারতের এক অঙ্গরাজ্য হিসেবে যোগ দেয়।
এই ইতিহাসের পরিণাম কী হতে পারে, তখনও কারও জানা ছিল না। দেশভাগের ফলে, ওপার বাংলা থেকে, দলে দলে, উদ্বাস্তু আসতে শুরু করে ত্রিপুরায়। মূলত উপজাতি অধ্যুষিত রাজ্য তখন ত্রিপুরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতিরাই। কিন্তু উদ্বাস্তু আগমনের ফলে, ক্রমে তারা হারাতে লাগল তাদের গরিষ্ঠতা। অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে, কংগ্রেসের হাত ছিল, বিশেষ করে তখনকার অবিসংবাদী নেতা, পরে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, শচীন্দ্রলাল সিংহের।
একদিকে, উদ্বাস্তু আগমন, অপরদিকে, রাজ আমল থেকে শুরু করা জনশিক্ষা আন্দোলন, যার নেতৃত্বে ছিলেন সুধন্ব দেববর্মা, দশরথ দেববর্মা, পরে তিনি দশরথ দেব হয়েছিলেন। জনশিক্ষা আন্দোলনকারীরা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। এই জনশিক্ষা আন্দোলন থেকে ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের শুরু। বীরেন্দ্র দত্ত, পরবর্তী কালে, তেভাগা আন্দোলন, পরবর্তীকালে সেখানে চলে যান নৃপেন চক্রবর্তী, এই জনশিক্ষা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গড়ে তোলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিত। সে ইতিহাস। আর এখানেই তিপ্রাল্যাণ্ড আন্দোলনের বীজ পোঁতা হয়েছিল। কংগ্রেস আমলে ওপার বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুরা ক্রমে দখল করে নিতে থাকে উপজাতিদের জমি। বেআইনি দখলের মুখে পড়ে পিছু হটতে থাকে উপজাতিরা। ততদিনে, জনশিক্ষা পরিষদ কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে, নাম হয়েছে গণমুক্তি পরিষদ।
এই গণমুক্তি পরিষদ উপজাতিদের স্বার্থরক্ষা বা উপজাতিদের বিকাশে যে সকল কর্মসূচি নিত, তা ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসিস্ট) অনুমোদন সাপেক্ষ। এটা উপজাতিদের তরুণ প্রজন্ম মেনে নিতে পারেনি।
এই নতুন প্রজন্মের হাত ধরে, সত্তরের দশকে উঠে আসে ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি। উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের ব্যর্থতা ছিল এই নতুন সংগঠনের প্রাণশক্তি। এবং কমিউনিস্ট বিরোধীও। শ্যামাচরণ ত্রিপুরা, নগেন্দ্র জমাতিয়া, রতিমোহন জমাতিয়া এবং আরও অনেক তরুণের নেতৃত্বে উপজাতি যুব সমিতি ত্রিপুরার পাহাড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। সামাজিক সংস্কার, উপজাতিদের বিকাশ প্রাথমিক লক্ষ্য হলেও, উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের হাত থেকে পাহাড়ের আধিপত্য কেড়ে নেওয়া তাদের মূল লক্ষ্য ছিল। ১৯৭৮ সালে, নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ত্রিপুরায়, প্রথম, বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। এই সরকার এসে, দুটি কাজ করে। এক, বেআইনি দখলীকৃত জমি উপজাতিদের ফিরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দুই, রাজ আমলের নিদর্শনগুলি মুছে ফেলতে শুরু করে।
প্রথম সিদ্ধান্তের ফলে, বাঙালিদের বৃহৎ অংশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, ত্রিপুরায়, শরণার্থীরা আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের মধ্যে একটা অংশ থেকে গিয়েছিল ত্রিপুরায়। তাছাড়া, ১৯৭১-এর পরবর্তীকালে প্রচুর অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে, জনসংখ্যার হিসাবে, বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।
বেআইনি দখলীকৃত জমি ফিরিয়ে দেবার এই সিদ্ধান্ত এই উদ্বাস্তু বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়ায়, এটা আগেই বলেছি। এর ফলে, রাতারাতি, আমরা বাঙালি নামে এক দল মাটি পেয়ে যায় রাজ্যে।
উপজাতি যুব সমিতি ১৯৭৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৪টি আসনে জয়লাভ করে, ইতিমধ্যে, সাড়া ফেলে দিয়েছে ত্রিপুরায়। কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন। ৬০ আসনের বিধানসভায় ৫৬টি বামফ্রন্টের, বাকি ৪টি উপজাতি যুব সমিতির। নিশ্চিহ্ন কংগ্রেসের অনেকেই এই আমরা বাঙালি দলের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। এবং জমি প্রত্যার্পণের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে।
এই জটিল সময়ে, ত্রিপুরায়, আর একটি ঘটনা ঘটে। উপজাতি যুব সমিতি উপজাতিদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের দাবিতে লড়াই শুরু করে। নৃপেন চক্রবর্তী, একদিকে আমরা বাঙালি দলের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, অপরদিকে উপজাতি যুব সমিতির ক্রমাগত চাপের সামনে রীতিমত দিশেহারা তখন। তিনি উপজাতি যুব সমিতিকে পালটা চাপে রাখতে আর এক উপজাতি নেতা বিজয় রাংখলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই গোপন বৈঠকে কি কি আলাপ বা সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আজ পর্যন্ত ত্রিপুরার লোক জানে না। ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স বা টিএনভি-র এই নেতা, বিজয় রাংখল, ঐ গোপন বৈঠকের পর গা ঢাকা দেন। পরে, এই টিএনভিই উগ্রপন্থার পথ ধরে বাঙালি খুন, অপহরণের মধ্য দিয়ে। এই প্রথম তারা আওয়াজ তোলে স্বাধীন ত্রিপুরার। কারও কারও মতে, ষাটের দশকে গঠিত সেংক্রাক দলই প্রথম স্বাধীন ত্রিপুরার আওয়াজ তুলেছিল। তা সমর্থনযোগ্য নয়, এই কারণে, সেংক্রাকের বাঙালিনিধন ব্যতীত কোনও রাজনৈতিক দিশা ছিল না।
ইতিমধ্যে ১৯৮০ সালের জুনে জাতি-উপজাতি দাঙ্গা বাঁধে ত্রিপুরায়। তার ক্ষত মিলতে না মিলতে টিএনভির প্রবল প্রতাপ যা ১৯৮৮ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত তীব্র ছিল।
উপজাতিদের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে, নৃপেন চক্রবর্তী গঠন করেছিলেন সংবিধানের সপ্তম তপশীল অনুসারে ত্রিপুরা উপজাতি স্বশাসিত জিলা পরিষদ। উপজাতি যুব সমিতি এতে খুশি হয়নি, কেন না তাদের দাবি ছিল, এই জিলা পরিষদ হবে সংবিধানের ষষ্ঠ তপশীল অনুসারে।
পরবর্তীকালে, জিলা পরিষদ ষষ্ঠ তপশীল অনুসারে হলেও উপজাতিদের একটা অংশ সন্তুষ্ট ছিল না, কেন না, ত্রিপুরার উপজাতিদের প্রকৃত উন্নয়ন সেভাবে হচ্ছিল না।
১৯৮৮ সালে কংগ্রেস উপজাতি যুব সমিতির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করে। টিএনভি আত্মসমর্পণ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে চুক্তির পরিণাম হিসেবে।
জোট সরকারের আমলেই আত্মপ্রকাশ করে আইপিএফটি বা ইণ্ডিয়ান পিপল ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা। বলা হয়, এই আইপিএফটির পেছনে মদত ছিল সিপিএমের। টিএনভির মতো এরাও মূলত অপহরণ খুন ইত্যাদিতে মেতে ওঠে। জোট সরকার ভেঙে গেলে, এরা দলে দলে আত্মসমর্পণ করে রাজ্য সরকারের হাতে। উলটো দিকে, আত্মপ্রকাশ করে আইএনএলএফটি। এই সংগঠনটিই দাবি তোলে উপজাতিদের জন্য স্বাধীন ত্রিপুরার এবং কার্যত স্বশাসিত জিলা পরিষদ থেকে বাঙালিদের হঠাতে শুরু করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে, অপহরণ, খুন প্রভৃতি সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে।
আজ পুনরায় তিপ্রাল্যাণ্ডের দাবি উঠেছে, আন্দোলন শুরু হয়েছে। আর নেতৃত্বে এসেছেন বিজয় রাংখলের সঙ্গী অনন্ত দেববর্মা, এন সি দেববর্মা প্রমুখ। এবার কংগ্রেস নেই, তাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে বিজেপি।
তার চেয়েও উল্লেখজনক ঘটনা হল, এবার এই আন্দোলনকে সমর্থন করছে ত্রিপুরার রাজপরিবার। বিশেষ করে, মহারাজা প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য।