অঞ্জলি দাশ
গতবছরই সম্ভবত অক্টোবরের কথা। আমি আটলান্টায়। কলকাতায় থাকলে যেমন, তেমনই নবনীতাদির সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন ফোনে কথা হয়। কখনও আমি ফোন করি, কখনও নবনীতাদি। আমি দু’তিনদিন ফোন না করলে নিজেই ফোন করে প্রথমেই খানিক বকাঝকা করেন। তারপর আধ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে নানারকম গল্প হয়। নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়। এখানে এসে কিছু লিখছি কি না জানতে চান। নতুন লেখা শোনাতে হয়।
তেমনি একদিন ওঁর ফোন পেলাম, কোনও ভূমিকা ছাড়াই বললেন, কাল আমেরিকা যাচ্ছি রে। কথাবার্তার ভেতর থেকে কয়েকটা সংলাপ তুলে দিই।
–মজা করছেন?
–সত্যিই যাচ্ছি। চিকিৎসার জন্যে। আমার ক্যানসার হয়েছে।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। কথা বলতে গিয়ে গলার স্বরে হয়তো সামান্য কম্পন। সেটা টের পেয়ে নবনীতাদিসুলভ ধমক— ন্যাকামি করিস না, আমার ক্যানসার হয়েছে বলে আমি তো বিচলিত নই। এতে তোর এত আপসেট হওয়ার কী আছে?
বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম, ক্যানসার?
–তো? আমি তো সারাজীবন হাজার গণ্ডা অসুখকে সঙ্গে নিয়ে ঘর করি। তার মধ্যে নতুন একজন অতিথি এলেন। তাকে বললাম, এসো বোসো।
নভেম্বরে কলকাতায় ফিরে গিয়ে সেই আগের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা নবনীতাদিকেই পেলাম। ক্যান্সার ওঁকে টলাতে পারেনি, পালটাতে পারেনি। তারপর বছরভর যুদ্ধ চলল আসলে ক্যানসারে আর ডাক্তারে। নবনীতাদি যাপন করলেন তাঁর নিজস্ব ইচ্ছে আর সৃজনের পূর্ণ জীবন।
গতবছর চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ আমার বৃষ্টি নিয়ে লেখাটা পড়ে ফোন করে বলেছিলেন ‘খুব সঘন লেখা…’। এবার কী বলবেন?
এ বছর আগস্টের মাঝামাঝি আটলান্টায় আসার আগের দিন দেখা করতে গেলাম, চোখে জল নিয়ে বললেন, এতদিনের জন্যে যাচ্ছিস, বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। তোর সঙ্গে আর কি দেখা হবে? গলার কাছটা ব্যথা করে উঠলেও হেসে বলেছি, হাজার রকম অসুখ নিয়ে তো আপনি ঘর করেন, এ তো আপনার অতিথি, অতিথি তো চিরকাল থাকে না, চলে যায়। চলে যাবে। আপনি আবার আগের মানুষ হয়ে যাবেন।
না এ অতিথি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গেল।
এমন একজন মানুষ, যিনি কলকাতায় বৃষ্টিতে ভিজে আঁচল শুকোতে দেন পৃথিবীর ছাদে। যিনি আজ অক্সিজেনের নল নাকে নিয়ে শুয়ে আছেন তো কাল ছুটে যান মাচুপিচু পাহাড়ের পাশে। তাঁকে হারাবে কে? এমন একজন মানুষ কণায় কণায় ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজেকে প্রতিটি বাঙালির বুকের মধ্যে। জড়িয়ে নিয়েছেন প্রতিটি পাঠককে নিজের হৃদয় থেকে উঠে আসা শব্দবন্ধনে। জড়াতে পারতেন।
মন্ত্রের মতো দুটো কথা বারবার বলতেন, ‘কী পেলাম সেটা ভাবলেই দুঃখ, কী দিলাম সেটা ভাবতে হয়।’ আর বলতেন ‘ঘন অন্ধকারের মধ্যেও এক কণা আলো খুঁজতে হয়। খুঁজলেই পাওয়া যায়।’ এই মুহূর্তে ওঁকে নিয়ে কিছু লেখা সম্ভব না। এখনও তো বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না বাস্তব সত্যিটা। কদিন আগেই ফোনে কথা বলতে বলতে বলছিলেন— তুই আমাকে যত পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিস, আমাকে নিয়ে লেখ। এত তাড়াতাড়ি লিখতে হবে ভাবিনি তো। মনস্থির করতে পারছি না।
তিনি তো নিজের ইচ্ছেশক্তির দর্পে জীবন চালান। এবারও কি নিজের ইচ্ছেতেই বেড়াতে গেলেন? হয়তো তাই। শুধু আমাদের অক্সিজেনটুকু সঙ্গে নিয়ে গেলেন। নাহলে এমন দমবন্ধ লাগছে কেন?
কাল থেকে নেটে কোনও খবর দেখিনি। দেখতে চাইনি। যতদিন এখানে আছি আমি শোনা কথা বিশ্বাস করব না। আমি তো নিজের চোখে দেখিনি চলে যেতে। যতদিন পারি আগলে রাখি সেই ১৬ই আগস্ট দেখে আসা নবনীতাদিকে।
অক্টোবর ৭, ৮, ৯, এই তিনদিন অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা হয়েছে। এবারের সইমেলা নিয়ে পরিকল্পনা, আমার নতুন লেখা কবিতা শুনলেন। বললেন ওঁর ভালোবাসার বারান্দার পরবর্তী বিষয় নিয়ে। কলকাতার সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে ভীষণ বিচলিত ছিলেন। সেসব নিয়েও লেখার কথা ভাবছিলেন। যে মানুষের ভাবনাস্তর এতটা সচেতন, দায়বদ্ধ, তিনি হঠাৎ ফুরিয়ে যাবেন এটা মেনে নেয়া বড় কঠিন। ১৭ই অক্টোবর নিজে পারছিলেন না, অন্তরাকে দিয়ে ভিডিও কল করেছিলেন। বললেন, অনেকদিন তোর সঙ্গে দেখা হয় না। সেই শেষ দেখা। আমি কাঁদছিলাম, বললেন, দূর বোকা আমি তো ঠিক হয়ে যাব। তুই এবার ফিরলে তোকে এয়ারপোর্টে আনতে যাব। কথা রাখলেন না। একটা ছোট সুদৃশ্য খাতা দিয়েছিলেন আসার আগে। ‘…যখন ফিরবি, খাতাটা যেন কবিতায় ভরে ওঠে’— বলেছিলেন।
আমি কেন কথা রাখব!