সৌমিত্র দস্তিদার
সবারই হয়তো এইরকম অনুভূতি হয়। শুধু আমারই হয় এমন ভাবাটা ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে যেমন হচ্ছে। ঠিক এখন বলব না, কাল সন্ধেবেলা থেকেই হচ্ছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎই বেশ খালি খালি লাগছে। প্রিয়জন চলে যাবার পর যেমন হয়। অথচ আমার চেনাজানা লোকজন, আত্মীয়-স্বজনরা তো যেটুকু জানি ভালই আছেন।তবে কি নবনীতা দেবসেনের প্রয়াণ এর কারণ হতে পারে? কী জানি! তবে ফেসবুকে কে ওঁর কতটা ঘনিষ্ঠ তা বোঝানোর জন্য যে লড়াই দেখছি, পাশে বসে কবে কখন ছবি তোলা হয়েছিল তা পোস্ট করার ঢল দেখছি, আর দেখতে দেখতে কুঁকড়ে যাচ্ছি— এই ভেবে যে আমার তো একটা ছবিও নেই নবনীতাদির সঙ্গে। একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ভালবাসাও কীভাবে জাহির করা যায়, মৃত্যুশোকও এই পুঁজির দুনিয়ায় অজান্তেই কেমন বিপণন সামগ্রী হয়ে ওঠে, তা বেঁচে থাকতে নবনীতাদি জানতেন কিনা তা নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা হতে পারে।
অবশ্য পাশাপাশি এটাও ঠিক যাঁরা কাগজে টাগজে, এমনকি ফেসবুকেও লিখছেন, তাঁদের অধিকাংশের সঙ্গেই নবনীতা দেবসেনের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা আমার সঙ্গে কোনওদিনই গড়ে ওঠেনি। ওঁর সঙ্গে ছবি নেই তাই হয়তো কোনওভাবেই দাবি করা যাবে না যে আমিও একটু আধটু চিনতাম বাংলা সাহিত্যের ওই সম্রাজ্ঞীকে। সেই সামান্য সম্পর্কের কারণে যে এভাবে বুকের ভেতরটা কাল থেকে খালি খালি লাগবে তাই বা কে ভেবেছে। কিন্তু লিখতে লিখতে, এখন এই বৃষ্টিভেজা দুপুরে, বিষণ্ণ পরিবেশে মনে পড়ছে যে তখন আমি সবে সবে গুজরাত গণহত্যা নিয়ে একটা কুড়ি মিনিটের ডকুমেন্টারি শেষ করেছি। সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী উদ্যোগ নিলেন ছবিটি সিগাল-এ দেখাতে। ভিড় উপচে পড়েছিল শো শুরুর আগেই। কে নেই সেই ভিড়ে! দিব্যেন্দু পালিত, রবিশঙ্কর বল, রয়েছেন অনিতাদি স্বয়ং। আরও নামী অনামী বহু লোক। একটা সময় ঘর অন্ধকার করে ছবি দেখানো শুরু হল। নিস্তব্ধ হল। পিন পড়লেও বোধহয় শব্দ শোনা যাবে এমন শান্ত পরিবেশ।
মিনিট কয়েক পরে দরজা খোলার ক্যাচকোঁচ শব্দে ইষৎ বিরক্ত দর্শকদের সঙ্গে আমিও ঘাড় ঘোরাতে দেখি নবনীতা দেবসেন ঢুকছেন। আমার স্ত্রী অনেক আগে থেকেই দিদিকে চিনতেন। ও ছুটে গেল দিদিকে বসাতে। উনি বসলেন না। বুঝলাম যে কাউকে সিট থেকে উঠিয়ে নিজে বসার মানসিকতাই ওঁর নেই। আমি সিট ছেড়ে দিলাম। তাও বসলেন না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। ছবি শেষ। একসময় আলো জ্বলে উঠল। যেমন হয়, দর্শকদের সঙ্গে নির্মাতার প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল। ততক্ষণে নিমেষে, যেমন নীরবে এসেছিলেন তেমনি নীরবে কখন যেন নবনীতাদি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
যশোধরা বাগচি ছিলেন নবনীতাদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওই দুজন আর মালিনী ভট্টাচার্য, এই তিনজন কেন জানি না আমার চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর ছিলেন ওই গুজরাত ডকুমেন্টারি ফিল্মটি নিয়ে। ওটা কেউ দেখেনি শুনলে কেমন ছেলেমানুষের মতো বিরক্ত হতেন। ওই বিরক্তির কারণেই আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নবনীতাদির কন্যা অন্তরা দেবসেনের সঙ্গে। কোনও এক সেমিনারে যশোধরাদি হামলে পড়েছিলেন অন্তরার ওপরে। ‘তোরা কি দেশ-দুনিয়ার কোনও খবর রাখিস না!’ সেই ‘অপরাধস্খালন’ করতেই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে অন্তরা আর আমার বেশ ভাব হয়ে যায়। অনেক পরে ও একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল— ‘তোমার ছবিটা দেখিনি শুনে মা-ও কেমন গম্ভীর হয়ে গেছিলেন।’
আরও পরে আমি অন্তরাকে বলেছিলাম নবনীতাদির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হবার অভিজ্ঞতা। হিন্দুস্থান রোডের ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে প্রথম গেছিলাম আমার স্ত্রী বর্ণালীর সঙ্গে। তখনও বর্ণালী আমার স্ত্রী হয়নি। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চতুরঙ্গ পত্রিকায় ছিল। সম্ভবত তাদের হয়েই ইন্টারভিউ করতে বর্ণালী গেছিল নবনীতাদির বাসায়। আমিও নবনীতাদিকে দেখব বলে নাচতে নাচতে পেছন পেছন গেলাম। একটু ভয় ভয় করছিল। সেলিব্রিটি লেখক। হ্যাংলার মতো ঘরে ঢুকেছি বলে কিছু যদি বলেন! কিস্যু বল্লেন না। শুধু বর্ণালী আলাপ করিয়ে দেবার পর দুষ্টু দুষ্টু হেসে আপাদমস্তক দেখতে লাগলেন। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন— আমরা এখন আগডুম বাগডুম বকব। তুমি ওসব ছাইপাঁশ শুনে কী করবে! ওপরের ঘরে যাও। আমার দুই মেয়ে আছে। ওদের সঙ্গে ভাব জমাও। দারুণ সময় কাটবে। এতদিন পরেও সেই দুষ্টু হাসি চোখের সামনে ভাসছে। আমি অবশ্য সাহস করে অথবা বর্ণালী কী ভাববে, এই ভয়ে সে যাত্রায় মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে যাইনি। পরে অন্তরা যখন বন্ধু হয় তখন মাঝেমধ্যেই ও মজা করে খোঁচা মেরেছে— সেদিন যদি সাহস করে দোতলায় উঠতে তবে কত কিছু ঘটে যেতে পারত। এত ভীতু হয়ে কী করে গুজরাত মণিপুরে গিয়ে ছবি করো!
পরে যশোধরা বাগচি জানিয়েছিলেন যে কারও সঙ্গে দেখা হলেই জনে জনে ছবিটির কথা বলতেন নবনীতা দেবসেন। সত্যিকারের ভালো লাগার প্রশংসা সাধারণত উনি আড়ালেই করতেন। তার অনেক পরে যখনই দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, তখনই কোনও না কোনওভাবে গুজরাত জেনোসাইড ছবিটির প্রসঙ্গ এসেছে, নবনীতাদি যে আমার ওই ছবিটির কথা কখনও ভোলেননি, একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে এটা আমার একটা বড় পাওয়া।
নবনীতা দেবসেন এভাবেই আস্তে আস্তে কীভাবে যেন আমার বন্ধুর মা হয়ে গেলেন। সত্যিই পরে দিল্লি থেকে অন্তরা এলেই শুধু ও বাড়ি যেতাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কখনও সখনও নবনীতাদির সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। টুকরো টুকরো কথা। সবসময় খোঁজ নিতেন বর্ণালীর। পিকো এলেই ‘তোমরা আড্ডা মারো’ বলে চলে যেতেন। অন্তরা, পিকো আমাকে ছাড়তে বাড়ির সামনে রাস্তা অবধি এলেই ভালো-বাসা ফলক দেখিয়ে বলতাম যে এমন এক বাসা তোমার, যা বাঙালির ইতিহাসের অঙ্গ। যা নিয়ে ছবি করতে হবে। অন্তরা কিছু বলত না। হ্যাঁ বা না কোনওটাই নয়। আমারও হাজার কাজে এই ছবি বানাবার কথাটা আর সেভাবে মনে পড়েনি। এখন নবনীতাদি চলে যাবার পর নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। পিকো এলে আবার ওই বাড়িতে নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু তখন সেখানে নবনীতাদি থাকবেন না ভেবেই বোধহয় বুকের ভেতর এমন খালি খালি লাগছে।
খালি লাগছে আর একজনের কথা ভেবেও। তার কথা কোনও কাগজে কেউ লেখেনি। কে জানে তার মনের অবস্থা এখন কেমন! ছোট্ট জীবনে এই প্রথম এমন প্রবল শোক। প্রিয়জনের বিদায় নিশ্চিত হতবাক করে দিয়েছে অন্তরার মেয়ে, নবনীতাদির আদরের হীয়ামনকে। ছোটদের ব্যথা কজন আর বুঝতে পারি!