Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এই বহুমাত্রিক সমস্যার দায় নেবে কোন ভারতবর্ষ?

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

স্টাবল বার্নিং। ওয়ারক্রাই। দিল্লি। এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য। দেশের কৃষিব্যবস্থা। এই মুহূর্তে দ্বিধাহীনভাবে দেশের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। অথচ…

কেন এমন ভাষার ব্যবহার? কেন ‘অথচ’? পারস্পরিক ব্লেম গেম, পাসিং দ্য বাকের কথায় পরে আসছি। প্রথমে একটু পরিস্থিতিটা দেখা যাক।

এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স। পার্টিকুলেট ম্যাটার এবং অন্যান্য দূষকের একটি সামগ্রিক পরিমাপের গড় করে শহরের এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স ধার্য করা হয়। এই সূচক অনুযায়ী, তিনশ থেকে চারশ ইন্ডেক্স সংখ্যায় শহরের দূষকের পরিমাপ নির্ণীত হলে, তাকে ‘ভেরি পুওর’ বলা হচ্ছে। তার ওপর? চারশ? ‘সিভিয়ার’। দিল্লি চারশ ছুঁতে চলেছে। স্কুল বন্ধ। এমার্জেন্সি স্বাস্থ্য ইউনিটগুলি বিপর্যয় মোকাবিলায় নেমেছে। দূষণে অসুস্থ সফররত বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। বয়স্ক, শিশু, অন্যান্য রোগে অসুস্থ মানুষেরা গৃহবন্দি। বাধ্য হয়ে বাইরে কার্যরত দিল্লিবাসী। যাদের নিয়মিত আউটডোর ডিউটি? ট্রাফিক সার্জেন্ট? ইনফর্মাল সেক্টর, ম্যানেজমেন্ট, প্রোডাক্ট সেলস, দিনমজুর, অকুপেশনালি হ্যাজার্ডাস এলাকার শ্রমিক কর্মচারীরা? কোথায় যাবেন? উত্তর নেই।

একটু অনুসন্ধানে আসি। SAFAR-এর হিসেব বলছে, দিল্লি দূষণের ৪৫ শতাংশ শেয়ার স্টাবল বার্নিং বা খড় পোড়ানোর। অক্টোবর-নভেম্বরে পার্শ্ববর্তী পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশে ধান কাটার মরশুমের পর জমির ক্রপ রেসিডিউ বা স্টাবল পুড়িয়ে পরের মরশুমের গমের জন্য জমি প্রস্তুত করেন কৃষকেরা। এই স্টাবল বার্নিং কী কী ক্ষতি করে? মাটির স্বাভাবিক পুষ্টিগত ভারসাম্য নষ্ট করে। অণুখাদ্য কমিয়ে দেয়। অর্গানিক ইনপুট কমিয়ে দেয়। এবং, তার সঙ্গে বীভৎস হারে বায়ুদূষণ। হাইড্রোকার্বন, পার্টিকুলেট ম্যাটার, মিথেন। ঠিক এমন একটা সময়ে, যখন দীপাবলি শেষ। বাতাসে হুহু করছে বারুদের গন্ধ। শীত পড়তে শুরু করেছে। প্লুম লেভেল একদম নিচের স্তরে। বায়ু সঞ্চালন ধীর গতিতে। নর্থ ওয়েস্টারলি বাতাস দেশের উত্তর-পশ্চিম রাজ্যগুলি থেকে দক্ষিণ-পূর্বের দিকে এগোচ্ছে। আসছে দিল্লির দিকে। ফলাফল অনুমেয়।

কিন্তু এ তো গেল চিরাচরিত হিসেব। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স? নাসার রিপোর্ট বলছে ২০১৯-এ আগের বছরের তুলনায় স্টাবল বার্নিং পাঁচ শতাংশ বেশি। পাঞ্জাব হরিয়ানার মিলিত হিসেবে ৮২০০-র ওপর কেস স্টাডি ধরা পড়েছে, যা গত বছরের ৭৮০০-র তুলনায় এই পাঁচ শতাংশই বেশি। অবশ্য এর অন্য একটি হিসেব আছে। পাঞ্জাবে এবছর ধান চাষ করা জমি প্রায় দশ লাখ হেক্টর। আগেরবার ঠিক এই সময়, হিসেবটা সাড়ে আট লাখ হেক্টর। অর্থাৎ হেক্টর প্রতি স্টাবল বার্নিং ওই পাঁচ শতাংশ হিসেবে আসছে না। তাহলেও কোনওভাবে ইকুয়ালিটি ইন্ডেক্সে তো আসছে না। সেই তো শেষমেষ, গত বছরের তুলনায় বেশিই…

এবার আসি তৎপরতায়। কী করছে সরকার? কী করছেন কৃষকেরা? স্টাবল বার্নিং-র বিকল্প আছে। কেন নিচ্ছেন না? কী বিকল্প আগে দেখি। খড় না পুড়িয়ে প্রোসেসিং করে অন্য প্রোডাক্টে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। অথবা সিএনজি তৈরিতে এই স্টাবল উপযোগী হতে পারে। বাধা বিস্তর। কীটনাশকের প্রবলতর ব্যবহারে ওই খড় গবাদি পশুকে খাওয়ানো বিষ খাওয়ানোর নামান্তর। কৃষকেরা খড় পোড়ালে সরকার পেনাল্টি নেয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কিন্তু যন্ত্র কিনে ওই খড় প্রোসেসিং করলে তা আপাতত ভাড়া খাটাতেই দু তিন হাজার টাকা। ডিজেলের খরচা। লেবারের খরচা। সব মিলিয়ে হিসেবটা ছয় থেকে সাত হাজার। কেন দেবেন কৃষকেরা? অগত্যা পেনাল্টির কম খরচ। অগত্যা স্টাবল বার্নিং। অগত্যা কালো হয়ে যাওয়া মাঠ, আকাশ, শরীর।

সরকারি হিসেব? কাজ? পাঞ্জাব সরকার বলছে, অক্টোবর অবধি প্রায় আঠাশ হাজার ‘হ্যাপি সিডার’ প্রোসেসিং মেশিন দিয়েছে সরকার। পাঞ্জাব সাবসয়েল ওয়াটার প্রিজার্ভেশন অ্যাক্ট ২০০৯ আইনের মাধ্যমে কৃষকদের স্টাবল বার্নিং-এর মূল কারণ অর্থাৎ সাধারণ ধান চাষে নিরুৎসাহিত করে ক্রমশ অর্থকরী ফসল যেমন ভুট্টা, তুলো, বাসমতী ধান চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পাঞ্জাব সরকারের হিসেব অনুযায়ী আইন বলবৎ হওয়ার পর থেকে ধান চাষের এলাকা কমেছে ৩.৮ লাখ হেক্টর। বাড়ছে জলস্তর। কাজ এগোচ্ছে। অবশ্য সবই কোট আনকোট। আর এখানেই শুরুর সেই ‘অথচ’ শব্দবন্ধের ব্যবহার। আর এখানেই তৎপর মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট।

বিচারপতি অরুণ মিশ্র এবং দীপক গুপ্তর নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ সরাসরি রাজ্যগুলির আধিকারিকদের দায়ী করেছেন। যতটা ‘পাসিং দ্য বাক’ গেমে তৎপর কংগ্রেস-বিজেপি-আপ, ততটা দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে নন। সেপ্টেম্বর থেকে কাজে নেমে আঠাশ হাজার হ্যাপি সিডার সরবরাহ আদৌ কতটা প্রশংসনীয়, সে সম্পর্কেই সন্দিহান কোর্ট। স্টাবল বার্নিং এবং দূষণ বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। অক্টোবরের শুরু থেকেই যার প্রকোপ নামা অত্যন্ত সহজেই অনুমেয় সেখানে সেপ্টেম্বর থেকে কাজে নামা কেন? এতটা দেরির কারণ? দিল্লিতে একের পর এক বহুতল বাড়ি ভাঙা এবং নির্মাণে দিল্লি সরকার দূষণ কমানোর চেয়ে অনেক বেশি সময় দিচ্ছেন বলে সরাসরি মন্তব্য কোর্টের। সব কেন্দ্রের ওপর চাপাবেন না। আপনারা কী করতে পদে আছেন? ধমক কেন্দ্র সরকারকেও। দু লক্ষ কৃষকের স্টাবল বার্নিং নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে অপারগতার কথা বলা হলে তাদের সরকারে বসা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে কোর্ট।

এইসব প্রতিক্রিয়ায় নড়েচড়ে বসা। প্রত্যেক কৃষককে কুইন্টাল প্রতি একশ টাকার আর্থিক অনুদান দিয়ে স্টাবল বার্নিং-এর সস্তা রাস্তা বদলে স্টাবল প্রসেস করার ব্যাপারে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার নভেম্বরের শুরু থেকে পনেরো দিন পুরনো সেই জোড় বিজোড় ট্রাফিক আইন আবার বলব্ৎ করছেন। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, নিয়মিত জল দিয়ে যতটা পারা যায় স্মগ থেকে মুক্তি— এসব চলছে।

ক্যালেন্ডারের নিয়মে হয়ত আবার স্বাভাবিক হবে দিল্লি। যে প্রশ্নগুলো থেকেই যাবে তা হল, সবুজ বিপ্লবের সরাসরি নেক্সাসের কথাগুলো। ধান, গমের ওপর সরকারি আনুকূল্য, যথেচ্ছ সেচব্যবস্থা, যেকোনও অর্থকরী ফসল অথবা অপ্রচলিত শস্য চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকারি অনীহা, ধান গমে যথেচ্ছ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য— আর এসবের পরিণতি স্টাবল বার্নিং। দেখা গেছে ভুট্টার মতো অর্থকরী ফসলের সঙ্গে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিরিখে তুলনা করা হচ্ছে, ২০১৮-১৯ খারিফ মরশুমে একর প্রতি গ্রস রিটার্নে ভুট্টার চেয়ে ১৪০০০ টাকায় এগিয়ে ধান। কেন উৎসাহিত হবেন কৃষক? নিজে নিজে হাতে চাষের বদলে যৌথ চাষে ধান কাটার সময় মাটিতে দুফুটেরও বেশি অবশেষ রেখে দিচ্ছে যন্ত্র। মাটির গোড়া থেকে কাটতে পারছে না। যা হাতে ধান কাটলে হত না কয়েক বছর আগেও। অথচ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে এই যান্ত্রিক হার্ভেস্টার ব্যবহার করতে হচ্ছে কৃষকদের। ওই দুফুট স্টাবল তখন আর খরচের হিসেবে পোড়ানো ছাড়া উপায় থাকছে না তাদের।

সমস্যাটা গভীরে। সমস্যাটা অতীতে। সমস্যাটা অতি আধুনিকীকরণে। সমস্যাটা গড়পড়তা আলসেমিতে। সমস্যাটা দেশের চিরাচরিত ব্লেমগেম রাজনীতিতে। শীত কমলেই দূষণ কমবে। কিছু প্রাণের বিনিময়ে। কিন্তু দেশের কৃষি-অর্থনীতি, সমাজ-অর্থনীতি এবং বিকৃত রাজনীতির ভেতরে যে খড় পুড়ছে, কুয়াশা জমছে অনন্তকাল, তার দায় নেবে কোন সরকার? কোন ভারতবর্ষ?