Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব— প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির পঁচিশ

হিন্দোল ঘোষ দস্তিদার

 

গত বছরের চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হওয়া মাত্রই আমরা, মানে আমি এবং আমার কয়েকজন চলচ্চিত্রপ্রেমী বন্ধু, বলাবলি শুরু করে দিয়েছিলাম যে পরের বছর যখন রজতজয়ন্তী বর্ষ, তখন চমক নিশ্চিত।

চমকের কথায় আসছি পরে। তার আগে এই রজতজয়ন্তী বর্ষে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে যে কয়েকটি কারণে মনে রাখব, সেগুলো একটু বলে নিই।

প্রথমেই যেটা মাথায় আসছে সেটা হল চূড়ান্ত অব্যবস্থা। এটাকে যদি চমক বলে ধরতে চান, ধরুন। ডেলিগেট কার্ডের ফর্ম ফিলআপ করার দিন থেকে অব্যবস্থা। উৎসাহীরা প্রায় ৫ ঘণ্টা লাইন দিয়ে তবে ফর্ম জমা দিতে পেরেছেন। গত ১৬ বছরে আমার এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি। অহরহ সিনেমা প্রদর্শনের সময় এবং সেই সিনেমা, দুটিই বদলে যাচ্ছে। এই ছবি শহরের সর্বত্র। ধরুন, আপনি অনেক খেটেখুটে অফিস থেকে বেরিয়ে বিস্তর ঘুরে বিকেল ৪টের আগেই নজরুল তীর্থে উপস্থিত হলেন আপনার পছন্দের ছবি দেখবেন বলে। ঢুকে দেখলেন সেই ছবি চলছে না। এবার কোথায় যাবেন? আরও খারাপ যেটা সেটা হল, যে ছবিটা শেষপর্যন্ত প্রদর্শিত হল সেটাও আপনি শেষ অবধি দেখতে পারলেন না। কেন? না, যান্ত্রিক গোলযোগ। আপনার ছবি দেখার ইচ্ছেটাই দেখবেন উবে গেছে।

এবার বলব ছবির ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে। আমার মতো অনেকেই আছেন যাঁরা সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল বিভাগটায় পাখির চোখ করে রাখেন। কারণ, এই সেকশনেই কলকাতার অধিকাংশ দর্শকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সেই বছরেই সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে মুক্তি পাওয়া সেরা ছবিগুলোর। এবং সেগুলো গোটা কলকাতা জুড়েই সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে সমানভাবে প্রদর্শিত হত। অদ্ভুতভাবে, এইবারেই গোটা নন্দন চত্বর থেকে এই বিভাগটা আশ্চর্যজনকভাবে উধাও। বিকেন্দ্রীকরণ ভালো, তবে এতটাও নয়।

এরপর আসব ‘রিস্টোরড ক্লাসিকস’এ। এটা দেওয়ার আদৌ কোনও কারণ আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। মানে, শুধুমাত্র সুবর্ণজয়ন্তী পালনের জন্য গুগাবাবা সমেত ৮টা ছবি নিয়ে এরকম একটা বিভাগ বানাতে হবে? গুগাবাবা অনেকেরই বহু সহস্রবার দেখা। অন্য ছবিগুলোর প্রত্যেকটিরই ডিজিটালি রিস্টোরড কপি আমার নিজেরই অনেক আগে দেখা। এইজায়গায় কি অন্য ছবি দেখানো যেত না?

একবার শুধু নন্দনচত্বরেই একগুচ্ছ বাংলাদেশের ছবি প্রদর্শনের কারণ জানতে চাওয়ায় একজন আধিকারিক বলেছিলেন, ‘পাশের দেশ তো। তায় আবার বাংলা ভাষা। এটা তো করতেই হয়।’ এবার আর প্রতিবেশী দেশ নয়, একেবারে খোদ নিজের দেশ। যে দর্শকরা দেশীয় ছবির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন, তাঁরা সম্ভবত এই বিপুল পরিমাণে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের কারণেও বহুলাংশে হতাশ। সাধারণ দর্শক বোঝেন না যে নতুন পরিচালক বা আঞ্চলিক ভাষার পরিচালকদের কী প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ছবি বানাতে হয়। তাঁদের খুব বেশি দোষও দেওয়া যায় না। আমাদের শহরেরই এক প্রতিভাবান তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য যখন তাঁর নতুন ছবির প্রদর্শনের জন্য হল পান না, তখন বুঝতে হবে সমস্যা আসলে অন্যত্র। ভাবনায় গলদ আছে যথেষ্ট। দর্শকরাই তো মূল, তাঁরাই যদি না আসেন তো উৎসব করে লাভ কী! ওই যে আগেই বললাম, অতিবিকেন্দ্রীকরণ ক্ষতিকর।

কিন্তু শত অভিযোগ থাকলেও কিছু প্রাপ্তিযোগ তো থাকেই।

রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগে স্লোভাকিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক দুসান হানাক’এর চলচ্চিত্র এবারের বড় প্রাপ্তি। সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিমুখে দাঁড়িয়ে দুসান হানাক-এর বানানো ছবি এখনকার ডিজিটাল জমানাতেও জোগাড় করে দেখা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। সোভিয়েতের চেকোস্লোভাকিয়া আগ্রাসনের পরের বছরেই মুক্তি পাওয়া ছবি ‘৩২২’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার কিন্তু অনেকটাই।

কম্পিটিটিভ সেকশনটাও এবার খারাপ নয়। হঠাৎ দেখলে টম হ্যাঙ্কস বলে মনে হওয়া চেক পরিচালক ভাক্লাভ মারহোল এর সাদা-কালো ছবি ‘দ্য পেইন্টেড বার্ড’ আমার দেখা এই উৎসবের অন্যতম সেরা ছবি। জার্জি কোজিনস্কি’র নিজের জীবন থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার রসদের ওপর ভিত্তি করে লেখা এবং সেই বইয়ের অনুপ্রেরণায় বানানো এই ছবিতে উদো কির, স্তেলান স্কারসগার্ড-এর মতো অভিনেতারা থাকলেও মনোযোগ কেড়ে নেবে একরত্তি পেতর কোটলার-এর অভিনয়ের সারল্য।

আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভুটানের চলচ্চিত্র শক্ত জমি পেয়েছিল বার্তোলুচ্চির সুযোগ্য ‘ছাত্র’ খ্যান্তসে নরবু-র বানানো ‘ফোরপা’র হাত ধরে। নরবু-র হাত থেকে এবার ব্যাটন নিলেন পাও চয়নিং দোরজি। ‘লুনানা— আ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম’ একটি সাধারণ গল্পের ওপর বানানো এক অসামান্য ছবি। নরবুর আধ্যাত্মিকতা বা দর্শন নয়, বরং ভুটানের গ্রাম্যজীবনের অকৃত্রিম সারল্যের ওপরে ভরসা করেই এই ছবি বানিয়েছেন পরিচালক। প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করেও যে এইরকম একটা ছবি বানানো যায়, এটাই শিক্ষনীয়। যাঁরা ভুটানের ছবি শুনে নাক সিঁটিয়ে ছবিটা দেখেননি, তাঁরা হয়তো পরে নিজেদের সিদ্ধান্তে লজ্জিতই বোধ করবেন।

‘পেইন অ্যান্ড গ্লোরি’ যেন পেদ্রো আলমোদোভার-এর রিইনকার্নেশনের গল্প। এ যেন পরিচালকের নিজের কাছেই নিজের পরিচয় প্রদান। যাঁরা ‘দ্য স্কিন আই লিভ ইন’ দেখার পর পেদ্রোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা অবশ্যই দেখুন ছবিটা, এক নতুন আলমোদোভারকে খুঁজে পাবেন। পেনেলোপে ক্রুজ সাবলীল। আলাদা করে বলতে হয় আন্তোনিও ব্যান্দেরাস-এর কথা। ভদ্রলোক সম্ভবত জীবনের সেরা অভিনয়টা করে ফেললেন।

আরেকজনের নাম না করলেই নয়। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, কেন লোচ। ছবির বাণিজ্যই যেখানে মূল বিষয়, সেখানে আশি বছরের এক বামপন্থী বৃটিশ বুড়ো স্রোতের উল্টোমুখে হেঁটে খেটেখাওয়া মানুষের গল্প নিয়ে ছবি বানিয়েই চলেছেন… এ যেন এক রূপকথা। ‘আই, ড্যানিয়েল ব্লেক’ যাঁদের অসম্ভব ভালো লেগেছে, তাঁরা ‘সরি, উই মিসড ইউ’ দেখে যে ঘোর কাটাতে পারবেন না… এটা একদম নিশ্চিত হয়ে বলে দেওয়া যায়। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই শ্রেণিবৈষম্যের রূপ যে একইরকম ভয়ানক তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমার-আপনার প্রতিবেশী রিকি এবং অ্যাবি-র পরিবার। ভাবতে ভালো লাগে যে সিনেমা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য এখনও বেঁচে আছে।

হিরোকাজু কোরিদা এখন আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছেন। তাঁর বানানো ছবি জাপানি ছবি ‘শপলিফ্টারস’ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে গতবার আলোড়ন তুলেছিল এবং ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’-এ সেরা ছবির সম্মান পাওয়ার পর দর্শকদের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছিল। কোরিদা সেই প্রত্যাশার প্রতি সুবিচার করেছেন ‘দ্য ট্রুথ’-এর মাধ্যমে। ছবির বড় চমক অবশ্যই দুই ফরাসি অভিনেত্রী, ক্যাথরিন দুনোভ এবং জুলিয়েট বিনোচে।

এবারের উৎসবের ফোকাস যেহেতু জার্মানি তাই ফ্রিৎজ ল্যাং, ফোলকার শ্লনডর্ফ, ফ্যাসবিন্দার, হারজগ, আলেকজান্ডার ক্লুজ-এর মতো পরিচালকদের ছবি প্রত্যাশিত ছিলই। বাড়তি পাওনা ফাতি আকিন-এর ‘দ্য গোল্ডেন গ্লাভস’, আন্দ্রেয়া দ্রেসেন-এর ‘গুন্দেরমান’ এবং উলফগ্যাং ফিশার-এর বানানো ‘স্টিকস’-এর মতো ছবিগুলো। এবং ফোকাস জার্মানি হওয়ার সুবাদেই দর্শকরা আবার ‘অচ্ছুৎকন্যা’, ‘সিরাজ’ এবং ‘প্রপঞ্চ পাশ’-এর মতো প্রায় নয় দশক অতিক্রম করা তিনটি ভারতীয় ছবি দেখতে পেলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনেকেই হয়তো জানেন না যে তিনটি ছবিরই পরিচালক একজন জার্মান, ফ্রাঞ্জ আস্টান।

বার্তোলুচ্চির ছবিগুচ্ছও দর্শকদের ভিড় ভালোই টেনেছে, তাতে সন্দেহ নেই। আঞ্চলিক ভাষায় তৈরি হওয়া ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলি দেখতেও দর্শক সমাগম হয়েছে মোটের ওপর ভালোই। দর্শকদের কাছে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে রনি সেনের ছবি ‘ক্যাট স্টিকস’।

মোটামুটি এই। শেষে আর কয়েকটা কথাই বলা বাকি।

একটি চলচ্চিত্র উৎসবের সঠিক আবহ সৃষ্টি করেন তার দর্শক। সেখানে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। ছবি দেখার কিছু পূর্বশর্ত থাকে, সেগুলোই শিক্ষা। কতগুলো ছবি দেখলাম সেটা কিন্তু আমার চলচ্চিত্রপ্রেম প্রমাণ করে না। সুষ্ঠভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ছবি দেখব, হলে ঢুকে ফোন বন্ধ করে রাখব, সিনেমা চলার সময় অপ্রয়োজনীয় কথা বলব না… এগুলোই তো স্বাভাবিক, ব্যাতিক্রম হবেই বা কেন?

ভাবা প্রয়োজন।