প্রবুদ্ধ বাগচী
দমদম বিমানবন্দরের রানওয়ের মতো এই রাজ্যের পাবলিক ডোমেনে একের পর এক ইস্যুর ওঠা আর নামা। তাদের ঘিরে রাজনীতির চাপান-উতোর, তর্ক-বিতর্ক, টিভি চ্যানেলে সান্ধ্য হই-হল্লা। এরই মাঝে একটি সরকারি রিপোর্টের নীরব অবস্থান। অথচ এটা নিয়ে কোনও বাজার-গরম চিৎকার নেই, নেই কোনও রাজনৈতিক চাপান-উতোর, সরকারি দলকে গাল পাড়া, বিধানসভায় টেবিল চাপড়ানো। সম্ভবত এই ইস্যুটা নিয়ে ঠিক তেমন আসর গরম করা যায় না, বা, দল কিংবা সরকার-বিশেষের দিকে সমালোচনার তোপও দাগা যায় না। কিন্তু তথ্যটা আমাদের এই পক্ষে খুব স্বস্তিকর, এমন মোটেও বলা যাবে না। আর, খারাপ বিষয়ের সরকারি তথ্য যেহেতু আরও খারাপের দিকেই আমাদের ভাবনাকে টেনে আনে ফলে পরিসংখ্যান-লব্ধ তথ্য যে বাস্তবের কথা বলে আসলে বোধহয় প্রকৃত বাস্তব তার থেকে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
দুর্ভাবনা-জাগানো তথ্যটা এই যে, সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশেই আত্মহত্যার ঘটনার লেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী, তার মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আমাদের রাজ্য— মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর পরেই! মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটলে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির দিকে খুব সহজে তর্জনী তোলা যায়। কিন্তু ব্যক্তি-মানুষের আত্মহননের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে এইসব যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে আমাদের চারপাশে প্রচুর ভারী ভারী বিষয়ের পর্বত-প্রাকারের এক অনাদৃত কোণে এমন এক বিপজ্জনক পরিসংখ্যান একা আর বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই তথ্য, হয়তো যার সত্যিকার পরিধিটা আরও একটু বড়, তবু তা-নিয়ে তেমন আলোড়ন ওঠে না, তেমন গলা-ফাটানো বিনিময়ও হয় না প্রচারমাধ্যমে বা রাজনীতির বৃহত্তর মঞ্চে— কিন্তু গোপন এক ফল্গু-স্রোতের মতো আত্মঘাতী-মানুষের এই বিপন্নতা পরিসংখ্যানকে শুধু পুষ্ট করে তোলে তাই নয়, ইঙ্গিত করে গভীর এক সমাজসত্যেরও। আমাদের দৈনন্দিনে তবু তার তেমন ছাপ পড়ে না। আসলে তো পরিসংখ্যানের কোনও অবয়ব নেই নিছক কয়েকটি সংখ্যার বিন্যাস ছাড়া!
কী বলা হয়েছে ওই সরকারি রিপোর্টে? প্রথম কথাটা হল, সংখ্যার হিসেবে ২০১৪-এ আত্মহত্যার ঘটনা এই রাজ্যে ঘটেছে ১৪৩১০টি যা ২০১১তে নথিভুক্ত মৃত্যুর থেকে কম হলেও উপেক্ষা করার নয়। দ্বিতীয়ত, সারা দেশের আত্মহত্যায় মৃত্যুর শতাংশের হিসেবে পশ্চিমবাংলার অবস্থান তিন নম্বরে (১০.২%)— অবশ্য ২০১১তে প্রথম স্থান থেকে তা কিছুটা নেমে এসেছে। তিন নম্বর খবরটা আরও খারাপ। আত্মঘাতী মানুষদের বিভিন্ন বয়সের বিভাজন করে দেখলে যুবা বয়সীদের (১৮ থেকে ৩০ বছর) আত্মহত্যার হার সবথেকে বেশি (৩৪.১%)। পরের বয়সের নাগরিকদের (৩০ থেকে ৪৫ বছর) ক্ষেত্রে এই হার ৩২.২.%। অবশ্য এমন ভাবা ঠিক নয় যে এই-প্রবণতা সারা দেশের গড়-প্রবণতা থেকে খুব একটা অন্যরকম। ওই রিপোর্টে সারা দেশের গড়ে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন ৩৬১ জন মানুষ সারা দেশে আত্মহত্যায় মারা যাচ্ছেন, যার মধ্যে ১১৬ জনের বয়স তিরিশ বছরের মধ্যে। রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামের থেকে শহরে আত্মহত্যার হার বেশি, খোদ কলকাতা শহরে সেটা ৪.৭ শতাংশের আশেপাশে। আর এই সব আত্মহত্যার যেসব সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত করা গেছে তার মধ্যে অসুস্থতার প্রকোপে আত্মহত্যা সর্বাধিক, তার পরেই আছে বৈবাহিক সম্পর্কের জটিলতা। কোনও তথ্যই আমাদের স্বস্তি দেয় না।
সত্যি অর্থে ধরতে গেলে, আত্মহত্যার সমস্যাটা একদিক দিয়ে সামাজিক-সমস্যা, আর্থ-সামাজিক বললেও খুব ভুল বলা হয় না। তেমনই এর একটা অন্য দিকও আছে, সেটা একেবারে ব্যক্তিমানুষের মনের গঠনের দিক। জীবনানন্দ তাঁর ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় যাকে চিহ্নিত করেছেন ‘মরিবার সাধ’ এই নামে। মনস্তাত্ত্বিকরা যে এই মানসিক প্রবণতার কথা একদম অস্বীকার করেন, তা নয়। কিন্তু ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতর’ খেলা করা ‘বিপন্ন বিস্ময়’ যেসব মানুষকে ক্লান্ত করতে করতে আত্মহত্যার অভিমুখে ঠেলে দেয়, তেমন মানুষ হয়তো লাখে একটা মিললেও মিলতে পারে, আর তাদের বোধহয় ঠিক সামাজিক সমস্যাটার পরিধির মধ্যেও ধরা যায় না। বরং যখন সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ আত্মঘাতের পরিসংখ্যানকে ক্রমশ স্ফীত করতে থাকে তখন কোথাও তার একটা সামাজিক তাৎপর্য নিয়ে আমাদের ভাবনা বাড়তে থাকে। কারণ সেটা তখন আসলে জনস্বাস্থ্যের সামনে একটা দুশ্চিন্তার প্রাচীর তৈরি করে। এখানে জনস্বাস্থ্য অর্থে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যকেও বুঝতে হবে। আর এই সমস্যাটা তখন তার নিছক ব্যক্তিগত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে হয়ে উঠতে চায় এক জরুরি সামাজিক ইস্যু। এমনকি সমাজ-সংসার নাকে তেল দিয়ে দিবানিদ্রা দিলেও সমস্যাটা ঠিক একই থাকে।
একটা খুব চালু কথা হল, মানুষ নাকি নিজেকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু এই কথার পাশাপাশি এই আত্মহত্যার হিসেবের দিকে তাকালে কেমন যেন গা ছমছম করে, মনে হয় নিজেকে ভালোবাসাই যদি সত্যি হত তাহলে কি এত এত মানুষ নিজেকে চরম কষ্ট দিয়ে মৃত্যুর কিনারায় নিয়ে যেতে পারতেন? ঠিক, এটা সেইসব মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ নয়। কিন্তু তাহলে এমন কিছু নিয়ত ঘটে চলেছে আমাদেরই চারপাশে যার ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের প্রবাহ বার বার কক্ষচ্যুত হতে থাকে। তারও একটা ইঙ্গিত আছে ওই সমীক্ষায়। কোন কোন পরিস্থিতিতে মানুষ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ? যদি মহিলাদের ক্ষেত্রে ধরা যায় তাহলে সর্বভারতীয় হিসেবে প্রায় প্রতি দুটি মৃত্যুর একটির শিকার বিবাহিত গৃহবধূরা যার পেছনে থেকে যায় পণ-প্রথা ও সেই সংক্রান্ত নানা পারিবারিক জটিলতার কারণ। অন্যান্য ক্ষেত্রের দিকে তাকালে এটা একেবারে স্পষ্ট প্রবণতা যে আত্মহত্যার হার পুরুষদের মধ্যেই বেশি। আর এইসব ঘটনার পেছনে দায়ী হয়ে রয়েছে পারিবারিক নানা-ধরনের অশান্তি, শারীরিক অসুস্থতার চাপ সহ্য করতে না-পারা, প্রেমভালোবাসা সংক্রান্ত টানাপোড়েন, চাকরি না-পাওয়ার হতাশা, দারিদ্র, প্রতারণার শিকার হওয়া ইত্যাদি যার প্রতিটির সঙ্গেই কোনও না কোনওভাবে সামাজিক ফ্যাক্টর যুক্ত। একটু কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরীক্ষায় পাশ না-করতে পারার ব্যর্থতা বা ভালো ফল না-হওয়ার খুব চেনা কারণগুলো।
কিন্তু এইসব কারণগুলো যদি ক্রিয়া হয় তাহলে তার মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়া হল এক অকালমৃত্যুর মিছিল যার জন্য এক ভয়ানক ধিক্কার-বোধ উঠে আসা উচিত আমাদের পরিচিত ভাবনা ও চর্চার ভিতর। এই আত্মঘাতী মানুষগুলোর পাশে অন্তত কোনও সহায়-স্বজন জোটেনি যার বা যাদের সঙ্গে তাঁরা তাঁদের মনের দু-চারটে কষ্ট-যন্ত্রণার কথা বিনিময় করতে পারে! এমন কেউ ছিল না যে কাঁধে হাত রেখে বলতে পারে ওই বিষণ্ণ মানুষকে, আমি তোমার পাশে আছি! তোমার সমস্যা আসলে আমারও! বয়সের বিভাজন হিসেবে দেখলে সব বয়সী মানুষরাই ভিড় করে আছেন এই আত্মঘাতের মানচিত্রে। তবে কি একদিক দিয়ে আমরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন একটু একটু করে একা হয়ে যাচ্ছি এই সামাজিক বাস্তবতায়? আর এই একলা মানুষের ঘাড়ের ওপর চেপে বসছে নিষ্ঠুর এক আত্মগত বোবা সমাজ— বান্ধবহীন, স্বজনহীন, নিরাশ্রয় ব্যক্তিমানুষ সেই মারমুখী সমাজের কাছে হেরে যাচ্ছে বারবার। সেই পরাজয় থেকে জমে উঠছে আত্মধ্বংসের আয়োজন! অথচ এই সব কিছুরই পাশে পাশে বেড়ে উঠছে আমাদের জিডিপি, আমাদের বিনিয়োগ-প্লাবন, আমাদের উন্নয়নের মৌতাতী সৌধ। আসলে সেসবও তো একেকটা সংখ্যার বিন্যাসমাত্র, তারও কোনও অবয়ব আছে নাকি?
সমস্ত তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত। তবে কি এক অজানা কারণে ২০১৪-র পরবর্তী এই বিষয়ক কোনও তথ্য তারা এখনও প্রকাশ করেনি, তাই এটিকেই সাম্প্রতিকতম হিসেবে ধরা ছাড়া উপায় নেই।