দেবাশিস্ ভট্টাচার্য
এই লেখাটি তার বর্তমান রূপে প্রকাশিত হয়েছিল ‘নেহাই’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০১৯ সংখ্যায়। সম্প্রতি ‘জি বাংলা’ চ্যানেলে ‘দাদাগিরি’ নামক রিয়ালিটি শো-তে ভূত-প্রেতের আতঙ্ক ছড়ানো কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রচারের প্রেক্ষিতে গত কয়েকদিনে আবারও জোরের সঙ্গে উঠে এসেছে কুসংস্কারবিরোধী আইনের দাবি। ফলে, লেখার চিন্তাসূত্রটি আন্তর্জাল মাধ্যমেও ভাগ করে নেওয়া উচিত বলে মনে হল। এ দায় স্বীকার করেছে ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’ পত্রিকাও, ফলে তার পরিচালকবর্গ ধন্যবাদার্হ। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া জরুরি। কুসংস্কারবিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা বিষয়ক চর্চায় বহু আইনের প্রসঙ্গই আসতে পারে, এবং আসা উচিতও বটে। কিন্তু তার সব কিছু এখানে আলোচিত হয়নি, যেমন চিকিৎসা সংক্রান্ত আইন, সংবাদপত্র প্রকাশের আইন, বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত আইন, বা টিভি সম্প্রচার সংক্রান্ত আইন, ইত্যাদি। রিয়্যালিটি শো-তে কুসংস্কারের প্রচারের প্রেক্ষিতে বিশেষত শেষেরটি খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল, কিন্তু এই অনতিবৃহৎ রচনাটি সেই বিশেষ প্রেক্ষিতে রচিত হয়নি। এখানে আমি প্রশ্নটিকে একটু মোদ্দাভাবে, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে ও সাধারণভাবেই ধরতে চেয়েছিলাম, বিশেষ বিশেষ আইনের খুঁটিনাটিতে খুব বেশি না ঢুকে। তাই, এটিকে আবারও প্রকাশ করার সময়ে টিভি সম্প্রচার সংক্রান্ত আইনের কথা একটু আলোচনা করলে হয়ত বা ভাল হত, কিন্তু সময়ের অভাবে এই মুহূর্তে তা করা গেল না। অদূর ভবিষ্যতে সে চেষ্টা করব, এমন ইচ্ছে রইল।
প্রেক্ষাপট
একটি অসাধারণ ইংরিজি বাক্য আন্তর্জাল-পরিসরে প্রায়শই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, যার বাংলা তর্জমা মোটামুটি এইরকম হতে পারে— ‘ধর্ম হল অজ্ঞ জনসাধারণের কাছে পরমসত্য, জ্ঞানী পণ্ডিতের কাছে মিথ্যা কুসংস্কার, আর শাসকের কাছে শাসনের জবরদস্ত হাতিয়ার।’ আজকের দিনের ভারতের রাষ্ট্র ও রাজনীতির রকমসকম যিনি লক্ষ করেছেন, তাঁকে নিশ্চয়ই কথাটার অর্থ আর বলে বোঝাতে হবে না । গুজব আছে, কথাটা নাকি বলেছিলেন প্রাচীন রোমান আইনজ্ঞ সেনেকা, কিম্বা হয়ত কবি-দার্শনিক লুক্রেশিয়াস, যদিও তাঁরা যে ওটা কোথায় বলেছিলেন সে আর কেউ বলতে পারে না। কেউ কেউ খোঁজখবর করে দেখেছেন, ও রকম একটা বাক্য আসলে আছে অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন-এর ‘দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার’ নামক পৃথুল গ্রন্থে, যদিও সেটা রোমান সমাজের ধর্ম প্রসঙ্গেই বলা। তো, কথাটা যেখান থেকেই আসুক না কেন, ধর্ম বিষয়ে ওর চেয়ে সত্যি কথা বোধহয় খুব কমই আছে। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসিদ্ধির ব্যাপারে ধর্মের কার্যকারিতার কথা প্রাক-খ্রিস্টীয় ভারতের ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতকীয় ইউরোপের রাজনীতিতত্ত্ববিদ মাখিয়াভেল্লির ‘দ্য প্রিন্স’ পর্যন্ত অনেক গ্রন্থেই উচ্চারিত হয়েছে। প্রতারণা, হিংস্রতা, ঘৃণা আর গুরুগম্ভীর মিথ্যাকে সম্বল করে মানুষকে বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্য ধর্মের চেয়ে ভাল হাতিয়ার পাওয়া মুশকিল। যদিও উন্নত দেশগুলোতে ধর্ম আজ নিশ্চিতভাবেই পিছু হঠছে, কিন্তু গরীব দেশগুলোতে ধর্ম আজও জড়িয়ে রয়েছে সমাজ-রাজনীতি-প্রশাসন-সংস্কৃতির অলিতে গলিতে। আমাদের দেশের রাষ্ট্র ও সমাজের জাতীয় স্তরে যখন চলছে আশারাম-রামদেব-রামরহিমের মত ধর্মীয় রাঘব-বোয়ালদের খেলা, তখন শহরে ও গ্রামে বাবাজি-মাতাজি-তান্ত্রিক-ওঝা-গুণিন-জ্যোতিষীদের হাতে প্রতিদিনই লুণ্ঠিত হচ্ছে অসহায় বিশ্বাসী মানুষের সম্পদ, সম্মান ও নিরাপত্তা। খুব বড়সড় অপরাধ না হলে বিশ্বাসী ভক্তরা এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চান না, জানালেও পুলিশ-প্রশাসন এদের প্রশ্রয় দেয়, বা যে সমস্ত বিরল ক্ষেত্রে তারা ব্যবস্থা নিতে চায় সে সব ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রচলিত আইন-ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। ধর্মীয় কুসংস্কার, নিপীড়ন ও প্রতারণার বিরুদ্ধে নতুন আইন তৈরির দাবি ওঠে সেই প্রেক্ষিতেই। এ ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে চেষ্টা করতে করতে ধর্মীয় বুজরুকদের হাতে শেষ পর্যন্ত নিহত হয়ে গেলেন মহারাষ্ট্রের যুক্তিবাদী আন্দোলনের অগ্রণী সংগঠক নরেন্দ্র দাভোলকর। তবে, ২০১৩ সালে নিহত হবার কয়েক মাসের মধ্যেই জনমতের চাপে আইনটিকে অর্ডিন্যান্স হিসেবে পাশ করতে বাধ্য হয় মহারাষ্ট্রের সরকার, পরে ওই রাজ্যের বিধানসভাও তা অনুমোদন করে।
নিষ্ক্রিয়তার কয়েকটি অজুহাত
এই ব্যাপারে নতুন আইন তৈরির দাবিকে প্রায়শই নিরুৎসাহিত করা হয় কয়েকটি প্রশ্ন তুলে। এবং, আশ্চর্যের বিষয়, প্রায়শই এই প্রশ্নগুলো তোলেন এমন মানুষেরা, যাঁরা এ দাবির পেছনের বাস্তব সমস্যাটিকে স্বীকার করেন, বা অন্তত স্বীকার করার ভান করেন। এখানে এরকম প্রশ্নের সবচেয়ে পরিচিত তিনটি নমুনা তুলে ধরে সেগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
প্রথম প্রশ্ন— ‘নতুন আর একটা আইন করে কীই বা ছাই হবে? বে-আইনি কাজকর্ম তো কতই হচ্ছে, দোষীরা ধরা পড়ছে কোথায়? ধর্মীয় রাঘব-বোয়ালরা সব প্রভাবশালী লোক, আইন হলেও কি আদৌ তাদের শাস্তি হবে?’ হ্যাঁ, আইন হলেই যে দোষীরা সব আপনা থেকে জেলে ঢুকে গিয়ে ধর্মীয় প্রতারণা ও নিপীড়ন সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে এমন কোনও সম্ভাবনাই নেই, এটা ঠিক কথা বটে। কিন্তু, সেভাবে ভাবলে তো খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি-জালিয়াতি কোনও কিছুর বিরুদ্ধেই আইনের দরকার নেই, যেহেতু এই প্রত্যেকটা অপরাধই অহরহ ঘটে চলেছে, এবং অপরাধীরা মোটেই সব সময় ধরা পড়ছে না। আসলে, আইনের প্রয়োগ হোক বা না-ই হোক, আইনটি চালু হওয়ার অর্থ হল, রাষ্ট্র অন্তত নীতিগতভাবে স্বীকার করছে যে এ ধরনের কাজগুলো অন্যায়। সেটাই তো সাফল্যের প্রথম ধাপ!
দ্বিতীয় প্রশ্ন— ‘একটা আইন তৈরির চেয়ে মাঠে নেমে জোরদার আন্দোলন কি অনেক বেশি কাজের নয়? আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হলে, এবং সাধারণ মানুষ সচেতন হলে, তবেই তো এ সব কুকর্ম বন্ধ হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হবে!’ হ্যাঁ, আন্দোলন না হলে নিছক একটা আইন সৃষ্টি করে বিশেষ লাভ হবে না, এটা অতি সত্যি কথা। কিন্তু, এই সত্যি কথাটাকে এ ভাবে হাজির করার মধ্যে রয়েছে একটি লুকোনো কুযুক্তি। সেটা হচ্ছে, আইন ও আন্দোলনকে মনে মনে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী বিকল্প ধরে নিয়ে তাদের কার্যকারিতার তুলনা করতে যাওয়া, যেন দুটো একসঙ্গে হতে কোনও ভয়ঙ্কর নিষেধ আছে। আসলে, এরা মোটেই বিকল্প নয়, বরঞ্চ পরিপূরক। ঠিকঠাক আইন হলে আন্দোলনের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট অর্থ ও আকার পাবে, সরকারের ওপর বাড়বে চাপ। আর, উল্টোদিকে, জোরালো আন্দোলন থাকলে আইনটা বইয়ের পাতায় বন্দি হয়ে থাকবে না, তার বাস্তব প্রয়োগ হবে। যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মীরা কাজ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেছেন এ সমস্যার দুটো দিকই। তাঁরা যেমন ইচ্ছুক ও সচেতন পুলিশ অফিসারকে দেখেছেন ধর্মীয় বুজরুকির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্নে জোরালো আইনের অভাব নিয়ে খেদ প্রকাশ করতে, তেমনি দেখেছেন ‘ড্রাগ্স্ অ্যান্ড ম্যাজিক রিমেডিজ অ্যাক্ট ১৯৫৪’ জাতীয় আইনকে ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে বিস্মৃতির অতল থেকে আবার বাস্তব প্রয়োগের জগতে ভেসে উঠতে।
তবে, এর চেয়ে আরেকটু বিবেচনাসাপেক্ষ তৃতীয় ও শেষ প্রশ্নটি। সেটা অনেকটা এইরকম— ‘নতুন আইন আদৌ লাগবে কেন, যখন এই সমস্ত অপরাধীদের প্রচলিত আইনেই শাস্তি দেওয়া সম্ভব?’ বলা দরকার, এ প্রশ্নে কিঞ্চিৎ গোলমাল আছে। এখানে কুসংস্কার-বিরোধী আইনকে পশ্চিমবঙ্গে (বা কেন্দ্রীয়ভাবে) প্রচলিত কোন নির্দিষ্ট আইনটি বা আইনগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে? এরকম তুলনা করার মত আইন আদৌ ছিল নাকি, থাকলে আর নতুন আইনের কথা উঠবে কেন? আর, যদি কেউ এ কথা বলতে চেয়ে থাকেন যে, বর্তমান ভারতীয় দণ্ডবিধি ও অন্যান্য নানা চালু আইন দিয়েই (যেমন ‘ড্রাগ্স্ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ অ্যাক্ট, ১৯৫৪) কাজ চলবে, তাহলে তাঁকে আগে প্রচলিত আইনগুলোর বিষয়ে একটু ভাল করে জেনে নিতে অনুরোধ করব। এ নিয়ে আমি পত্রপত্রিকায় লিখেছি, সভা-সমিতিতে বলেছি, তাছাড়া, ২০১৬ সালে একটি আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-গবেষকদের সভাতেও এক সংক্ষিপ্ত লিখিত প্রস্তাব দিয়ে এসেছি। এই সব লেখা ও প্রস্তাব কেউ চাইলেই পেতে পারেন। এখানে আমার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করব। তবে, এই প্রশ্নটির জবাব অল্প দু-কথায় হবে না, একটু বিস্তারে যেতে হবে। আর তারও আগে জানতে হবে, ওই ধরনের কী কী আইনের অস্তিত্ব ইতিমধ্যেই আছে।
চালু আইনে সমস্যাটা কোথায়
প্রচলিত আইনে ধর্মীয় বা কুসংস্কারভিত্তিক অপরাধের বিরুদ্ধে হাতিয়ার একেবারেই নেই এমন নয়, যদিও তা হাতেগোনা, এবং যেটুকু আছে তার সীমাবদ্ধতাও খুবই প্রকট। মুশকিল হচ্ছে, এই আইনগুলো বানানো হয়েছে সাধারণ অপরাধের কথা মাথায় রেখেই, ফলে কোনও বিশেষ ধর্মীয় বা কুসংস্কারভিত্তিক অপরাধের বিরুদ্ধে সেগুলোকে প্রয়োগ করতে গেলে সেই বিশেষ অপরাধের ক্ষেত্রে এই সাধারণ আইনগুলো ভাঙা হয়েছে কিনা সেটা দেখতে হয়। যেমন, খুন, ধর্ষণ ও আর্থিক-প্রতারণা হল প্রচলিত আইনের (এক্ষেত্রে ভারতীয় দণ্ডবিধি বা ‘আইপিসি’) যথাক্রমে ৩০২, ৩৭৬ ও ৪২০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন, কোনও একটি বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধী যদি এগুলো করে থাকে, তো তাকে এইসব ধারায় অভিযুক্ত করা যাবে। কিন্তু, সব সময় ব্যাপারটা অত সহজ হয় না। চালু আইনে ধর্ম বা কুসংস্কার সংক্রান্ত অত্যাচার বা প্রতারণা— এসব নিয়ে কোনও কথাই নেই, সাধারণভাবে অত্যাচার বা প্রতারণা সংক্রান্ত ধারা আছে। একে তো এইসব ক্ষেত্রে পুলিশ কিছু করতেই চায় না, আর তার ওপর যদি বা কোনও সচেতন পুলিশ অফিসার ব্যবস্থা নিতে আগ্রহীও হন, তো তাঁকে ওইসব ধারায় কীভাবে কেসটাকে ফেলতে হবে সে নিয়ে অনেক ফিকির বার করতে হয়। যেমন, ওঝা যদি ভূত ঝাড়ায়, তো তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে পুলিশকে দেখতে হবে যে সে টাকা নিয়েছিল কিনা (সে ক্ষেত্রে ৪২০ ধারা চলবে) বা মারধোর করেছে কিনা (সেক্ষেত্রে হয়ত ৩২৩ ধারা দেওয়া যাবে)। কারণ, ‘ভূত ছাড়ানো’ ব্যাপারটাতে তো আর এমনিতে কোনও আইনি বাধা নেই! ফলে, টাকা নেওয়া বা মারধোর সেভাবে প্রমাণ না করা গেলে সেই ওঝা আইনের হাতের বাইরেই থেকে যাবে। প্রচলিত আইনের এই সীমাবদ্ধতার কারণে, এমন আইন চাই যাতে কুসংস্কারমূলক কাজগুলোকেই বিশেষভাবে বে-আইনি হিসেবে সংজ্ঞা দেওয়া হবে, শুধুমাত্র কুসংস্কারের মধ্যে দিয়ে ঘটা সাধারণ অপরাধগুলোকে নয়। মহারাষ্ট্রের যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা নরেন্দ্র দাভোলকর তাঁর নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে যে আইনটি তৈরি করতে সরকারকে বাধ্য করে গেলেন ২০১৩ সালে, সেই আইনটি ঠিক এই কাজটাই করেছে।
কিন্তু শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়। আসলে, মহারাষ্ট্রে যেমন একটিমাত্র কুসংস্কার-বিরোধী আইন পাশ হল (কর্নাটকেও বোধহয় তোড়জোড় চলছে), সেরকম বিশেষ বিশেষ আইন চাই তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য আইনেও যুগোপযোগী সংস্কার চাই, না হলে ভাল কাজ হবে না। প্রতারণা ও ধর্ষণের সংজ্ঞাকে ধর্ম ও কুসংস্কারের ক্ষেত্রে প্রসারিত করা প্রয়োজন, যা করতে গেলে মৌলিক সংস্কার সাধন করতে হবে ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ (সংক্ষেপে আইপিসি) বা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে। তাছাড়া, সংশোধন করা দরকার ধর্মীয় ভাবাবেগ আঘাত সংক্রান্ত আইনগুলোও। আর সংস্কার প্রয়োজন মেডিক্যাল আইনে, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবার জন্য। এ নিয়ে পরে আরেকটু বলা যাবে।
এ ধরনের কিছু নতুন আইন
ওপরে বলেছি, মহারাষ্ট্রে ২০১৩ সালে এরকম একটি আইন হয়েছে, কাছাকাছি আইন বানাবার তোড়জোড় চলছে কর্নাটকেও। এই বাংলাতেও কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের কিছু অগ্রণী কর্মী এ ধরনের একটি আইনের খসড়া পেশ করেছেন এ রাজ্যের আইন কমিশনের কাছে, যদিও তার পরিণতি এখনও আমরা জানি না। এই ধরনের আইনগুলোতে তন্ত্রমন্ত্র তুকতাক ইত্যাদির সাহায্যে কারুকে কিছু সুবিধে করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা ক্ষতির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন সংসর্গ, জড়িবুটি চিকিৎসা এইসব কীর্তিকলাপকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এবং এইসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা থাকছে। তা ছাড়া, এই আইনকে প্রয়োগ করার পরিকাঠামোটি ঠিক কেমন হবে, সে ব্যাপারেও সরকারকে নির্দিষ্ট রূপরেখা দেওয়া থাকে ওই আইনের ভেতরেই।
এছাড়া এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আছে ডাইনি-শিকারের বিরোধী আইন, অর্থাৎ, কোনও ব্যক্তিবিশেষকে এলাকার মাতব্বররা ‘ডাইনি’ বলে ঘোষণা করে তার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছেন ও একঘরে করছেন— এ ধরনের ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে আইন। এ আইনকেও কুসংস্কারবিরোধী আইন বলা যেতে পারে। এ ধরনের আইন ওড়িশা, বিহার, ছত্তিশগড় ও অসমে আছে। আইন-গবেষকরা নাকি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছেও এ ধরনের একটি আইনের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বলে শুনেছি।
কুসংস্কার-বিরোধী আইনের সাংবিধানিক ভিত্তি প্রসঙ্গে
কুসংস্কার ও ধর্মের ভিত্তিতে লোক ঠকানো আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রচলিত আইনগুলো কতটা কী করতে পারে, তার কিছু ইঙ্গিত ওপরে দিয়েছি, এখন আরও কিছু কথা বলা হয়ত বা জরুরি। কিন্তু, সে সব কথায় যাবার আগে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নে একটু ভাবনাচিন্তা করে নেওয়া যাক। আচ্ছা, আমাদের রাষ্ট্র ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ও কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এমন আইন আদৌ বানাতে যাবে কেন? তার জন্য প্রয়োজনীয় দার্শনিক/রাজনৈতিক/প্রশাসনিক ভিত্তিটুকু তৈরি আছে কি? প্রশ্নটাকে আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, আমি চাইছি, কারুকে সাপে কামড়ালে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অ্যান্টি-ভেনম সিরাম দিয়ে আধুনিক চিকিৎসা করা হোক, এবং ওঝা-গুনিন ডেকে তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব করে সময় নষ্ট না করা হোক। তাহলে আমি নিশ্চয়ই দাবি করব, এমন আইন বানানো হোক যাতে সাপে কাটা রুগিকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব ক্রিয়াকলাপ নিষিদ্ধ করা হবে, এবং আইন ভেঙে কেউ এসব করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। এবার ভালো করে ভেবে দেখুন, এরকম দাবির পেছনে আছে এইরকম একটা ধারণা যে, তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব দিয়ে রোগ সারানো যায় না, এবং আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে রোগটা সত্যিই সারানো যায়। আবার, এই ধারণারও পেছনে একটা দার্শনিক অবস্থান আছে— সেটা এই যে, অলৌকিকতা বলে কিছু হয় না, জগৎ চলে বৈজ্ঞানিক কার্যকারণের ভিত্তিতে। এবার ধরুন, রাষ্ট্র ও তার কর্ণধারেরা যদি বিশ্বাস করে যে, অলৌকিকতার অস্তিত্ব আছে, এবং সেইহেতু দৈবী চিকিৎসা ও তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব দিয়ে রোগব্যাধি সারানো সম্ভব, তাহলে তারা কিন্তু কিছুতেই এরকম কোনও আইনের প্রয়োজনীয়তা মানতে চাইবে না। ধর্মীয় রাষ্ট্রে সেটা অনিবার্য, কারণ, সে সব রাষ্ট্রের নিয়মকানুন রচিত হয় ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ বা সে দেশে চালু ধর্মীয় ধ্যানধারণা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে, ঈশ্বর ও অলৌকিকতা যার অপরিহার্য অঙ্গ। কাজেই, এ ধরনের আইন তৈরির জন্য রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় বিন্দুমাত্র পরিসরও যদি থাকতে হয়, তো সে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হলে চলবে না, ‘সেক্যুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে হবে। হ্যাঁ, আমাদের রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই বটে। সংবিধানে ভারত রাষ্ট্রকে ‘সেক্যুলার’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, এবং ‘বৈজ্ঞানিক মেজাজ’ ও ‘জিজ্ঞাসু মন’ তৈরিকে অন্যতম মৌলিক কর্তব্য হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং, আমাদের সংবিধানে কোনও মৌলিক পরিবর্তনের দাবি না করেই কুসংস্কার-বিরোধী আইন প্রণয়নের দাবি তুলতে আমাদের বিশেষ কোনও অসুবিধে নেই।
তবে কিনা, আমাদের এই ধর্মনিরপেক্ষতার দুধটিতে আবার কয়েক ফোঁটা চোনাও আছে, সেটা ভালো করে বুঝে না নিলে এ আইন-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাটা ঠিকঠাক বোঝা যাবে না।
আমাদের দেশের সংবিধান প্রথম থেকে ‘সেক্যুলার’ বলে ঘোষিত হয়নি, ১৯৭৬ সালে এর ‘প্রি-অ্যাম্বল’ বা প্রস্তাবনা অংশকে সংশোধন করে সেখানে এই শব্দটি ঢোকানো হয়, এটি ছিল আমাদের সংবিধানের বিয়াল্লিশতম সংশোধন। এই ‘সেক্যুলারিজ্ম্’ বা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি আমাদের দেশে এসেছে ইউরোপ থেকে, আধুনিক রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের ধারণার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। ‘সেক্যুলার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ঐহিক’ বা ‘পার্থিব’, অর্থাৎ, স্বর্গীয় বা অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার নয়, আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের লৌকিক ব্যাপার-স্যাপার। মানে, স্বর্গ-নরক-ঠাকুর-দেবতা-পাপ-পুণ্য-ভক্তি-পুজো-আর্চা নীতিকথা ধর্মতত্ত্ব এইসব জিনিস নয়। খাওদাওয়া, শরীর-স্বাস্থ্য, বাড়িঘরদোর, রুজি-রোজগারের কাজকর্ম, জমি-জিরেত-সম্পত্তি, টাকাকড়ি, প্রজাশাসন, যুদ্ধবিগ্রহ এইসব। সেই শব্দটাই পরে প্রশাসন ও রাজনীতিতত্ত্বের আঙিনায় এসে গেল, এবং তার মানে দাঁড়াল রাষ্ট্র থেকে ধর্মের বিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ, আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্ম হবে ব্যক্তিগত বিষয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে ধর্মের নাক গলানো হবে নিষিদ্ধ, এবং রাষ্ট্রপোষিত শিক্ষা-ব্যবস্থাও হবে ধর্মের প্রভাবমুক্ত। ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপ এবং তারপর আস্তে আস্তে সমগ্র আধুনিক পৃথিবীই এই পথে এগিয়েছে, যদিও বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শোনা গেছে কিছু উল্টো সুরও। সমস্যা হচ্ছে, ভারতে এসেও এই শব্দটি কিঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠা ও সমীহা পেয়েছে বটে, কিন্তু তার ভেতরকার ধ্যানধারণা কিঞ্চিৎ ঘেঁটে গেছে। এখানে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি সংবিধানে ঢুকেছে, এবং কোনও বিশেষ ধর্মকে ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ বলেও ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু আবার, ধর্মগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কটাও সুস্পষ্টভাবে নির্ণয় করা হয়নি, যদিও আইনগুলো যেভাবে বানানো হয়েছে তার মধ্যে একটা বহুত্ববাদ এবং ‘সব ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা’ গোছের মেজাজ আছে। ফৌজদারি আইনকে সবার জন্যই সমান রাখা হয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের জন্য আলাদা দেওয়ানি আইন আছে। সংবিধানের পঁচিশ নম্বর ধারায় যে কোনও ব্যক্তিকে নিজের বিবেকবুদ্ধি অনুযায়ী যে কোনও ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কারুকে কোনও না কোনও ধর্ম মানতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। সেখানে নাস্তিকতা বা ধর্মহীনতা বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি, আবার তাকে নিষিদ্ধও করা হয়নি। বোঝা যাচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা এখানে দুর্বল ও অপুরুষ্টু, খাঁটি ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এখানে সেভাবে শিকড় গাড়তে পারেনি। এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, এই আধো আধো ধর্মনিরপেক্ষতা অলৌকিকতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কতখানি দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে, এইসবের বিরুদ্ধে আইন তৈরি করবার দাবিকে কতটা পরিসর ছাড়তে পারে, যেখানে ভারতীয় সমাজে ধর্ম ও কুসংস্কারের প্রভাব সমুদ্র-গভীর?
সন্দেহ নেই, এ এক কঠিন প্রশ্ন। এমনিতে আজকের দিনে যে কোনও রাষ্ট্রের আইন অলৌকিকতা-বর্জিত হতে বাধ্য, তা না হলে কোনও অর্থপূর্ণ আইন-ব্যবস্থা তৈরি করাই কঠিন। খুন-জালিয়াতি-চুরি-ডাকাতি এইসবের মধ্যে অলৌকিকতার হস্তক্ষেপ মেনে নিলে তদন্ত বিচার এইসব জিনিসের আর কোনও মানেই থাকবে না, কারুরই কোনও অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না। স্বভাবতই, আমাদের দেশের আইনও অবশ্যই অলৌকিকতা-বর্জিত। কিন্তু, ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলিক ভিত্তিটি নড়বড়ে হওয়ায় পেছনের দরজা দিয়ে অলৌকিকতা আমদানির সুযোগ থেকে যায়, বিশেষত যদি ধর্মীয় কোনও রাঘববোয়াল জড়িত থাকেন। এ ধরনের একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে, যখন কেরলের যুক্তিবাদী আন্দোলনের এক প্রধান পুরুষ বাসব প্রেমানন্দ একটি মামলা করেন প্রভাবশালী ধর্মগুরু ‘সাঁই বাবা’-র বিরুদ্ধে। সকলেই জানেন, এই ‘সাঁই বাবা’ ভক্তদের ‘দর্শন’ দেবার সময়ে নিয়মিত নানা কৌশলে তাঁর পোশাক ও শরীরের মধ্যে লুকোনো জিনিসপত্র বার করে ভক্তদের মধ্যে বিলি করতেন, যাতে ভক্তেরা তাঁর ‘অলৌকিক’ ক্ষমতায় আবিষ্ট হয়ে পড়েন। সাধারণ ভক্তদের জন্য থাকত পবিত্র ছাই বা ‘বিভূতি’, আর প্রভূত ক্ষমতা ও বিত্তের অধিকারী হোমরাচোমরা ভক্তদের জন্য বরাদ্দ ছিল শূন্য থেকে ‘সৃষ্টি’ করা দামি সোনার অলঙ্কার! ‘গোল্ড কন্ট্রোল আইন’ অনুযায়ী সোনার জিনিস বানানো ও ব্যবসার জন্য লাইসেন্স চাই, এবং ‘সাঁই বাবা’-র সে লাইসেন্স মোটেই নেই, কাজেই ওইভাবে সোনার জিনিসের লেনদেন করে তিনি ‘স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন’ ভাঙছেন, এই ছিল বাসব প্রেমানন্দের অভিযোগ। বারবার অভিযোগেও সরকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রেমানন্দ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন, এবং অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট একটি অবাক করা রায়-এর মাধ্যমে সে অভিযোগ খারিজ করে জানায় যে, যেহেতু ‘সাঁই বাবা’ দৈবী ক্ষমতায় শূন্য থেকে স্বর্ণালঙ্কার সৃষ্টি করে (‘মেটিরিয়ালাইজ’) ভক্তদেরকে বিলি করছেন, কাজে কাজেই তাকে সোনার উৎপাদন বা ব্যবসা এইসব বলা যায় না, এবং সেইহেতু তা ‘স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন’-এর আওতাতেও পড়তে পারে না। এইভাবে সেদিন রাজ্যস্তরের একটি ভারতীয় আদালত আইনের ‘টেকনিক্যাল’ যুক্তির আড়ালে অলৌকিকতাকে ঠারেঠোরে মেনে নিয়েছিল।
অলৌকিকতাকে এইভাবে স্বীকার করে নেওয়ার দৃষ্টান্ত হয়ত বা অপেক্ষাকৃত বিরল, যদিও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দেবার ঘটনা আমাদের রাষ্ট্র ও তার কর্ণধারদের কাছে জলভাত, এবং তেমন ঘটনা প্রায় রোজই ঘটছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দলিত ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, শিক্ষাব্যবস্থার ধর্মীয়করণ, প্রায় প্রতিদিনই রাষ্ট্রচালকদের তরফে ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন উক্তি, নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় ঘৃণার ব্যাপক ও অবাধ ব্যবহার— বিগত কয়েক বছরে এইগুলোই হয়ে উঠছে ভারতীয় রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য, এর সমালোচনা ও বিরোধিতাও হচ্ছে প্রবলভাবেই। কিন্তু, এই ধরনের উন্মত্ততার হাওয়া যখন নেমে যায়, সেই অপেক্ষাকৃত ‘সাধারণ’ সময়েও নিঃশব্দে ও নিচুমাত্রায় ধর্মনিরপেক্ষতার জলাঞ্জলি চলতেই থাকে। রাষ্ট্রনেতারা সাড়ম্বরে মন্দিরে পুজো দিয়ে আসছেন, বাবাজি-মাতাজির পায়ে প্রকাশ্যে মাথা ঠেকাচ্ছেন, সাবমেরিন বা মহাকাশযান উদ্বোধনের সময় নারকোল ফাটানো ও সিঁদুর মাখানো চলছে, এইসব খবরে রোজই ভরে থাকে গণমাধ্যম। নিয়মিত ধর্মীয় প্রতারকদের হাতে অসংখ্য মানুষ যে প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন, সে ব্যাপারে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের চোখ বুজে থাকাটাও এ রোগেরই আরেক উপসর্গ।
আমাদের আইন-ব্যবস্থায়, তাহলে, যুক্তিবাদী আইনের দাবি-দাওয়ার জন্য প্রাপ্য পরিসরের হিসেবনিকেশটা শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? নাঃ, তেমন উল্লসিত হওয়ার মত কিছু নিশ্চয়ই নয়, আবার হতাশায় ভেঙে পড়ার মতও কিছু নয়।
পা রাখার পা-দানিটুকু তৈরি আছে। বসার আসনটুকুও নিশ্চয়ই হবে একদিন। হাল ছেড়ো না, বন্ধু!
প্রচলিত আইন-ব্যবস্থা বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ ও আমাদের করণীয়
বর্তমানে যে আইন-ব্যবস্থা চালু আছে, তাতে আইপিসি বা ভারতীয় দণ্ডবিধি ছাড়াও কিছু আইন আছে যারা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বলে গণ্য হতে পারে। ওপরে বলেছিলাম, সে সব আইন নিয়েও একটু বলব, এইবারে সে নিয়ে কথা বলা যাক। প্রথমে ধরা যাক ‘মেডিক্যাল’ বা চিকিৎসা-সংক্রান্ত আইনের কথা। ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, আইনিভাবে নথিভুক্ত একজন চিকিৎসাবিজ্ঞান-স্নাতক ছাড়া আর কেউই কোনও রুগির চিকিৎসা করতে পারেন না। ‘ড্রাগ্স্ অ্যান্ড কসমেটিক্স অ্যাক্ট, ১৯৪৫’ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কতকগুলো গ্রন্থ বা নথিপত্রে উল্লিখিত কিছু ওষুধপত্র ছাড়া আর কোনও কিছুকেই ‘ওষুধ’ বলে বিক্রি বা প্রয়োগ করা যায় না, এবং হাঁপানি, টাক, যৌন-অক্ষমতা ইত্যাদি রোগ সারিয়ে দেবার দাবিও করা যায় না। আর, ‘ড্রাগ্স্ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ (অবজেকশনেব্ল্ অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪’ অনুযায়ী, তন্ত্রমন্ত্র জড়িবুটি এইসব দিয়ে রোগ সারাবার দাবি করে প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন করা যায় না। কাজেই, বোঝা যাচ্ছে যে, এই সব আইনগুলো দিয়ে তন্ত্রমন্ত্র তুকতাক সহযোগে ভুয়ো চিকিৎসা খানিকটা আটকানো সম্ভব। কিন্তু, কুসংস্কার-নির্ভর প্রতারণা রোধে এই সব আইনের সীমাবদ্ধতাও ততোধিক। প্রথমত, এ দিয়ে শুধু চিকিৎসা-সংক্রান্ত বুজরুকিই আটকানো যাবে, অন্য বুজরুকি নয়। কেউ তুকতাক করে মামলা জিতিয়ে দেবে এমন আশ্বাস দিলে এ সব আইন আর প্রাসঙ্গিক থাকবে না। তার ওপর, বুজরুকটি যদি আদালতে এসে বলে, সে মোটেই চিকিৎসা করছিল না, সে শুধু অলৌকিক কোনও শক্তির কাছে রোগীর ভালর জন্য প্রার্থনা করছিল, তাতেও সে সহজেই আইনের হাত এড়িয়ে পালাতে পারবে। আর সর্বোপরি, আমাদের আইন আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা-ব্যবস্থাকেও অনুমোদন দেয় (আয়ুর্বেদ হোমিওপ্যাথি হেকিমি সিদ্ধা ইত্যাদি), কাজেই বিজ্ঞান-অবিজ্ঞানের সীমারেখা সেখানে যারপরনাই পাতলা।
যুক্তিবাদী মানসিকতা প্রসারের পথে আরেকটি বাধা হল ‘ধর্মীয় ভাবাবেগ’ রক্ষাকারী দুই আইন— ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৮ ও ২৯৫এ ধারা। প্রথমটি ব্যক্তি ও দ্বিতীয়টি গোষ্ঠীর ‘ধর্মীয় ভাবাবেগ’ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ ধরনের আইনের একেবারেই দরকার নেই, এমন নয়। ধর্মীয় বিদ্বেষ-ঘৃণা-হিংস্রতার অবাধ প্রচার আটকানোর জন্য এ ধরনের আইনের অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু এই আইনগুলোকে প্রায়শই ব্যবহার করা হচ্ছে মৌলবাদী দেশগুলোতে চালু ‘ব্ল্যাসফেমি’ আইনের কায়দায়, ধর্মের সমালোচনাকে আটকাতে। এই ধরনের অপব্যবহার আটকাবার জন্য এই আইনের ভেতরেই ধর্মের শৈল্পিক, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী সমালোচনার সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন, যে ধরনের সুরক্ষার বন্দোবস্ত রয়েছে অশ্লীলতা-বিরোধী ২৯২ ধারার মধ্যে।
এই আইনগুলোকে সমর্থন জোগানোর জন্য কিছু পরিবর্তন হয়ত প্রয়োজন ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও। যেমন, ধর্মীয় ভয় ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে কোনও মহিলাকে যৌন-সংসর্গে লিপ্ত করানোকে ‘ক্রিমিন্যাল ফোর্স’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন, যাতে এই ধরনের যৌন-সংসর্গ আদালতের কাছে ধর্ষণ বলে সাব্যস্ত হতে পারে।
আর, সেই সঙ্গে আনা উচিত আরও দুয়েকটি বিশেষ আইন, যাতে সুরক্ষিত করা হবে সংবিধান-উল্লিখিত ধর্মনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধকে, সুরক্ষা ও সমর্থন জোগানো হবে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকারদের, বিশেষত মহিলা শিশু ও নিম্নবর্গের মানুষদের।
পরিবর্তন প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রেও। আইন হওয়া উচিত, যাতে প্রথম থেকেই শিশুরা দীক্ষিত হতে পারে বিজ্ঞান ও মানবতার শিক্ষায়, তফাত করতে শেখে সত্যি আর মিথ্যের, ইতিহাস ও পুরাণের।
উপসংহার
দাবি আমাদের অনেক, প্রত্যাশা আর স্বপ্নও তো অনেকই। আর, ঠিক ততটাই কঠোর হচ্ছে আমাদের দেশের বাস্তবতা। এসব দাবি পূরণের থেকে আমরা এখনও বহু দূরে। তবু, দাবিটা তো উঠুক কম সে কম। মানুষ তো অন্তত জানুন, এগুলোও চাইবার ছিল। এটা তো ঠিকই যে, পরাক্রান্ত সব মিথ্যেই একদিন ইতিহাসের কাছে তামাদি হয়ে যায়, “শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি”। পড়ে থাকে, বেঁচে থাকে শুধু সত্যের একান্ত নির্যাসটুকু। এক্ষেত্রেও যে একদিন তাইই হবে তাতে সন্দেহ নেই। এ তো শুধু কিছু ধর্মীয় অপরাধীকে জেলে পোরার ব্যাপার নয়, কিছু নিপীড়িতকে নিছক স্বস্তি ও সুবিচার দেওয়ার প্রশ্নও নয়। এ লড়াই আসলে উৎসারিত হচ্ছে সত্য ও ন্যায়ের জন্য মানুষের চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা থেকে, আমাদের অস্তিত্ব ও ইতিহাসের সেরা অর্জনগুলোর থেকে, আমাদের সংবিধানের সারবস্তুর সেরা অংশটি থেকে।
সঠিক দাবিগুলো কে করছে তাতে কিচ্ছুই যায় আসে না। তার কিছু নিজস্ব নৈর্ব্যক্তিক শক্তি থাকে, জানেন তো?