Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কাশীধামে কেলেঙ্কারি

পবিত্র সরকার

 

এই একটা অদ্ভুত দুর্গন্ধময় ঘটনা ঘটছে বেনারসে হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপক হয়ে নিযুক্ত হয়েছেন এক মুসলমান যুবক, সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতাতেই, তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্র ও অধ্যাপকেরা মাঠে নেমেছে তাঁকে ক্লাসে ঢুকতে দেবে না, সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষক হিসেবে তাঁকে তাঁরা মেনে নেবে না। এই খবর পড়ে আমাদের বমনোদ্রেক হয়। কিন্তু বমনস্পৃহা তো হিংস্র মূর্খতাকে আটকাতে পারে না, পারে না এই অন্ধ বর্বরতাকে শাস্তি দিতে।

পৃথিবীর সব দেশের মতোই ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা তো গণতান্ত্রিক। এখানে, যদি যোগ্যতা থাকে, যে কেউ যে কোনও বিষয়ে পড়তে পারে, যতদূর ইচ্ছা। এতে নারী পুরুষ ভেদ নেই, হিন্দু মুসলমান ভেদ নেই, জাতপাতের ভেদ নেই। অন্তত কাগজে কলমে নেই৷ হ্যাঁ, আগে বামুনদের নির্বোধ বামনাই-এর জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হতে পারেননি, পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী নাকি উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, বিভাগে কোনও মুসলমাব ছাত্র নিলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। তখন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাগজ The Bengalee লিখেছিল, The pundits should be thrown into the Ganges. কিন্তু সামশ্রমীর হুমকি উপাচার্য উপেক্ষা করতে পারেননি, শহীদুল্লাকে নতুন তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি করেছিলেন। তিনি সেই বিভাগের জন্য প্রচুর গর্ব অর্জন করেছিলেন, আজও পর্যন্ত এই বিভাগ তাকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। এই রকম আর-একটা ঘটনা ঘটেছিল অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে। তিনি ঘরে ঢুকে ক্লাসে বসতে পারেননি, তাঁকে ক্লাসঘরের দরজায় টুল নিয়ে বসতে হত। কারণ তিনি ছিলেন খ্রিস্টান। তিনিও পাণ্ডিত্যে তাঁর বিভাগকে গৌরবান্বিত করেছিলেন৷ ড. শহীদুল্লাহ বা সুকুমারীর কৃতিত্ব আর গৌরব ক-টি সংস্কৃতের ছাত্র ছুঁতে পেরেছে সেটা একটা কোটি টাকার প্রশ্ন।

স্বাধীনতার পরে ভারতে একটা গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গৃহীত হয়। প্রচুর ছেলেমেয়ে ইচ্ছেমতো বা সহজলভ্য বিষয় পড়তে শুরু করে, এবং এ বিষয়ে কোনও সামাজিক বা পারিবারিক বিধিনিষেধের কথা আমরা শুনিনি। থাকলে তা খুব যৎসামান্য ছিল, মিডিয়ায় খবর হয়নি। আমি যখন রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য ছিলাম, তখন একটি মুসলমান মেয়ে সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিল, তার শিক্ষকেরা তাকে নিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে। তার গর্ব ছিল আমারও গর্ব। শিক্ষায় তো আমরা এই মানবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই চাই। পশ্চিমবাংলায় মাদ্রাসাতে প্রচুর হিন্দু ছেলেমেয়েও পড়ে, এমনকি এমন মাদ্রাসাও আছে যেখানে শুধু হিন্দুরাই পড়ে৷ তাও শুনেছি৷ শিক্ষাটাই বড় কথা।

অবশ্যই এর আগে এই শতাব্দীর গোড়ায় বিজেপি সরকার চেষ্টা করেছিল পৌরোহিত্য ইত্যাদি নিরর্থক বিষয় যোগ করে শিক্ষাকে অগণতান্তিক ও ব্রাহ্মণ্য প্রলেপে লিপ্ত করার। আমরা সেটা আটকাতে পেরেছিলাম। ওই বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইউ জি সির অধ্যক্ষ হয়েছিলেন, তিনি যখন এই প্রস্তাব আমাদের পাঠালেন, আমরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য উচ্চশিক্ষা সংসদের হয়ে তাঁকে চিঠিতে প্রশ্ন করলাম- “পৌরোহিত্য কি মেয়েরা পড়তে পারবে, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখরা পড়তে পারবে? ডিগ্রি পেলে তারা সবাই হিন্দুদের পুজো করতে পারবে, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদিও? যদি না পারে তা হলে এই প্রথম ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা আর সর্বসাধারণের জন্য সবরকম সুযোগ খোলা রাখছে না, ধর্ম ও জাতপাতের বিবেচনায় তার দরজা অন্যদের জন্য বন্ধ করা হচ্ছে। ড. গৌতম আর এ নিয়ে অগ্রসর হননি।

আজ সেই বেনারসেই কুৎসিত ধর্মোন্মাদনায় শিক্ষার অঙ্গনকে কলুষিত করার চেষ্টা হচ্ছে। জানি না রাষ্ট্রের তাতে গোপন সমর্থন আছে কি না। থাকতেই পারে। এই কুৎসিত আন্দোলনের জন্য কোনও ধিক্কারই যথেষ্ট নয়। আমার আপনার প্রতিবাদের আগুনে এই আন্দোলন ধ্বংস হোক।