হিন্দোল ভট্টাচার্য
পূর্ব প্রকাশিতের পর
আমাদের সমস্যা হল আমরা যে সময়ের প্রেক্ষিতে অতি ক্ষুদ্র, তা ভুলে যাই। ভুলে যাই এই সময়টাও অতি ক্ষুদ্র পলক ফেলার মতো। তা যখন বৃহত্তর সময়ের কীর্তির সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে পারি। কিন্তু আমাদের মন তখনও আত্মকে বিলুপ্ত করে ভাবতে পারে না। মনে হয়, যে কোনও বড় শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পী নিজেকে কতকটা সমর্পণই করেন শিল্পের কাছে। নিজেকে শিল্পের কাছে সমর্পণ করে দিতে তিনি বাধ্য। এ ছাড়া তাঁর আর কিছু করার থাকে না।
অথচ আমাদের নিজস্ব এক ধারণা আছে, শিল্পের মাধ্যমে আমরা সম্ভবত নিজেরাই থেকে যাই। সেটা হয়তো ক্ষুদ্র সময়ের বৃত্তে সম্ভব। হয়তো বা রেখেও যাই। কিন্তু আমরাই বা কী? আমাদের গুরুত্বই বা কোথায়? জিন প্রযুক্তিবিদরা এখন রাখগোরির কবর খুঁড়ে আবিষ্কার করছেন যে কঙ্কাল, তার এবং এমন অসংখ্য জিন নিয়ে গবেষণা করে বলছেন ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যে হরপ্পা সভ্যতা ছিল, তা থেকেই মধ্য প্রাচ্যের প্রায় সমস্ত সভ্যতা তৈরি হয়েছে। হরপ্পার নগরগুলি ধ্বংস হওয়ার পরে সেই সব এলাকার মানুষজন যেমন চিনের দিকেও ছড়িয়ে পড়েন, তেমন ছড়িয়ে পড়েন সারা ভারতেই, ইরানেও। জিন পরীক্ষা সেটাই বলছে। ভাবুন একটা সভ্যতা ছিল প্রায় ৪০০০ বছর ধরে। আর আমরা এই আধুনিক সভ্যতার মানুষজন, আমাদের জানা পরিচিত ইতিহাসের নিশ্চিত খোঁজ দিতে পারি বড়জোর দেড় হাজার বছরের, বা দুহাজার বছরের। আমাদের সভ্যতার এই তো বয়স। আমরা জানিও না, যে নাগরিক সভ্যতা ৪০০০ বছর ধরে বিকাশলাভ করেছিল, তাদের জ্ঞান এবং কার্যধারার বিস্তার ঠিক কতদূর গিয়েছিল? একটা প্রশ্ন তো মাথাতে আসেই, মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে কিছু না জেনে কি নাগরিক সভ্যতার এই সব কীর্তিগুলি তৈরি করা যায়? এর মানে, না জানা সেই সব নাগরিক সভ্যতা মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কেও জানত, হয়ত মাধ্যাকর্ষণের বিখ্যাত সমীকরণের অঙ্কটিও তারা আবিষ্কার করে ফেলেছিল, কিন্তু সেই অঙ্কের ভাষা ইউরোপীয় বা আজকের ভাষা ছিল না। হয়তো তা মন্ত্রের মতো ছিল বা অন্যরকম কিছু ছিল। ভাষা সিস্টেমের তখনকার যুক্তিকাঠামোর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
এ কথা তো ভাবা অত্যন্ত অন্যায় হবে, যে আমাদের এই সভ্যতার যে যুক্তিশৃঙ্খল আমরা গড়ে তুলেছি, সেই যুক্তিকাঠামোই একমাত্র, তার বাইরে কিছু নেই। এমনকী যে ভাষায় আমরা সেই যুক্তিকাঠামোকে ব্যাখ্যা করি, প্রকাশ করি, তার বাইরে অন্য কোনও ভাষায় তার প্রকাশ হবে না, এটাও আমাদের অহমিকা। বলা ভালো, আমরা আমাদের সেই সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে ভাবি না। যুধিষ্ঠিরকে যদি এই প্রশ্ন বক করত— বলো, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে অসঙ্গতি কী? যুধিষ্ঠির হয়তো বলতেন— আমরা সীমাবদ্ধ, কিন্তু মনে করি বিশ্বভুবনের সমস্ত কিছুই আমরা অনুভব করতে সক্ষম।
এই প্রসঙ্গে ঈশ্বরের কথাও আসে, আধ্যাত্মিকতার কথাও। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে ধর্মকে যোগ করে দেওয়া হয়। একটা ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বলছি। ভিমবেটকায় যে দেওয়ালে বিভিন্ন যুগের মানুষদের আঁকা ছবিগুলি আছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আমার চারপাশের বর্তমান আর ছিল না। আমি যেন কোথায় চলে গিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা নির্জন জঙ্গলের মধ্যে আছি। আমার পিছনে যে কোনও সময়ে আক্রমণ করতে পারে হিংস্র জন্তু। নিজেকে রক্ষা করার মতো আমার কাছে কিছুই নেই। আমার শরীরের পোশাক পর্যন্ত অল্প। নেই বললেই চলে। সম্বল বলতে কিছু ধারালো পাথর। আমি কী করব? আমার সামনে দেওয়াল। আর পাথর কেটে কেটে বানানো এই কলমটা, এই তুলিটা। কী করব? মন বলছে এঁকে যাই। করুক আক্রমণ আমাকে পিছন থেকে। কে দেখবে? কেউ দেখবে নাকি? কেউ বলবে নাকি মহান শিল্পী? আজ থেকে দেড় দু লক্ষ বছর পরে কেউ কি দাঁড়িয়ে থাকবে আমার এই চিত্রের সামনে? না, এ প্রশ্ন আমার মাথাতেই আসছে না। আমার খিদে পাচ্ছে। পেটে এবং মনে। ভয় আসছে। আমি জানি না, আমি আগামী কালকে আবার আসতে পারব কি না এই গুহায়।
কিন্তু আমি এঁকে চললাম। এই যে এঁকে চললাম, এর কারণ জানি না। আমার কোনও নাম নেই, আমার কোনও ছবি নেই, আমার কোনও সাক্ষর নেই। আমার শিল্পই আমার সাক্ষর।
আমার শিল্পই আমি। তোমরা আমার শিল্পকে দেখবে। আর ভাববে, এমন কেউ ছিল, যে মাটি মেখে ঝরনায় স্নান করে একটা পাহাড় ডিঙিয়ে এখানে আসত। আসার পথে পেরিয়ে আসত হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল একটা জঙ্গল। এই গুহায় দেওয়াল ছিল তার প্রাণের দেওয়াল। এই দেওয়ালে অন্তত একটা আঁচড় না কাটলে তার ভালো লাগত নাআ। এ থেকে সে খেতে পেত না, পোশাক পেত না, অস্ত্র পেত না। কী পেত?
ইতিহাস আমাকে যে রাখবেই, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ইতিহাস কাকে রাখবে, তা এক বড় জটিল সমস্যার বিষয়। ইতিহাস কীভাবে রাখবে, কবে তাকে আবিষ্কার করবে মানুষ, তাও কেউ জানে না। দশ কুড়ি বছরের মধ্যেই মানুষ কত বিস্মৃত হয়ে যায়। কারণ মানুষ মত্ত। মানুষ মত্ত থাকতে ভালোবাসে কার্নিভ্যালে। এটাও মানবজাতির একটা বৈশিষ্ট্য।
সেই কার্নিভ্যালে তুমি যদি মেতে উঠতে পারো, তবে তুমি সব পাবে। যদি মেতে উঠতে না পারো, তবে তুমি বিস্মৃত হয়ে যাবে।
(ক্রমশ)