সৌমিক দাশগুপ্ত
বাজার করা শুনলেই মনে হয়, এ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ আর এমন কী। কিন্তু মনে রাখা উচিত, বাজার করা এক ধরনের শিল্প। রান্না যেমন আর্ট। বাজার করাও সেরকমই একটা আর্ট।
আগেকার দিনে সম্পন্ন গেরস্থ বাড়িতে একজন করে বাজার সরকার থাকতেন। জমিদার বাড়িতে বেতনভুক বাজার সরকার থাকতেন, এমনি বড়লোক বাড়িতে সাধারণত দূর সম্পর্কের কোন আশ্রিত দুঃস্থ আত্মীয় বাজার সরকারের ভূমিকা পালন করতেন। তারপর পারমাণবিক পরিবারগুলোতে সদস্য সংখ্যা কমতে কমতে আশ্রিত ব্যাপার স্যাপারগুলো উঠে গেল। এখন কে কাকে আশ্রয় দেয় আর! মরছি নিজের জ্বালায়, তার উপর শঙ্করাকে ডাক!
এই বাজার সরকাররা বাজার করাতে খুব পারদর্শী হতেন। মানে তা তো বিশাল বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। ডেইলি আলুর কনজাম্পশনই হয়ত দেড় দু কেজি। পাঁচ আঁটি পালং, আস্ত একটা কুমড়ো, বিশাল একটা কাতলা, সের পাঁচেক পাঁঠা। ইয়া জাম্বো সাইজের হাঁড়ি কড়াই খুন্তি। মানে সে এক এলাহি ব্যাপার। একটা রান্নাঘরের সাইজ যা, তাতে একটা টু বি এইচ কে ফ্ল্যাট ঢুকে যাবে। রাঁধুনি সমেত পাঁচ ছ জন দুটো জেনারেশনের দিদিমা কাকিমা মেজ ভাসুর ঝি যুদ্ধং দেহি মনোভাব নিয়ে ঘচাঘচ সবজি কেটে চলেছেন। ইয়াবড় আঁশবঁটি নিয়ে ‘বাঘিনী’ সিনেমার সন্ধ্যা রায়ের স্টাইলে কেউ একজন ঘচাৎ করে কাতলার মুণ্ডু নামিয়ে দিয়ে হিংস্রভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। সে সব এক দেখার মতো ব্যাপার ছিল। আর এ নিত্যিদিনের ঘটনা।
আজ সে দিন নাই। একান্নবর্তী ফ্যামিলি বলে কিছু হয় না। পাবলিক ক্যালোরি সচেতন। খাবে কী! আদ্ধেক খাবার নিষিদ্ধের তালিকায় ফেলে দিয়েছে ডাক্তার। মেপে মেপে আড়াই চামচ ভাত, এক টুকরো চিকেন, দু হাতা মুসুর ডাল, আর রনি কাঁটা বেছে খেতে পারে না বলে অ্যাত্তোটুকু দুর্ভিক্ষে ভোগা ভেটকির কিউব। এ সবের জন্য আর যাই হোক, বাজার শিল্প দরকার নেই।
তাও কিছু ক্ষু্ধার্ত মানুষ আছে। আমার মতো। পকেটে পয়সা অত নেই, কিন্তু হেব্বি ক্ষিদে আছে। কারণ কে না জানে, উপার্জনশক্তি আর পাচনক্ষমতা ব্যস্তানুপাতিক। তাদের জন্যই বাজার বাঁচে।
প্রথম শর্ত খেতে ভালোবাসতে হবে। রোগ বিসুখ থাকবে। মাঝে মধ্যে ধুর শালা, হাই ব্লাড প্রেসারের নিকুচি করেছে, ইউরিক অ্যাসিডের একশো আট বলে থলি নিয়ে বেরোতে হবে। একটা না, আড়াই খানা ব্যাগ। দুটো বড় ব্যাগে সব্জিপাতি। আর হাফ ব্যাগটায় মাছ মাংস ইত্যাদি। পকেটে, আজকাল যা দিন, হাজার বারোশো টাকা লাগবে।
ধরা যাক এক রোববার। আজ জিলিপি আনলে বেশ হয় বলে বেরোলেন। হজম ক্ষমতা আর অ্যাসিডের চাপ না থাকলে সাথে খান দশেক লুচি। না হলে রিস্ক নেবেন না। আপনার লক্ষ্য মধ্যাহ্নভোজন।
বাড়ি থেকে বেরোবার আগে মেনু কী হবে, মনে মনে ঝালিয়ে নিতে হবে। পুঁই শাক না কুমড়ো ঝিঙে, আলু পোস্ত না ফুলকপির ডালনা। পেঁয়াজকলির চচ্চড়ি না বাঁধাকপির ঘণ্ট। ডালের সাথে কী? কুমড়ো ফুলের বড়া, মোচার ঘণ্ট, বেগুনি না মাছের চপ? তারপর মাছ। কী মাছের কোন প্রিপারেশন? কালোজিরে কাঁচালঙ্কার ঝোল না ধনেপাতা দিয়ে আলু ফুলকপি বড়ির ঝোল না রগরগে কালিয়া, নাকি অপার্থিব সর্ষে বাটা? সেই অনুসারে মাছ বাছাই করতে হবে। সবচেয়ে যেটা ইমপর্ট্যান্ট, বাজারে ঢুকে মানসচক্ষে মেনুটা ভিসুয়ালাইজ করা। চোখ বুজলেই ভেসে উঠবে, থালায় চুড়ো করা ভাত, পাশে এক খণ্ড লেবু, চারপাশে বাটি সাজানো। এবার মনে মনে সেই পদগুলোর স্বাদ জিভে অনুভব করতে থাকুন। তাহলেই না বুঝতে পারবেন, যে কী কী উপাদান আছে তাতে। কচুর লতিটা ইলিশের মাথা দিয়ে হবে না নিরামিষ। মুগের ডালে মাছের মাথা পড়লে মজা বেশি না শীতের সব্জি। মুলো যে নেবেন, অলরেডি দুটো সবজি ভেবে ফেলেছেন। মেন অব মেন কোর্সে চাপ হবে না তো। মাছের সাথে একটা মাঝারি বাটিতে লালচে সোনালি ঝোলে এক টুকরো আলুর সাথে চার পাঁচ পিস খাসির টুকরো ঘুরলে ব্যাপারটা আরও রোম্যান্টিক হবে কিনা!
এসব ভাবতে হয়। ভাবতে ভাবতে বাজার করতে হয়। পাশের বাড়ির মুখার্জী বৌদি বাজার করতে করতে ঘামে ভেজা মুখে একবার আঁচল বোলালেন, আর আপনার চোখ ওনার কোমরের উপর একফালি অংশে আটকে গিয়ে আপনি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন আর বাজার করা ডকে উঠল। ওসব পরে হবে। বৌদির পেটির বদলে কাতলার পেটিতে কনসেন্ট্রেট করুন। আর পাঁচটা শিল্পের মত এটাও কিন্তু পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে।
আড়াইখানা ব্যাগ ভরে গেছে। ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে একগোছা পেঁয়াজকলি, সতেজ লকলকে পুঁই ডাঁটা। একটা রিকশা করুন। একটা সিগারেট ধরান। গুনগুন করে একটা গান ও ধরতে পারেন।
বঁধু কোন আলো লাগল চোখে….