Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একশো বছর — তৃতীয় বর্ষ, অষ্টম যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের বর্ষশেষ সংখ্যা, তথা এই একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকটির সমাপ্তিসূচক সংখ্যাটির মূল আলোচ্য হইবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একশত বৎসর, তাহা অনেকদিন হইতেই স্থির হইয়া ছিল। সচরাচর প্রচ্ছদকাহিনি নির্বাচন খুব সহজে হয় না, কিন্তু এ-যাত্রা সম্পাদকমণ্ডলীর সকল সদস্যই এই বিষয়ে দ্রুত একমত হইয়াছিলেন। বর্ষশেষ সংখ্যায় ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের শতবর্ষের আলো-অন্ধকারময় ইতিহাসটিকে আমরা স্মরণ করিব, সে বিষয়ে, অতএব কোথাও কোনও দ্বিধা ছিল না। কিন্তু গোল পাকাইল অন্যত্র। 

প্রথম সমস্যা হইল শতবর্ষটি আদৌ শতবর্ষ কি না, তাহা লইয়া। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মসন, কেহ বলিতেছেন ১৯২০, কেহ ১৯২৫। বিতর্কটি আপাতদৃষ্টিতে আদৌ কোনও সমস্যার উদ্রেক করে না ঠিকই, কারণ জন্মসন নির্ধারণ কোনওক্রমেই আমাদের দায়িত্ব নহে। অপিচ ঈদৃশ মতান্তরে একটি মৌলিক ধর্মসঙ্কটের সূচনা হইল। তবে তাহাতে সম্পাদকমণ্ডলী বিশেষ ঘাবড়ান নাই। সত্য বলিতে কী, ভারতে বাম আন্দোলনের একশত বৎসরের ইতিহাসে মতান্তর তো কেবল জন্মসন লইয়াই নহে – বস্তুত তাহা অসংখ্য, অগণন। সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সংসদীয় পথে নাকি সশস্ত্র সংগ্রামে; রাষ্ট্রের চরিত্র পুঁজিবাদী নাকি আধা-সামন্ততান্ত্রিক; দেশীয় পুঁজিপতিদিগের সহিত বামপন্থীদিগের সম্পর্ক মিত্রতার নাকি সাপে-নেউলে; বিপ্লবের পুরোভাগে কৃষক নাকি শ্রমিক নাকি শ্রমিক-কৃষক… গত একশত বৎসরের ইতিহাস এমত বহুতর বিতর্কেরই ইতিহাস। এখানেই শেষ নহে, বিতর্ক আরও অজস্র রহিয়াছে। আর সেই সঙ্গে রহিয়াছে ভাঙন। প্রশ্ন উঠিল, রিজার্ভড বগির নিবন্ধগুলিতে আমরা কি এই বিতর্কগুলিকেই একটি কালপরম্পরার মধ্যে গ্রথিত করিয়া তাহাদিগের চরিত্র অনুধাবনের চেষ্টা করিব? নাকি, তাত্ত্বিক প্রতর্কগুলিকে পাশ কাটাইয়া সর্বভারতীয় ঘটনাপ্রবাহের নিরিখে দেশের বাম আন্দোলনকে বুঝিতে চাহিব?    

সরোজ দত্ত বলিয়াছিলেন, অনেক সময় নিজের আয়নায় যে মুখ ঝাপসা দেখা যায়, শত্রুর আরশিতে তা স্পষ্ট হইয়া উঠে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়িতে পারে ত্রিপুরারাজ্য জয়ের পর গেরুয়া শিবিরের উৎকট উল্লাসের কথা। একমুঠি একটি রাজ্য, দেশের রাজনীতিতে যাহার ভূমিকা আদৌ উল্লেখযোগ্য কিছু নহে, সেখানেও ক্ষমতাবদলের পর গেরুয়া শিবির যে আহ্লাদে আটখানা হইয়া গিয়াছিলেন তাহার একমাত্র কারণ, পরাস্ত করা গিয়াছে বামপন্থাকে। আরও সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত চাহিলে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সেদিনও মানবাধিকার দিবসে যাহাদিগকে দেশের প্রধানতম শত্রু ঠাওরাইলেন, তাহারাও মাওবাদী বামপন্থী। শাসক দলের সুসংগঠিত আইটি সেলের মূল প্রোপাগান্ডার অভিমুখ যদি দেখা যায়, সেখানেও ধারাবাহিক আক্রমণের মুখে বামপন্থীরা। প্রশ্ন উঠিতে পারে, দেশজোড়া এই দোর্দণ্ড দাপটের মধ্যেও কেন বামপন্থী নামক দুঃস্বপ্ন সদাই তাড়া করিয়া বেড়ায় শাসকদের?

শত্রু শত্রু চিনিতে ভুল করে না। আমরাই বন্ধু চিনিতে ভুল করিয়া ফেলি।

শ্রদ্ধেয় পাঠক, স্মরণ থাকিতে পারে, গত জুন মাসে, যখন সদ্যই লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে আকাশবাতাস ভারী হইয়া আছে, তখনই আমরা আমাদের পত্রিকায় মূলভাবনার বিষয় নির্বাচন করিয়াছিলাম ‘বামপন্থা ও ভবিষ্যতের ভারত’। আমাদিগের মনে হইয়াছিল, রাত্রির নিবিড়তম অন্ধকারের মুহূর্ত হইতেই যেমন পরবর্তী ঊষাকালটির নির্মাণ শুরু হয়, ভারতবর্ষে বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখাটির অভিমুখ নির্ধারণের সূচনাকল্পেও তেমনই উহাই ছিল সঠিক সময়বিন্দু। একই কথা এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই শতবর্ষে আমাদের অবশ্যই স্মরণ করিতে হইবে কায়ুরের বীর শহিদদের, তেলেঙ্গানা-তেভাগার সংগ্রামীদের, নকশালবাড়ির অমর শহিদদের। আর তৎসঙ্গেই, আজ দক্ষিণপন্থার এই সর্বতোমুখী জয়যাত্রার মধ্যেও কৃষকদের যে লংমার্চ দেশকে নাড়াইয়া দেয়, শ্রমিকদের যে মিছিল রাজধানীকে কাঁপাইয়া দেয়, মুক্তচিন্তার ধাত্রীগৃহ হিসেবে পরিচিত দেশের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি আজও মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে সগৌরবে, সর্বত্রই পতাকার রংটি লাল। একশো বছরে ব্যর্থতার তালিকা সুদীর্ঘ হইলেও, এই অর্জনগুলিও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার পাথেয় হিসেবে যথেষ্ট।

আমাদের এই রিজার্ভড বগিতে লিখিলেন প্রশান্ত ভট্টাচার্য, প্রতিভা সরকার, কুণাল চট্টোপাধ্যায়, সৌভিক ঘোষাল এবং প্রবুদ্ধ ঘোষ। তৎসহ প্রতিটি নিয়মিত বিভাগ যেমন থাকে তেমনই রহিল।

আসুন, পড়ুন, মতামত দিন…। আগামী বছরের শুভেচ্ছা সবাইকে…