সত্যব্রত ঘোষ
ঝাড়খণ্ডে এখন বিধানসভার নির্বাচন চলছে। গণতন্ত্রের এই বিশাল আয়োজনের মাঝে খুন্তি জেলার তিনটি ব্লকের তিরিশ হাজারের বেশি আদিবাসী বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মানুষগুলির অপরাধ— এরা এখানে চলা পাতালগাডি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। খুন্তি জেলার এই অঞ্চলে জনবসতির প্রায় দশ শতাংশই হল আদিবাসী। এদের সাংবিধানিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে অসংখ্য মানুষ গত ৪ঠা ডিসেম্বর রাঁচির রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসেন।
গত দুই বছর ধরে খুন্তি, আর্কি এবং মুরহু ব্লকের আদিবাসী গ্রামগুলিতে মানুষ ‘পাতালগাডি’-তে নিয়ত। মুণ্ডা জাতির প্রথা এবং ভারতীয় সংবিধানের পঞ্চম তফসিল এবং সংরক্ষিত এলাকার পঞ্চায়েত আইন (PESA) মেনে গ্রামগুলির প্রবেশপথে পাথরের ফলক (পাতাল)-এ গ্রামসভা দ্বারা প্রণীত আদিবাসীদের সেই আইনগুলির কথা লেখা হয়েছে, যার নিশ্চয়তা দিয়েছে ভারতীয় সংবিধান।
সংবিধান এবং PESA থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতির সাহায্যে সেখানে আদিবাসীদের বিশেষ অধিকারগুলি তুলে ধরা হয়েছে যা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় গ্রামসভার দ্বারা স্বশাসনের স্বীকৃতি দেয়। যেমন, জল, জঙ্গল আর জমি— এই তিনটি প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসীদের স্বাভাবিক অধিকার আছে। ফলকগুলিতে কিছু বিশেষ নিয়মের কথাও বলা হয়েছে। যেমন, গ্রামেতে বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত। স্থানীয় গ্রামসভায় গৃহীত এমন নিয়মগুলিকে সংবিধান মেনে ব্যাখা করলে তা বাস্তবজ্ঞানহীন মনে হওয়া সম্ভব।
কিন্তু সেই ব্যাখাগুলি নিয়ে গ্রামের মানুষগুলির সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা না করে সরকার হিংসার পথ বেছে নিয়ে তা মর্মান্তিকভাবে দমন করতে উদ্যত।
২০১৮ সালে সরকার এমন অনেক গ্রামে আক্রমণ করে যেখানে পাতালগাডি আছে। মুরহু ব্লকের গ্রামে পাতালগাডি লেখবার সময়ে পুলিশ হানা দেয়। বাড়িঘর ভেঙে নারী শিশুদের পিটতে থাকে তারা। সেই প্রাণান্তকর পরিস্থিতির মধ্যে বিকলাঙ্গ এক শিশুর জন্ম দেন এক মা। দুজন গুলিবিদ্ধ হন, যাদের একজন প্রাণ হারান।
গত দুই বছরে পাতালগাডি গ্রামগুলিতে এমন অনেক আক্রমণ হয়েছে। সেখানকার বহু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করবার অছিলায় তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। সমগ্র এলাকাটিতে অন্তত নয়টি স্কুলে এবং দুটি কমিউনিটি বিল্ডিং-এ পুলিশ ক্যাম্প বসিয়েছে নির্দিষ্ট গ্রামসভাগুলির তোয়াক্কা না করেই।
পুলিশের বক্তব্য আদিবাসীরা ভারতীয় সংবিধানকে ভুলভাবে ব্যাখা করেছে। সেই অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সহ বিভিন্ন কঠিন ধারায় ৩০,০০০ মানুষকে অভিযুক্ত করেছে পুলিশ, যাদের নামগুলিও নথিবদ্ধ নেই। সরকার মনে করে তিনটি ব্লকের দশ শতাংশ মানুষ রাষ্ট্রবিরোধী! এভাবে অধিকারভঙ্গের কথা এলাকার মানুষজন সরাসরি অন্যদের বলতেও পারছেন না এই ভয়ে যে তাঁদের নামগুলি প্রকাশ্যে চলে আসে।
রাঁচির রাজভবনের সামনে ধর্নাটি আয়োজন করে কর্মী এবং স্থানীয় মানুষদের তৈরি সংগঠন ঝাড়খণ্ড জনাধিকার মহাসভা এবং PESA, যাতে আদিবাসী উইমেনস নেটওয়ার্ক, সমাজবাদী জন পরিষদ, রাইট টু ফুড ক্যাম্পেন, বাগাইচা, জন সংঘর্ষ সমিতি, TRTC, ঝাড়খণ্ড কিশান পরিষদ, NAPM, বিস্থাপন বিরোধী জন বিকাশ আন্দোলন, ন্যাশনাল ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইউনিউন, বন অধিকার মঞ্চ এবং সর্বোদয় মিত্র মণ্ডল সহ বিভিন্ন সংগঠনের বহু প্রতিনিধি যোগদান করেন।
অরবিন্দ অবিনাশ, জ্যঁ ড্রেজ, বি বি চৌধুরী, সিরাজ দত্ত, জেরম কুজুর, এলিনা হোরো, বিনীত মুণ্ডু, ডেভিড সলোমন, অম্বিকা যাদব, জসিন্তা কেরকেট্টা, রঞ্জিত কিন্ডো, সরোজ হেমব্রম, বিনোদ কুমার, জর্জ মনিপাল্লি, বিশ্বনাথ আজাদ, সুষমা বিরুলি সহ অনেক সমাজকর্মী ধর্নায় বসেন।
ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিস্ট জ্যঁ ড্রেজ ধর্নায় অংশগ্রহণ করা প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে নিজের বক্তব্যে বলেন, “যে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে সরকার পাতালগাডি আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে উদ্যত তা স্থানীয় আদিবাসীদের আইনসঙ্গত এবং অহিংস দাবীর বিরুদ্ধে চরম প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বশাসনের যে পরম্পরা খুন্তিতে এতদিন চলে এসেছে, তাকে শুধু স্বীকৃতি দেওয়াই নয়, সেই পরম্পরা উদযাপন করা উচিৎ।”
মানুষরা আদিবাসীদের অধিকার ভঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তুললে কেন ঝাড়খণ্ড সরকার তা রাষ্টদ্রোহিতা হিসেবে বিবেচনা করছে, তা নিয়েও প্রতিবাদসভায় আলোচনা করা হয়। ঝাড়খণ্ডের সমাজকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক সহ কুড়িজনকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হচ্ছে এই জন্য যে তাঁরা পাতালগাডি গ্রামগুলিতে আদিবাসীদের উপর সরকারের আচরণের প্রসঙ্গ এবং আদিবাসীদের অধিকার হরণ করে অত্যাচারের বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন।
সম্প্রতি এদের মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে— স্ট্যান স্বামী, বিনোদ কুমার, অলকা কুজুর এবং রাজেশ রোশন কিডো— আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে যারা সদাসর্বদা লড়ছেন।
নবীন কবি জসিন্তা কেরকেট্টা স্পষ্ট জানালেন, “প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার লেবেল লাগিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার সরকারি পদক্ষেপগুলি এবার বন্ধ হোক। মুক্ত অভিব্যক্তির যে অধিকার প্রতিটি ভারতীয়ের আছে, তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে এমন পদক্ষেপ দিয়ে।”
ধর্নায় যে আলোচনাগুলি হয়, তার থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান কথা সামনে আসে। পাতালগাডির মাধ্যমে খুন্তির মানুষদের প্রতিবাদের শিকড় জড়িয়ে আছে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের জমি থেকে আলাদা করা এবং তাঁদের শোষণ করবার প্রতিবাদের সঙ্গে। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৫১ থেকে ১৯৯৫— এই সময়টির মধ্যে অন্তত পনেরো লক্ষ স্থানীয় মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। এদের মধ্যে একচল্লিশ শতাংশ মানুষ ছিলেন আদিবাসী। শেষ কয়েকটি দশকে শুধুমাত্র খুন্তি জেলাতেই বহুবার জমি দখলের চেষ্টা করেছে সরকার। কখনও কোয়েল-কাড়ো হাইডেল প্রোজেক্টের জন্য বাঁধ বানানোর কথা বলে, আবার কখনও আর্সিলর মিত্তলের স্টিল প্ল্যান্ট তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে জমি কাড়তে এসে সরকারকে বিশাল প্রতিবাদের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। এবং শেষ অবধি জন-আন্দোলনের কারণে প্রকল্পগুলির কোনও গতি হয়নি। অন্য যে প্রসঙ্গে স্থানীয় মানুষ ক্ষুব্ধ তা হল বারবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে আদিবাসীদের বিশেষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
গত পাঁচ বছর ধরে আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার হরণের উদ্দেশ্যে সারা রাজ্য জুড়ে লাগাতার আক্রমণ চলছে। গ্রামসভাগুলিকে ক্রমশ দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন আইনের অছিলায়। সরকার নানাভাবে ছোটনাগপুর অ্যান্ড সান্থাল টেনেন্সি অ্যাক্টগুলিকে কমজোর করতে চাইছে, যা আদিবাসীদের জমির উপর অধিকার নিশ্চিত করে। ল্যান্ড ব্যাঙ্ক পলিসি কার্যকর করে গ্রামসভার মালিকানায় থাকা জমিগুলিকে কোনও অনুমতি না নিয়ে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে সরকার।
একদিকে বিজেপি-র নেতৃত্বে রাজ্য সরকার সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে উল্লেখিত নীতিগুলি বেপরোয়াভাবে লঙ্ঘন করে চলেছে এবং PESA কার্যকর করতে গড়িমসি দেখাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রবেশের আগে ভারতীয় সংবিধান নামক বইটির সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সংবাদের শিরোনামে আসেন।
ধর্নার শেষে রাজ্যপাল দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে ঝাড়খণ্ড জনাধিকার মহাসভার পক্ষ থেকে যে দাবিপত্র তুলে দেওয়া হয়, তাতে প্রথমেই বলা হয়েছে পুলিশকে মিথ্যা এফআইআরগুলি প্রত্যাহার করতে হবে। ঘাঘরা এবং অন্যান্য গ্রামে লাগাতার পুলিস ও সুরক্ষা বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের শাস্তিস্বরূপ যথাশীঘ্র জুডিসিয়াল এনকোয়ারি চালাতে হবে এবং আহত মানুষগুলিকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাতালগাডি গ্রামগুলিতে গিয়ে সরকারকে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গ্রামের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। এবং সরকারকে সংবিধানের পঞ্চম তফসিল এবং PESA-কে কার্যকর করবার জন্য এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।