Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সশক্ত পুলিশ আর মজবুত আইন চাই, মৃত্যুদণ্ড নয়

সত্যব্রত ঘোষ

 

সাত বছর আগে— ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২-য় তথাকথিত ‘নির্ভয়া’র ধর্ষণকাণ্ডটি ঘটেছিল। সেইসময়ে সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। ভারতে তথা দিল্লিতে মহিলাদের সুরক্ষা বলে আদৌ কিছু আছে কি নেই, তা নিয়ে সংবাদপত্রে এবং টেলিভিশন চ্যানেলে দিনের পর দিন বিশেষজ্ঞরা নানা আলোচনা করেছেন। সেসব আলোচনার ইতিবাচক দিকটুকু এই যে, ভারতের অধিকাংশ মানুষ মানতে বাধ্য হলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করেন বলেই নারী ধর্ষিত হন না।

দীর্ঘ এক সময় ধরে আইনরক্ষকদের সামনে দাঁড়িয়ে নিপীড়িতাদেরই প্রমাণ করতে হত তাঁরা ধর্ষণের শিকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের চারিত্রিক ‘ত্রুটি’-র দিকে আঙুল তুলে নির্দোষ পুরুষদের অসহায়তাকে প্রতিষ্ঠিত করাটাই ছিল অভিযুক্তের আইনজীবীদের অন্যতম কাজ। ‘নির্ভয়া’ কাণ্ডটি জনসমক্ষে আসবার পর রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা নড়ে চড়ে বসেন। তাঁদের অন্তত এটুকু উপলব্ধি হয় যে সমাজে মহিলাদের সুরক্ষা প্রদানে গাফিলতি রয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, তৎকালীন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপি-র রথী-মহারথীরা তখন কম বিষোদ্গার করেননি এই বিষয়ে। বস্তুত, ২০১৪ সালে মোদি-প্রতিশ্রুত ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রেক্ষাপট তৈরিতে ‘নির্ভয়া কাণ্ডের’ ভূমিকা কম ছিল না।

তবে, তার আগেই মনমোহন সিং-এর সরকারের উদ্যোগে বিশেষ অর্ডিন্যান্স-এর দ্বারা ২০১৩ সালের মার্চ মাসেই ভারতীয় দণ্ডবিধি সহ সাক্ষ্যপ্রমাণের বিধিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলাগুলিকে বাদীপক্ষের অভিযোগগুলিকে পোক্ত করবার ব্যবস্থা হল। এর পরে গঙ্গা-যমুনা-নর্মদা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ভারতের জনগণ ‘আচ্ছে দিন’-এর আশায় বিজেপি সরকারকে শাসনক্ষমতায় বসিয়ে শুধু দুর্দিনকেই প্রত্যক্ষ করে চলেছে। সামাজিক অসহিষ্ণুতা তুঙ্গে ওঠবার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণপিটুনির ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েছে। নোটবন্দির প্রভাবে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ নিম্নগামী। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ পরিবেশকে জিইয়ে রাখতে কাশ্মিরের ব্যবচ্ছেদ এবং রাষ্ট্রপতি শাসন জারি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোধ্যার রাম মন্দির নির্মাণে সিলমোহর লাগবার পর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা আজ প্রায় অদৃশ্য। এখন চলছে ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের’ চিহ্নিতকরণের এক প্রাণঘাতী প্রকল্প, যা বলবৎ করবার উদ্দেশ্য বৃহত্তর ভারতীয় সমাজকে আগামী কয়েক বছরে দুটি মেরুতে সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত করা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে।

সম্প্রতি তেলেঙ্গানায় ঘটে যাওয়া গণধর্ষণ এবং তারপরে পুলিশ এনকাউন্টারে অভিযুক্তদের হত্যাকাণ্ডকে দেশের এই সার্বিক অস্থিরতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে প্রবল প্রতাপান্বিত শাসককুলের ব্যর্থতার ছবিটি অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। কারণ প্রথমত, দেশ জুড়ে আর্থিক এবং রাজনৈতিক অরাজকতায় আইন ও প্রশাসন প্রতি পদে এখন নাজেহাল। দ্বিতীয়ত, যখনই কোনও বিষয় নিয়ে গণবিক্ষোভ দেশের বিভিন্ন কোণে দানা বেঁধে উঠছে, তখনই ছলে-বলে-কৌশলে সেই আন্দোলনকে ছত্রাকার করে দেওয়ার যে প্রবণতা এতদিন ছিল এখন তা বিরোধিতা রোখার জন্য রাষ্ট্রের মুখ্য হাতিয়ার। এই সক্রিয়তার এক ভগ্নাংশ যদি দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যবহৃত হত, ‘আচ্ছে দিন’-এর ঘোরটুকু অন্তত এখনও থাকত।

হ্যাঁ, তেলেঙ্গানার শাদনগরে ছাতনপল্লিতে গত ৬ই ডিসেম্বর ভোরে জল্লু নবীন, জল্লু শিবা, চন্দ্রকেশভুলু এবং মহম্মদ আরিফ নামে ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডে চার অভিযুক্তকে পুলিশ ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই গুলি করে মেরেছে। এবং সেই সূত্রে এক ভয়ঙ্কর পূর্ববর্তিতা (precedence) সৃষ্টি করা হল, যার অবিমিশ্র প্রভাব আগামী দিনে প্রকটভাবে দেশের মানুষ অনুভব করবে।

সাইবারাবাদের পুলিশ কমিশনার ভি সি সাজ্জানারের নেতৃত্বে এই যে হত্যাকাণ্ডগুলি সমাধা হল, তা নিয়ে কিছু মানুষের উল্লাস হয়তো স্বাভাবিক। কারণ, সিনেমার পর্দায় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে বীভৎস রস উৎপাদন করা হয়, তার মৌতাত থেকে আমরা অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারিনি। কিন্তু সিনেমার বাইরে যে বাস্তব জগৎ, সেখানে চিত্রনাট্য নেই। দুই আর দুইকে মিলিয়ে চার করবার মতো নাট্য উপসংহার সেখানে ঘটে না। দিল্লির ‘নির্ভয়া’ থেকে উত্তরপ্রদেশের উন্নাও— প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্যণীয় হল আইন ও প্রশাসনের চুড়ান্ত ব্যর্থতা।

‘নির্ভয়া’ কাণ্ডে আমরা যেমন দেখেছি অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্তকে নিয়ে আইনের দোলাচল, ঠিক তেমনি উন্নাও কাণ্ডে আমরা দেখছি প্রধান অভিযুক্ত (প্রাক্তন) বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার-এর শাস্তি বিষয়ে উত্তর প্রদেশ সরকারের চরম শৈথিল্য। অভিযুক্তদের ধর্ষণ মামলায় জামিন দেওয়ার পর ধর্ষিতাই আজ মৃতা। চিন্ময়ানন্দের ক্ষেত্রেও অবিরত ধর্ষণের ভিডিও ফুটেজ আইনের সামনে পেশ করবার পরেও ধর্ষিতাকেই ‘জবরদস্তি তোলা আদায়’-এর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ফেরা যাক তেলেঙ্গানার হত্যাকাণ্ডে। সাইবারাবাদের পুলিশ কমিশনার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন ধর্ষণের ঘটনা পুনঃনির্মাণের জন্য চার আসামীকে অকুস্থলে নিয়ে যাওয়ার পরে দুইজন পুলিশের বন্দুক ছিনিয়ে পালানোর চেষ্টা করে বলেই সবাইকে গুলি করে মারা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে তা প্রচারিত হওয়ার পরে দেশজুড়ে যে উল্লাস শুরু হয় তাতে অনেকই শঙ্কিত।

বৃন্দা গ্রোভারের মতো বর্ষীয়ান এক আইনজীবী, যিনি নারী অধিকার সংক্রান্ত বহু মামলা লড়েছেন, নিজের ফেসবুকে লেখেন “গুলির পথে চলা অবিচারকে ন্যক্কার জানান, কারণ এনকাউন্টারে কাউকে মারা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নারীকে সমানাধিকার নিশ্চিত করবার অজুহাতটির দ্বারা রাষ্ট্র ইচ্ছেমতো হত্যার উপায়টিকে নিজের তালিকায় যোগ করছে।”

রেবেকা মাম্মেন জন নামে সুপ্রিম কোর্টের আরেক বর্ষীয়ান আইনজীবী ট্যুইট করেন, “নারীদের বাঁচানোর নামে পুলিশ এনকাউন্টার চাই না। অনেকে যে এত সহজভাবে আজ ভিড়ের বিচার (mob justice) উদযাপন করছেন, তার কারণ পুলিশের প্রতি আর কারও আস্থা নেই। ভোররাতে যে চারজনকে মারা হল, তাদের বিরুদ্ধে আদালতে কি কোনও প্রমাণ পেশ করা হয়েছে? কোনও আদালত কি তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করেছে? আদৌ যদি তারা অপরাধ ঘটিয়েই থাকে, সেক্ষেত্রে নিয়ম মেনে কাজ করা হল না কেন? যদি এভাবে নিয়মকেই তোয়াক্কা না করা হয়, তাহলে আপনি কিন্তু এই অব্যবস্থার পরবর্তী শিকার হতে পারেন। যারা নীতি নির্ধারণ করেন, রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থনে প্রচার করেন অথবা আন্দোলনের সৌখিনতায় পথে নামেন, আজ এই ট্রিগার জাস্টিস-এর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। কাজ শেষ … আপনাদের আর মাথাব্যথা নেই। থাকলে উন্নাওতে গতকাল (৫ই ডিসেম্বর) অভিযোগকারিনীর উপর এমন প্রাণঘাতী হামলা হত না। কারণ, ধর্ষণের মামলায় অভিযোগকারিনীর পাশে লাগাতার থেকে যাওয়াটা দীর্ঘস্থায়ী এবং ঝুঁকিপূর্ণও বটে। যারা ‘পাশে আছি’ বলে সহমর্মিতার ভান করছেন, তাঁরা কোনও ধর্ষিতা মহিলার সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা সন্দেহ। তাঁদের কতধরনের প্রতিকুলতার মুখোমুখি হতে হয়, অথবা তাঁরা কী চাইছেন— সেই বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই।”

করুণা নন্দী আইনজগতে সুপরিচিতা। তিনি নিজের ট্যুইটে হতাশায় লিখছেন, “কেউ কখনও জানবে না, যে চারজনকে পুলিশ মারল, তারা নির্দোষ কি না।” অন্য একটি ট্যুইটে তিনি জানাচ্ছেন, “যারা এই #EncounterNight নিয়ে এত মাতামাতি করছেন, তাঁদের অনেকেই আদালতে চলা মামলাগুলির ঢিমে গতি এবং অন্যায় শাস্তি প্রদানের কারণে আইনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। এর জন্য বিভিন্ন সময়ের সরকার পক্ষরাই দায়ী।” তিনি আশা করেন তেলেঙ্গানা ঘটনাবলির পর কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙবে। “যদি ভাঙে, তাহলে তিনটি আশু কর্তব্য আছে সরকারের। এক, লিঙ্গভিত্তিক মানসিকতা পরীক্ষা করবার পর নতুন বিচারক ও পুলিশ নিয়োগ; দুই, তদন্তে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক আসামীদের ধরা এবং তিন, সাক্ষীদের জীবনরক্ষার জন্য মজবুত ব্যবস্থা গঠন।” তিনি সবাইকে এই বলে সতর্ক করেন, “যে পুরুষপুঙ্গবেরা আজ ট্যুইটারে নাচানাচি করছেন (“macho men dancing in the Twitter streets right now”), তাঁরাই বিবাহিতা স্ত্রীর উপর স্বামীর যৌন অত্যাচারকে সমর্থন করবেন, বিবাহোত্তর ধর্ষণ এবং ৪৯৮-এ ধারাকে আইন বানানোর জন্য লড়াই করবেন।”

জাস্টিস বর্মা কমিটির প্রসঙ্গ তুলে করুণা নন্দীর বক্তব্য যে মহিলা আইনজীবীরা নিয়মিত ধর্ষণের মামলা লড়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কেউই চান না অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড হোক। কারণ দুটি। প্রথমত, এই চরম শাস্তির অনেকগুলি দিক আছে। এবং দ্বিতীয়ত, একজন ধর্ষকের ফাঁসি হলে সম্ভাব্য ধর্ষকদের মনে বিশেষ প্রভাব পড়বে না। সেই কারণে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনগুলিকে আরও জোরালো করা প্রয়োজন।” নিজের দৈনন্দিন পেশাগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাই তিনি স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তোলেন, “ধর্ষণের এত দিন পরে তেলেঙ্গানা পুলিশ ভোর সাড়ে তিনটের সময় তদন্ত করতে বেরোলই বা কেন? ধর্ষণের অব্যবহিত পরে, যখন প্রমাণগুলি অক্ষুণ্ণ থাকে (golden hours), তরুণী পশুচিকিৎসকটি যখন জীবিত ছিল, তখন তো তাঁরা মেয়েটির এফআইআর লিখতে অস্বীকার করে ঘুমিয়ে ছিলেন।”