Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

টালা ব্রিজ মেরামত: উন্নয়ন, উচ্ছেদ ও বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের নাগরিক অধিকারের দাবিতে লড়াই

সৌম্য চট্টোপাধ্যায়

 

টালার উচ্ছেদের পটভূমি ও পুনর্বাসনের দাবিতে পাল্টা লড়াই 

এ বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ ‘স্বাস্থ্যপরীক্ষা’র রিপোর্ট পেয়ে টালা ব্রিজ মেরামতের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারি আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মারফত। কিন্তু শহর কলকাতার আমরা কেউই প্রায় জানতে পারিনি মহালয়ার ঠিক আগে আগেই, গত ২৪শে সেপ্টেম্বর, টালা ব্রিজের নীচে ও আশেপাশে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষদের হঠাৎ উঠে যেতে বলা হয় তাদের এতদিনকার বাসস্থান ছেড়ে দিয়ে। না, এর জন্য কোনও লিখিত নোটিস তাঁদের দেখানো হয়নি। পুলিস ও লোকাল কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান এসে হুমকি, ভয় দেখিয়ে উঠে যেতে বলে রাতারাতি। কোথায় যাবেন তাঁরা, কীভাবে থাকবেন এ নিয়ে কোনও আলোচনা করা তো দূরে থাক, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি তাদের শরীরী ও মুখের ভাষায় বুঝিয়ে দেয় এই মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। অন্য কোনও উপায় না দেখে বস্তিবাসী খেটে-খাওয়া মানুষগুলো সেদিন বিটি রোড অবরোধ করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল— সরকার জানাক এত কটা পরিবারের মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়া হবে কিনা, দিলে কীভাবে কোথায় দেওয়া হবে, তা স্থায়ী নাকি অস্থায়ী চরিত্রের এবং অস্থায়ী হলে কতদিনের মধ্যে স্থায়ী পুনর্বাসন দেওয়া হবে। সরকারপক্ষ বেগতিক বুঝে সুর নরম করে ও নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় নামে। কখনও বলা হয় মানিকতলা সাহিত্য পরিষদে থাকার ব্যবস্থা করা হবে, কখনও বা বলা হয় অস্থায়ী টিনের ঘরের ব্যবস্থা করা হবে ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত কোনওটাই করা হয় না। পুনর্বাসনের নাম করে প্লাস্টিকের অস্থায়ী কিছু ছাউনির বন্দোবস্ত করা হয় চিৎপুর রেলওয়ে ইয়ার্ড ও প্রাণকৃষ্ণ মুখার্জি রোডে খালপাড় বরাবর।

টালা ব্রিজের নীচে তিনটে অংশে শ্রমজীবী মানুষ ঘর বেঁধে থাকতেন। একটা শ্যামবাজারের দিকে, একটা পাইকপাড়ার দিকে, আরেকটা ব্রিজের মাঝামাঝি ঘোষবাগান এলাকায়। সব মিলিয়ে শতাধিক পরিবার। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এইভাবে বিনা নোটিসে, হুমকি আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্যামবাজারের দিকের প্রায় ৬৫টা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয় যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই। এতগুলো পরিবারের শৌচাগারের কোনওরকম ব্যবস্থা করা হয়নি, করা হয়নি পানীয় জলের ব্যবস্থা। বৈদ্যুতিক পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয় শুধুমাত্র বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটার সময়সীমার জন্য। এই মানুষগুলো ৬০-৭০ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করে আসছেন পারিবারিকভাবে। প্রায় সকলেরই এখানকার ঠিকানায় ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি ন্যায্য পরিচয়পত্র আছে। সকলেরই বাড়িতে গ্যাস, ইলেকট্রিকের কানেকশন আছে। এনাদের মধ্যে কেউ গৃহশ্রমিক, কেউ রিক্সাচালক, ছাতু বা ঝালমুড়ি, ফুচকা বিক্রি করেন, কেউ বা অ্যাম্বুলেন্স চালান, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন, অনেকে আবার ছোটখাটো কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রত্যেকেই শ্রম দিয়ে এই শহরটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। অথচ তাঁদের পরিশ্রমের অর্থে একটু একটু করে পায়ের নীচে বা মাথার ওপরের যে ছাদটা তাঁরা পাকা করলেন সামান্য একটু ভালো থাকবার আশায়, এক ধাক্কায় সেগুলো কেড়ে নিয়ে মানুষের থাকার প্রায় অযোগ্য একটা পরিস্থিতিতে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হল!

তিনজন ক্যান্সার রোগী, দুজন গর্ভবতী মহিলা সহ প্রায় পঞ্চাশজন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া নিয়ে এতগুলো পরিবারের ঠাঁই হল দুর্গন্ধময় নোংরা নর্দমার পাশে আর ব্যস্ত রাস্তার ধারে খালপাড়ের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে। প্লাস্টিকের ঘরগুলো চূড়ান্তভাবে দাহ্য। নেই কোনও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। অন্ধকার ঘুপচি ঘরে যে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না, তখন আলোও প্রায় থাকে না বলতে গেলে। সেই অবস্থায় কীভাবে পড়াশোনা করবে এতগুলো পড়ুয়া ছেলেমেয়ে যাদের মধ্যে পাঁচজন এবারের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী? অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পড়ে দুজন— একজনের বয়স ১৩, আরেকজনের ১৮। কয়েকঘণ্টার বৃষ্টিতেই নর্দমার আবর্জনাপুষ্ট নোংরা জলে ঘর থইথই করে।

এইভাবে প্রায় দেড়মাস চলার পর গত ৬ই নভেম্বর PWD-র তরফ থেকে একটা নোটিস দেওয়া হয় এখানে এতদিন ধরে বসবাসকারী মানুষদের ‘অবৈধ জবরদখলকারী’ আখ্যা দিয়ে! সরকার কোন যাদুমন্ত্রে পূর্বে এই ‘অবৈধ জবরদখলকারী’দের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দিয়েছিল কে জানে! নোটিসটি শ্যামবাজার ও পাইকপাড়া দুই প্রান্তেই পড়ে। এর আগে, মৌখিকভাবে হুমকি দিয়ে উচ্ছেদ করানোর পরে পরেই, PWD, KMDA, KMC, চিৎপুর থানা সর্বত্রই ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছিল পুনর্বাসনজনিত সমস্যার সুরাহা করার জন্য। কোনও লাভ হয়নি তাতে। নোটিস পড়ার পর আরও বেশ কয়েক দফা ডেপুটেশন কর্মসূচি চলে। ডেপুটেশন দেওয়া হয় ১ নং বরো অফিসে। আরও একবার স্পষ্ট করা হয় টালার উচ্ছেদের মুখে পড়া বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের প্রধান দাবি “স্থায়ী ও উপযুক্ত পুনর্বাসন”। দাবি করা হয় “পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে একটা পরিবারকেও উচ্ছেদ করা যাবে না”। লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দলমতনির্বিশেষে বস্তির মানুষ গড়ে তোলেন “বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি – টালা”।

১১ই নভেম্বর শ্যামবাজারের দিকে ঘর ভাঙতে পুলিশবাহিনি নিয়ে এলাকায় উপস্থিত হয় PWD-র কর্মীরা। সম্মিলিত জনতার চাপে পড়ে তারা কথা দিতে বাধ্য হয় যে শুধুমাত্র তাদের ঘরই ভাঙা হবে যারা প্লাস্টিকের অস্থায়ী ঘর পেয়েছে। তখনও অব্দি শ্যামবাজারের দিকে প্রায় ১০টি পরিবার ছিল যারা প্লাস্টিকের ঘর পায়নি। তাদের জন্য অবিলম্বে বসবাসের ব্যবস্থা করার দাবিতে এবং সকলের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের দাবিতে মানুষ আবারো রাস্তায় নামেন। কয়েকশো মানুষের একটি মিছিল বরো অফিস অভিযান করে এবং তার সামনে ধর্নায় সামিল হয়। বরো চেয়ারম্যান তরুণ সাহাকে বাধ্য করা হয় বাইরে এসে বস্তিবাসী জনতার সঙ্গে কথা বলতে। চাপে পড়ে তিনি কথা দেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাকিদের জন্য প্লাস্টিকের ঘর এবং সকলের জন্য শৌচাগার-স্নানাগারের ব্যবস্থা করা হবে। বস্তিবাসী খেটে-খাওয়া মানুষ আরও একবার সাক্ষী থাকলেন সরকারপক্ষের মিথ্যাচারের। শ্রমজীবী মানুষের সমস্যার ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা কোন মাত্রায় তা বুঝতে বাকি থাকে না যখন দেখি উল্লিখিত নির্দিষ্ট সময়সীমার একমাস বাদে আজও একটা শৌচাগার নির্মাণ সম্পূর্ণ করে উঠতে পারে না তারা। তৈরি হয় না সকলের জন্য অস্থায়ী চরিত্রের প্লাস্টিকের ঘরটুকুও।

শাসক দলের যারা এতদিন ধরে ভোট চাইবার সময় একবারও ব্রিজের তলায় আসতে ভুল করেনি, তারাই এখন প্রশ্ন তুলছে মানুষগুলো ব্রিজের তলায় এল কার অনুমতি নিয়ে! আজ সরকারি বিজ্ঞপ্তি যখন এক লহমায় বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষগুলোর বাসস্থানকে ‘অবৈধ জবরদখল’ হিসেবে চিহ্নিত করছে, তাদের রক্ত-ঘামের ফসল এই শহরটার বৈধতাকেও কি তা প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলছে না?

শুরু থেকেই টালার বস্তিবাসী মানুষ বুঝেছিলেন একসঙ্গে লড়ার জোরটা কোথায়। সেই লড়াইকে জোরদার করতে,  শহরের অন্যান্য গণতন্ত্রপ্রেমী, সহানুভূতিশীল নাগরিককে লড়াইয়ের পাশে পেতে “বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি –  টালা”র পক্ষ থেকে গত ১৮ই নভেম্বর বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিতে এক কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। শহরের রাজপথ ধরে মিছিল করে গিয়ে সেই কনভেনশনে যোগ দেন বস্তির কয়েকশো মানুষ। সভায় এসেছিলেন অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি, স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী ও নানান সংগ্রামী শক্তি। যদিও মূল আলোচ্য বিষয় ছিল উচ্ছেদের মুখে পড়া টালার বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের “স্থায়ী ও উপযুক্ত পুনর্বাসন”-এর দাবিতে এই লড়াইকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তবুও প্রসঙ্গক্রমেই উঠে আসে শহরের বস্তিবাসী শ্রমজীবী জনগণের বাসস্থানের সমস্যার সাধারণ দিকগুলো। কনভেনশনের শেষে বস্তিবাসী খেটে-খাওয়া জনতার সংগ্রামী উদ্দীপনার পারদ কয়েকগুণ চড়ে যায় যেন! আবারও রাস্তায় স্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে ফিরে আসা হয়। স্লোগানের স্বর ধেয়ে যায় পুলিশের দিকে, শাসক দলের মিথ্যাবাদী নেতানেত্রীদের দিকে, সরকারের উদাসীনতার দিকে।

রাস্তার লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনি লড়াইকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে ইতিমধ্যে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয় টালার বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষদের পক্ষ থেকে। গত ২৫শে নভেম্বর বিচারক বিষয়টি মানবিক দিক থেকে দেখার ওপর জোর দেন এবং সরকারপক্ষকে নির্দেশ দেন ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যাপারে তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা হলফনামা মারফত জানাতে। পরবর্তী শুনানির তারিখ ৭ই জানুয়ারি, ২০২০। আদালত  বিষয়টিকে মানবিকভাবে দেখতে বললেও, যেভাবে মানুষগুলোর থাকবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সরকার দায়সারাভাবেই আইনের চোখে নিজেদের মুখরক্ষাটুকু করতে আগ্রহী, তার বেশি কিছু নয়। মানুষের বসবাসযোগ্য পরিবেশ কেমন হওয়া উচিৎ তার ন্যুনতম মানদণ্ডটুকুও যদি আইনের ভাষায় সংজ্ঞায়িত করে দিতে হয় তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা অনেক গভীরে।

এর পরে একই পরিণতির মুখে পড়েছেন পাইকপাড়ার দিকের বাসিন্দারাও। তাদের প্রায় ২০টি পরিবারকে গত ৬ই ডিসেম্বর একইভাবে উঠিয়ে দিয়ে প্লাস্টিকের ঘরে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। সেই একইরকম অপ্রশস্ত ঘুপচি ঘরে, কলকাতা স্টেশনের কাছে ব্যস্ত রাস্তা আর খালের মাঝের খোলা জায়গায় থাকার বন্দোবস্ত। একদিকে মাথার পাকা ছাদ কেড়ে নিয়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এরকম দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে, দায়সারাভাবে তৈরি করা প্লাস্টিকের ঘরে, শৌচাগার তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই, অন্যদিকে কারও থেকে উপার্জনের একমাত্র সম্বল ঝালমুড়ি বিক্রি করার ঠেলাটাও কেড়ে নিচ্ছে পুলিশ নিতান্তই নির্দয়ভাবে। আবার জায়গাটায় নেশাখোরদের উন্মুক্ত আড্ডা। মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত মানুষ, কিন্তু বলবে কাকে? সরকারপক্ষের কাউকেই যে ভরসা করা যাচ্ছে না আর!

ঘোষবাগানের প্রায় ৩০টি পরিবারকেও উঠিয়ে দেওয়া হবে আগামী কদিনের মধ্যেই। তাঁদের পরিণতিও একই হতে চলেছে।

এযাবৎ সরকারিভাবে যেটুকু যা ব্যবস্থা করা হয়েছে তা আদায় করা গেছে একসঙ্গে লড়াই করার মধ্যে দিয়েই। সেই যৌথতা ও লড়াইয়ের মেজাজকে ধরে রাখার জন্য “বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি, টালা”র পক্ষ থেকে মাসে একাধিকবার যৌথ রান্নাঘর, স্বাস্থ্য শিবির, পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ কোচিং-এর আয়োজন করা হচ্ছে। লড়াইয়ের সলতেকে জ্বালিয়ে রাখার কাজ চলছে।

 

”এ শহর কার?”— শহরের ওপর অধিকারের প্রশ্ন ও বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের বাসস্থানের সমস্যার সাধারণ ছবি

প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার “ওড়িশার বস্তিবাসীদের জন্য জমির অধিকার আইন ২০১৭”-র মতো বস্তিবাসী মানুষের বাসস্থান ও জমির অধিকার সংক্রান্ত কোনও বিশেষ আইন এখনও অব্দি আমাদের রাজ্যে নেই। ওড়িশাতেও দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলনের হাত ধরেই এই আইনি অধিকার অর্জন করা গেছে। যদিও দেখা যাচ্ছে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে এখনো বহু ক্ষেত্রে বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষদের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। UN Habitat III-র মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনেও ভারত সরকার সুরক্ষিত ও পরিবেশবান্ধব বাসস্থানের পক্ষে সাক্ষর করে এসেছে যেখানে ‘শহরের ওপর অধিকার’-এর মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। “সকলের জন্য বাসস্থান” আজকে দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ চর্চার বিষয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সর্বত্রই শহরের উন্নয়নের সঙ্গে শহরের বস্তিতে থাকা খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নের সম্পর্ক যেন বড় নির্লজ্জভাবেই ব্যস্তানুপাতিক!

আমাদের দেশে গ্রামীণ কৃষিকাজভিত্তিক পেশার সঙ্কট যত বেড়েছে, পেটের তাগিদে শ্রমজীবী মানুষের নগরাভিমুখী যাত্রা তত বেড়েছে। এর সিংহভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। পুঁজি আর শ্রমের দড়ি-টানাটানি খেলায় উৎপাদনের এই অসংগঠিত চরিত্র ও শ্রমের সামাজিকভাবে দুর্বল অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে পুঁজি তার শাসনের জোয়ালকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই প্রক্রিয়ায় শহরের শ্রমজীবী মানুষদের একটা বড় অংশের এরকম মনুষ্যেতর জীবনযাত্রা বজায় রাখাটা পুঁজির গড় মুনাফা সর্বোচ্চ করার ‘পবিত্র’ কর্তব্যর প্রয়োজনীয় শর্ত হয়ে উঠেছে। ফলে খাতায়-কলমে বা মানবিকতার দোহাই দিয়ে যতই চুক্তিপত্র সাক্ষর হোক না দেশে-বিদেশে, বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের শহরের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার অর্জন আসলে প্রকৃত রূপে সম্ভব পুঁজির কাঠামোগত শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই। একদিকে ভোটমুখী দলগুলোর ”পাইয়ে-দেওয়া”র রাজনীতি, তাদের ভোটবাক্স ও মিটিং-মিছিল ভরাতে শ্রমজীবী মানুষদের ব্যবহার করা; অন্যদিকে তার বিপ্রতীপে শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব স্বার্থভিত্তিক সংগ্রামী সংগঠন। প্রথমটা ইতিমধ্যেই জিতে বসে আছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা জেতা-হারার ওপরই নির্ভর করছে বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ।