Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্যাববিরোধী গণআন্দোলন প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে নয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হোক

সৌমিত্র দস্তিদার

 

রিপ ভ্যান উইঙ্কল আচমকা আবার জেগে উঠেছেন। আমরা তাঁর হাত ধরে পৌঁছে গেছি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়। তবে তখনকার মুসলিম লিগের নেতৃবৃন্দ অদৃশ্য। না আছেন শের-এ-বঙাল ফজলুল হক। না আছেন আবুল হাশিম। কিম্বা হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কেউ কোত্থাও নেই। নেই বলাটা বোধ হয় ঠিক নয়। কারণ তাঁরা আছেন জনমনে। স্মৃতিতে। ক্লাবে। চায়ের দোকানে। জনসভায়। আর নতুন নতুন আখ্যানে। যে আখ্যান নতুন করে নির্মিত হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী মস্তিষ্কে। আর তা সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম শহরে।

অনেকদিন পরে প্রবীণ মানুষদের একটু আধটু খাতির বেড়েছে। আশি-পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ স্মৃতিচারণ করছেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন কিশোর থেকে প্রৌঢ় সব বয়সের অসংখ্য মানুষ। বৃদ্ধ নাটকীয় গলায় বলছেন ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট ভয়ঙ্কর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এর কথা। “প্রথম তিনদিন শুধু মুসলিম গুন্ডাদের একতরফা আক্রমণ। হিন্দু পাড়ায় কান্না আর আতঙ্ক। পরের দিন থেকে পাল্টা মার।” বুড়োকে ঘিরে ভিড় শুনতে শুনতে উত্তেজিত। চোয়াল শক্ত জনতা মনে মনে চলে যাচ্ছেন ৪৬-এ। এই আখ্যানে কোথাও নেই লৌহমানব বল্লভভাই প্যাটেলের বিবৃতি যে কলকাতায় শেষ অবধি আমরা হিন্দুরাই জিতেছি। কোথাও নেই ভিক্টোরিয়া কলেজের হিন্দু মেয়েদের কীভাবে নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়ে ছিলেন ট্রামচালক, মুসলিম লিগের শ্রমিক নেতা মহম্মদ সেলিম। কীভাবে আজকের কলেজ স্ট্রিটের কালিকার চপের দোকানের ঠিক ওপরে জুবিলি ইনস্টিটিউটের বাচ্চাদের কারা মেরেছিল নৃশংসভাবে, সেসব অপ্রিয় অস্বস্তিকর প্রশ্ন। শুধু অর্ধসত্য অথবা পুরোপুরি মিথ্যে কাহিনি মগজে দক্ষতার সঙ্গে চারিয়ে দিতে দিতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নতুন করে জাগিয়ে তোলে আমাদেরই প্রতিবেশী মুসলিমদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্রোধ আর অপরিসীম ঘেন্না। ৪৬-৪৭ সালের দেশভাগের পর কত বছর কেটে গেছে। সবসময় মধ্যবিত্ত হিন্দুমানসে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়ে গেলেন মুসলমান জনগণ। ওই মাঝেমধ্যে সেকুলার সাজি-টাজি। কিন্তু সত্যিকারের সেকুলার হতে আমাদের বয়েই গেছে। আমাদের সেকুলারিজম মানে অবশ্যই মাঝেসাঝে ঈদের দুপুরে কোনও এক মুসলিম বন্ধুর বাসায় বিরিয়ানি খাওয়া, ফিরে এসে ফেবুতে ছবি পোস্ট। দুদিন বাদে সেই আমরাই ফিসফিসিয়ে বলি, “নেড়ের বাচ্চাদের বড় বাড় বেড়েছে।” আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা মানে একটু-আধটু রবীন্দ্রনাথ চর্চা বা মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম… পাঠ বা বাবরি বা গুজরাত গণহত্যা হবার পর শান্তি মিছিল, সেমিনারে উদাত্ত গলায় দেশের সংহতি নিয়ে ভাষণ। অথচ কোনওদিনই চিনতে চাইনি প্রতিবেশী মুসলিমদের। চিনলে আজ এই মেরুকরণের ছবি দেখতে হত না। যে ‘ভদ্দরলোকেরা’ সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সেমিনার করছেন তিনিই আড়ালে-আবডালে হিসহিসিয়ে বিষ ঢালছেন— মুসলমান মানেই অশিক্ষিত। দেশের শত্রু। গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা জন্ম দেয় ওদের মেয়েরা। আর পুরুষেরা তিনটে চারটে করে বিয়ে করে। আর এখন তো পরিস্থিতি আরও জটিল। ১৯৪৭ দেশভাগের কাহিনি ফিরে আসছে। হিন্দু নির্যাতনের সত্যি-মিথ্যে-আধা সত্যি আখ্যান উঠে আসছে। এই বিপুল পল্লবিত বিস্তারে কোথায় ধামাচাপা পড়ে গেছে সুপ্রাচীন মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা, গুজরাত, নেলি, ভাগলপুর, মুজাফফরপুর, মুম্বই-এর অসংখ্য মুসলিম নিধন যজ্ঞ।

‘যো হিন্দু কী হিত করেগা ওহি দেশমে রাজ করেগা’-র স্লোগানের পাশাপাশি সারা ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আমরা শুনছি— হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থান/মুসলিম ভাগো পাকিস্তান। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অমিত বিক্রমে প্রকাশ্যে তাঁরই দেশের সহনাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করছেন। আমরা সজ্জন ভদ্দরলোকেরা মুগ্ধ হয়ে তারিফ করছি। একবার, একবারও সঙ্কটকালে প্রতিবেশীর পিঠে হাত রাখার প্রয়োজনটুকু বোধ করছি না। আসলে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকাংশই চাই মুসলিম-মুক্ত ভারত। বিসমিল্লা থেকে বাবা আলাউদ্দিন, আল্লারাখা রহমান থেকে রশিদ খান, এরকম অজস্র মণিমুক্তোশূন্য, দরিদ্র, একমাত্রিক দেশ হয়ে আগামীর ভারত এগোতে চায়। পশ্চিমবাংলায় এখন দেশভাগের সময় ফিরে এসেছে। এখন শুধু ওরা আর আমরা। ওরা খারাপ আর আমরা ভালো। সারাজীবন তাদের কাটা, নেড়ে, মোল্লা, ঘুষপেটিয়া, উইপোকা বলে অপমান করতে আমাদের বাধেনি। এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুসলিমদের কিছু অংশ বিশৃঙ্খল হতেই বাবু সমাজে গেল গেল রব উঠেছে। ট্রেনে পাথর ছোঁড়া, আগুন দেওয়া বা রাস্তা আটকে দেওয়ার মতো নৈরাজ্য সৃষ্টি সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু যারা এসব কাজ করছেন তাদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় কোন ভয়ের পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছেন। বাবুদের নবারুণ ভট্টাচার্যের ফ্যাতাড়ু পড়তে, দেখতে ভালো লাগে। অথচ বাস্তবের ফ্যাতাড়ুরা রাস্তায় নামলেই তাদের হিতোপদেশ দিতে আর ঘেন্না করতে বাধে না। আমাদের দুর্ভাগ্য এ রাজ্যের অধিকাংশ ইন্টেলেকচুয়ালের সঙ্গে মাটির যোগ নেই। এ সময় আফশোস হয় কেন আজ এরাজ্যে মানিক বন্দোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দীপেন বন্দোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত বা ওপারের জহির রায়হান, আহমেদ ছফার মতো আর কেউ অবশিষ্ট নেই!

এতবছর একসঙ্গে বাস করার পরেও আমরা প্রতিবেশী মুসলিমদের চিনি না বা চিনতে চাইও না, এ কোনও গর্বের বিষয় নয়। ঘেন্না না করে ভালবাসুন। দেখবেন যতটা খারাপ ভাবছেন সবাই অতটা খারাপ না। তারাও দোষেগুণে আমার আপনার মতোই সাধারণ মানুষ।

কত কত জায়গায় তো আপনারা যান। একবার দুবার কষ্ট করে যান না হাড়োয়ার পীর গোরাচাঁদের মাজারে। বেঁড়াচাপায় দেখে আসুন প্রাচীন চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতা। চাঁদ রাত বা নবীদিবসে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া গ্রামবাংলায় ঘুরে বেড়ান। শত শত বছরের মুসলিম সভ্যতার সঙ্গে সংবেদী মন নিয়ে পরিচিত হোন। আমরা, ভদ্দরলোকেরা আমেরিকা ইওরোপের অলিগলি চিনি কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোনও ধারণা নেই। শ্রদ্ধা নেই। নেই ভালবাসা।

নিশ্চয়ই আজকের দাঙ্গাহাঙ্গামার পিছনে দেশভাগ-পরবর্তী মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগ আছে। অসমে যখন এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে বরপেটা, কোঁকরাঝোরে, কাজিরাঙ্গা জঙ্গলের পাশের বসতিতে বাঙালি মুসলমান খুন হন তখন আমরা, কলকাতার ইনটেলেকচুয়ালরা নীরব থাকি। আসলে আমাদের স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতাও কেমন যেন একপেশে। আজ মিডিয়া যেভাবে সরাসরি একটা সম্প্রদায়ের ওপর দাঙ্গাহাঙ্গামার সব দায় চাপাচ্ছে, গুন্ডা গুন্ডা বলে মেরুকরণের পথ প্রশস্ত করছে, মনে করে দেখুন তো রামনবমীর দিনে সঙ্ঘপরিবারের প্রকাশ্যে হাতে অস্ত্র নিয়ে মিছিলের সময় তারা এতটাই সোচ্চার ছিল কিনা!!

কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পরে মুসলমানের কাজ দেশের স্বার্থে নীরব থাকা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিতর্কিত রায়— দেশের স্বার্থে মুসলমানের কর্তব্য চুপচাপ থাকা। সবসময় শান্ত থাকার একতরফা দায় মুসলিম সম্প্রদায়ের। সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতো বছরের পর বছর তাদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। আইন, আদালত, সরকার কোথাও কোনও রক্ষাকবচ নেই যে জনগোষ্ঠীর, তারা হতাশ আতঙ্কিত হয়ে বেচাল হলেই গণতন্ত্রের পূজারীদের বিষতীর ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসবেই তাদের দিকে। নাগরিক সংশোধনী নতুন আইনে সবাই বুঝছেন আরএসএস তাদের দীর্ঘদিনের অ্যাজেন্ডা হিন্দু রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করতে শুরু করে দিয়েছে। মুসলিম জনগোষ্ঠী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে চলেছে তাও বোঝা খুব কষ্টকর নয়। তখন মুসলিমদের বড় অংশ যে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন তা জানতে কাউকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হতে হয় না। সারা দেশে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে ক্যাব বাতিলের দাবিতে। সবসময় সে বিক্ষোভে আর সংগঠিত রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্ব থাকছে না। স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সময় সময় গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বেহিসেবি হবে। অরাজক হবে। এটা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা নতুন নয়। বুর্জোয়া বিপ্লবের কালে খোদ ফ্রান্সে নৈরাজ্যবাদীদের বড়সড় ভূমিকা ছিল। তবে এটাও ঠিক যে এ ধরনের অরাজকতা চলতে থাকলে নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ফায়দা হবে বিজেপির। এটা বিজেপির একধরনের ফাঁদ। রাজনীতির অর্থনীতির সব দাবি থেকে মানুষের মুখ ফেরাতে ধর্মের তাস খেলা। তাই ক্যাববিরোধী গণআন্দোলনের অভিমুখ যেন প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে না হয়, রুটিরুজির  দাবিতে এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হয়, সে কথা সবাইকে বুঝতে হবে।