Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নতুন জোড়া আইনের নাগপাশে নারী

প্রতিভা সরকার

 

এনআরসি আর ক্যা নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে প্রচণ্ড দমনপীড়ন, গোধরা করে দেবার হুমকি, শিশুসহ বহু মানুষের প্রাণ চলে গেলেও তা থামবার কোনও লক্ষণ নেই। বরং নিত্যনতুন মিছিল, প্রতিরোধ ইত্যাদির খবর আসছে। হিংসা অনুমোদন করি না বলে যারা এই দুর্দিনে বকধার্মিক, তারা কই রাষ্ট্রহিংসার বিরুদ্ধতা করছে না তো! অথচ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আন্দোলনকারীরাই নষ্ট করছে এরকম কোনও পাথুরে প্রমাণ এখনও নেই। বরং ছদ্মবেশী স্বয়ংসেবকের কীর্তি ও দিল্লিতে পুলিশের বাসে আগুন লাগানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। জামিয়া মিলিয়ার লাইব্রেরির পড়ুয়ারা অব্দি ছাড় পায়নি রক্তপাতের হাত থেকে। কিন্তু দিল্লি পুলিশের হাতে যারা ধরা পড়েছে, কিমাশ্চর্যম, তারা কেউই ছাত্র নয়।

হিংসা একবার ছড়িয়ে পড়লে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন। তাই কোনও পক্ষের হিংসাই অনুমোদন যোগ্য নয়।

গোটা বিশ্বের মেয়েরা বেশিরভাগই হিংসার বিপক্ষে। কারণ হিংসা তার স্বাভাবিক জীবন, শিক্ষা, কাজ, এমনকি বাইরে বেরোবার অধিকারও সঙ্কুচিত করে যে কোনও পুরুষের থেকে বেশি। উপরন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েরা বহুকাল অবরোধবাসিনী হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে, যদিও স্বাধীনতার কারণে সশস্ত্র সংগ্রামে কোনও কোনও প্রদেশের মেয়েদের অংশগ্রহণ বিস্ময়কর। সে যাই হোক নিজেরা হিংসার আবর্তে গিয়ে পড়া বা নিজের প্রিয়জনকে ঠেলে দেওয়া, এ কোনও স্বাভাবিক মানুষই চাইবে না। কিন্তু রাস্তায় নেমে যে আন্দোলন এখন এদেশে রোজ নিজের পরিধি বাড়াচ্ছে, দেওয়ালে-পিঠ-ঠেকে-যাওয়া ভারতীয় মেয়েরা তাতে বিপুলভাবে অংশ নিচ্ছেন। অহিংস উপায়েই নিজেদের নারাজি জানাচ্ছেন, মিটিং মিছিল প্রতিরোধ সবেতে থাকছেন। এমনকি পুলিশের লাঠি-গুলির মুখেও তারা বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত। সত্যিই মনে পড়িয়ে দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলি, যখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মেয়েরা, পুরুষের পাশে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন। সেই ইতিহাসের পাশে যোগ হতে চলেছে নারীবিদ্বেষী বিজেপি সরকারের নারীঘাতী শিশুঘাতী আইন এনআরসি এবং ক্যা-এর বিরুদ্ধে মেয়েদের আন্তরিক প্রতিরোধ, যে প্রতিরোধের আইকন জামিয়া মিলিয়ার অল্পবয়সী ছাত্রীদুটি, যারা সহপাঠীকে বাঁচাবার জন্য উদ্যতযষ্টি পুলিশের মুখের ওপর রক্তমাংসের তর্জনী তুলে ধরেছিল।

 

এই মরিয়া প্রতিরোধের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই দুটি কালা কানুনই প্রবলভাবে নারীবিদ্বেষী। এনআরসি তো প্যাট্রিলিনিয়াল লিঙ্ক বা পৈতৃক সূত্র বিজড়িত কোনও দলিল বা প্রমাণপত্র ছাড়া আর কিছুরই মান্যতা দেবে না। গতকালের আনন্দবাজার কাগজে খবর, বহুদিন আগে পিতার মৃত্যু ও নিজের বিয়ে হয়ে স্থানান্তরিত হবার কারণে এক মহিলাকে অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এত ছোটতে তার বিয়ে হয়েছিল যে বাবার গ্রামের কোনও প্রতিবেশী তাকে চেনে বলে সাক্ষ্য দিতে আসেনি। তার মায়ের নামে জমি থাকলেও সে দলিল বা মায়ের সাক্ষ্য কোনওটাই ট্রাইবুনাল দ্বারা গ্রাহ্য হয়নি। অনেক লড়াইয়ের পরে হাইকোর্ট থেকে আদেশ আনতে হয় যে মায়ের সাক্ষ্য গ্রাহ্য করতে হবে। তারপর সেই মহিলা ছাড়া পান। কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্পের জীবন ততদিনে তাকে মানসিক রোগী করে তুলেছে। যে ছেলে এত লড়াই করেছে তার মুক্তির জন্য, তাকেই তিনি চিনতে পারছেন না, আর চোখের আড়াল করছেন না নিজের মাকে। মা ছাড়া তার মুক্তি মিলত না এটা অসুস্থ মনও বুঝে গেছে। এইরকম প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কি পরিজনদের উচ্চ আদালতে দৌড়তে হবে? সেই হয়রানি, অর্থদণ্ড, মানসিক কষ্ট ও নষ্ট হওয়া সময়ের দায়ভার কার?

বোধহয়-স্বয়ম্ভূ এবং মাকে আইনি স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করা বিজেপি নেতাদেরও অনেক মূল্য দিয়ে বুঝতে হবে যে নারীকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে অস্বীকার করা মানে অর্ধেক আকাশকে দৃষ্টির বাইরে রাখা।

অসমে যে মহিলাদের নাম এনআরসিতে নেই তারা বেশিরভাগই শ্বশুরকুলের লিগ্যাসি দেখিয়েছিল। এরা প্রথাগত শিক্ষাহীন এবং হতদরিদ্র নিরক্ষর। ছোট বয়সে বিয়ে হবার দরুণ স্বামীগৃহের চৌহদ্দিই তাদের সব। কিন্তু পিতৃকুলের সঙ্গে সংযোগ না দেখাতে পারলে এদের পাঠানো হবে ডিটেনশন ক্যাম্প! আর কী দলিলই বা দেখাতে পারে এরা? নিজেদের স্কুল সার্টিফিকেট নেই, বাপের জমি নেই, সে হয়ত বর্গাদার চাষা, বহুকাল আগে মরে গেছে পৃথিবীতে তার অস্তিত্বের কোনও চিহ্ন না রেখেই। তার মেয়ে কিভাবে প্রমাণ করবে তার পিতৃসূত্র? মুসলমান মেয়েদের কাবিলনামায় বাবার সই থাকার কথা। কিন্তু বাবা যদি নিরক্ষর হয়? কাবিলনামা যদি বন্যায় নষ্ট হয়ে থাকে? কটা হিন্দু মেয়ের বিয়ে অজ পাড়াগাঁয়ে রেজেস্ট্রি করানো হয়?

সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতোই এক অসম্ভব এবং অবাস্তব পরীক্ষার সামনে ভারতীয় মেয়েদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এনআরসি। মেয়েদের নিজস্ব সম্পত্তিহীনতা, তাদের বঞ্চনা, পিতৃকুলের সম্পদ বাটোয়ারা হবার ভয় এবং তা থেকে মেয়েকে বাদ রাখবার নানা ছল, অন্য ধর্মে বিয়ে করা মেয়েদের এবং ট্রান্সজেন্ডারের বিপদের কথা লিখলে সে এক মহাভারত হয়ে যাবে।

এবার আসি ক্যায়ের কথায়। যে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিতদের প্রতি সহমর্মিতা এই আইনের ভিত্তি, ঠিক সেই ধরনের নির্যাতন বিশেষ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর নামিয়ে আনবার জন্যই এই আইন প্রণয়ন। এনআরসি তাও ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে বিনিমজুরির শ্রমিক বানাবার ধান্ধায় আছে, ক্যা একেবারে দেশান্তরী করাকে সিলমোহর দেবার ফিকির নিয়ে মাঠে নেমেছে। সব ধর্মের শরণার্থী ভারতে নাগরিকত্ব পাবে, মুসলমান বাদ। কারণ মুসলিম দেশে নাকি মুসলমান নিপীড়িত হয় না। শ্রীলঙ্কাও উল্লিখিত দেশের তালিকা থেকে বাদ, যদিও তামিল শরণার্থী সমস্যা খুব প্রকট। সংবিধান উল্লঙ্ঘনকারী ক্যা বিশেষ ধর্মের লোকেদের নাগরিক বলে স্বীকার করবে, তাতে সংখ্যাগুরুর মুখ বন্ধ থাকবে, আর এনআরসির সহায়তায় বেছে বেছে মুসলমানদের বেঘর করবে, এই হচ্ছে শাহেনশাদের মতলবের ব্লু প্রিন্ট। ক্যায়ের যা সব নিয়মকানুন হবে বলে শোনা যাচ্ছে, তাতে নিগ্রহের সাক্ষ্য চাই এবং এক্সিকিউটিভদের বা রূপায়ণকারী কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত ক্ষমতা, দুটোরই নিজস্ব বিপদ আছে। সব দেশের অমানবিক নিপীড়নকারী নিজের আইন নিজে সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের মদত ছাড়াও। যা তোর নিজের দেশে যেখানে নাগরিকত্ব নিয়ে সবাই বসে আছে, এইকথা বলে সে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর অব্দি গেলে যদি নাগরিকত্ব পাস, তাহলে এখন গেলে কেন পাবি না, এই ধরনের যুক্তিহীনতা আরও অনেক মানুষকে দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দেবে। এই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়, বরং ক্যা কোনও কোনও দেশে সংখ্যালঘুর দুর্দশা আরও বাড়াবে বলে ওয়াকিবহাল মহল আশঙ্কা করছেন।

অথচ কে না জানে, মেয়েদের মাথার ওপর ঘর চাইই। তার লালনপালনের হাত, তার আব্রু, তার সন্তান, তার মায়া তাকে ঘর হারাতে বারবারই বাধা দেয়। অনেক অত্যাচার সয়েও সে ঘরের মায়া কাটাতে পারে না তার প্রমাণ এই উপমহাদেশ জুড়েই আছে। এছাড়া আছে নারীমাংসের ব্যবসা, মানুষপাচার, অমানুষিক পেশায় জোর করে নামানো। এর ফলে যে কোনও বড় মাপের দুর্বিপাকে ঘরহারা মেয়েরা বিপদে পড়ে সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রদায়িক হানাহানি তার স্থিতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। লাঞ্ছিত হবার এবং চোদ্দ পুরুষের দেশ থেকে বিতাড়িত হবার আশঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই এক মেয়ের নিজের এবং পরিজনের সুরক্ষা ভাবনায় গভীর আঁচড় কাটবে। যে যে আইনের সাহায্যে এই বদ মতলব হাসিল করবার চেষ্টা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সে ফেটে পড়বেই। ভারতে নতুন আর এক যোগ আছে। নির্বাচনের সময় থেকেই অন্য ধর্মের নারীর লাঞ্ছনা হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মুখের লব্জ। এমনকি কবরে শুয়ে থাকা অর্ধগলিত নারীশরীরও নাকি রেহাই পাবে না। স্বাভাবিক, এই নীচ মানসিকতা সংখ্যালঘু নারীর মনে ভয় ও ঘৃণার জন্ম দেবে। তিনতালাক রদের সুর্মা চোখে পরলেও এই বাস্তব থেকে রেহাই নেই। আরও আছে লভ জেহাদ, লিঞ্চিংয়ের মতো মধ্যযুগীয় ফতোয়া।

সবমিলিয়ে মেয়েদের ওপর চূড়ান্ত অবদমন চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা না সংখ্যাগুরু নারীর চোখ এড়িয়েছে, না সংখ্যালঘুর। তাই হাতে হাত রেখে সব মেয়েরাই এই প্রতিবাদে সামিল।

আশ্চর্য, যে দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্বের জন্য জায়েজ বলা ঘোষণা হয়েছে তাদের কোনওটিতেই সুদূর অতীতে কোনও রাষ্ট্রবিপ্লব বা যুদ্ধনিগ্রহ ঘটেনি যে সেখান থেকে দলে দলে শরণার্থী আসবে। তালিকাভুক্ত শরণার্থীর ক্ষীণ সংখ্যাও তাই বলছে। পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশ উন্নতির প্রায় সমস্ত সূচকে এখন এ দেশের থেকে এগিয়ে আছে। ফলে সেখান থেকেও লোক আসা ক্রমাগত কমেছে। পাকিস্তানি হিন্দুসমাজ যাদের জন্য অমিত শাহের চোখ থেকে সবসময় সহানুভূতির অশ্রু ঝরে তারাও ঘৃণাভরে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ এই ভারতীয় প্রস্তাবকে খারিজ করেছে। পাকিস্তান হিন্দু কাউন্সিলের প্রধান রাজা অসার মঙ্গলানি সম্প্রতি বলেন, কোনও সত্যকারের হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই বিভেদের আইন সমর্থন করতে পারে না।

তাহলে তড়িঘড়ি এই আইন পাশ কেন? সেটা বুঝে ফেলেছেন বলেই ধর্মীয় কারণে বিভেদকরণের বিরুদ্ধে মেয়েরা আজ ঐক্যবদ্ধ। তাঁরা বুঝেছেন যে এই আইন দুটির মধ্য দিয়ে বিজেপি ভীতি, আনুগত্য এবং দাসত্বের এক বাতাবরণ তৈরি করতে চায় যা নারীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে মনুসংহিতার যুগে। এই চক্রান্ত রুখতেই হবে। তাই জামিয়া মিলিয়ার ভাইস চ্যান্সেলর থেকে শুরু করে সাধারণ মেয়েরাও আজ একই কাতারে।