চার নম্বর নিউজডেস্ক
একটা দেশ। কয়েকটা নাম। মুখ। লেখা। কলম। মাইটিয়ার দ্যান সোর্ড। এবং, সেই তলোয়ারের কোণায় লাগা সাম্প্রতিকতা, বেআইন এবং নুরেমবার্গীয় পোলার ভারত তৈরির বিরুদ্ধতা। চ্যালেঞ্জ। ডিটেনশন, হেনস্থা, লাঠিচার্জ, ব্যক্তিগত কুৎসা এবং সর্বোপরি সিয়াচেন তত্ত্ব— রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার ‘নিরো’স গেস্ট’-এর একটা পরিকল্পিত বাহিনির একচেটিয়াপনা। তবু, কথা বন্ধ হয়? স্বপ্নকণ্ঠ থামানো যায়?
অরুন্ধতী রায়। রাজনৈতিক প্রবন্ধ নির্মাণে যাঁর ভরসা নির্মোহ ভাষা, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং ভারতবর্ষকে হাতের মুঠোয় চেনার এক অলৌকিকতা। কেরল থেকে দিল্লি। যন্তর মন্তরের বিক্ষোভের নেতৃত্ব। বরাভয়। অনুজ সতীর্থের কাঁধে হাত। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং আপোসহীনতার কণ্ঠ। টুইটার। ‘Three years ago we stood in line obediently outside banks as demonetization was imposed on us, a policy that broke the back of our country’s economy. Now the National Register of Citizens coupled with the Citizenship Amendment Bill is set to break the back of our constitution and cut the ground from under our feet.’ এই অরুন্ধতীরা রাখঢাক রাখেন না। বিষাক্ত এক আইনকে স্বাভাবিকভাবেই তুলনায় আনেন উনিশশো পঁয়ত্রিশের নুরেমবার্গ ল’র সঙ্গে। ইহুদি সেগ্রেগ্রেশন কিংবা আইন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া মুসলমান জনগোষ্ঠী। খুব কি তফাৎ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? অরুন্ধতী শেষ করেছেন এইভাবে— ‘স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আজ। স্ট্যান্ড আপ। প্লিজ স্ট্যান্ড আপ।’
দাঁড়ানো। পাশে বা মিছিলে। রামচন্দ্র গুহ। ঐতিহাসিক, রসবোদ্ধা, স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এক মানুষ। রামচন্দ্রও দাঁড়িয়েছিলেন। বেঙ্গালুরুর টাউন হলে। প্রতিবাদ। পুলিশি হেনস্থা। টানাহেঁচড়া। গ্রেপ্তারি। ‘I was arrested for speaking to the media about the constitution holding Mahatma Gandhi’s poster’। ঐতিহাসিককে এটুকু বলে যেতে দিল শাসকের পুলিশ। পাল্টা প্রত্যাঘাত মানুষের। পাশে থাকা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়। ভি রঘুনাথন, জহর সরকারের টুইট। প্রকাশ্যে শাসক দলকে লজ্জায় জিভ কাটতে বলা। রামচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করে গোটা বিশ্বের কাছে নাগরিক সংশোধনীর নামে একটা ড্রাকোনীয় বিষ ঢুকিয়া দেওয়ার মাহাত্ম্য জানিয়ে দেওয়া। দেশের রেপ্যুটেশন? কোথায় থাকবে? আছে কি কিছু? ছিল? শাসক যখন নখ দাঁত বার করে তখন তার মাথা স্বাভাবিক থাকে না। আর তাছাড়া নয়া ফ্যাসিস্ট ভারতবর্ষে এসব রেপ্যুটেশন ম্যাটার করে না। তাদের রামচন্দ্র বিজয় তো হয়েই গেছে বেশ কয়েকদিন আগে…
স্বরাজ্য অভিযানের যোগেন্দ্র যাদব। লাল কেল্লা থেকে পুলিশি গাড়িতে ওঠার আগে বলে গেলেন— ‘It is an honour to be detained on 19th of December, a small tribute to Ashfakulla Khan and Ramprasad Bismil.’ পাশে দাঁড়ানো উমর খালিদের কণ্ঠে শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের ডাক। বিসমিল, আসফাকদের স্বপ্নের অপমৃত্যু আটকানোর ডাক। আজিমাবাদিদের মনে রাখার ডাক। সরফরোশি কি তামান্না…
লেখায় হিন্দু পুরাণের কথা এনেছেন বারবার। মিথ এবং ফিকশনের একধরনের ব্লেন্ডিং, সঙ্গে চোখা হিউমার। পরিণতি, বেস্টসেলার। যদিও, লেখার গুণমান বিচার এ লেখার উদ্দেশ্য না। লেখক দেবদূত পট্টনায়ক সোশ্যাল নেটওয়ার্কে নিয়মিতভাবে সরব হয়েছেন। ‘যে রাজনৈতিক নেতারা কলেজ পেরোননি, তাঁরা ছাত্র রাজনীতিতে কিভাবে নাক গলাচ্ছেন?’ কিংবা, ‘যে ভারত ধর্মের ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের কথা ভাবে সে ভারত চিরপরিচিত ভারতবর্ষ নয়, বরং নাথিং বাট অ্যান অ্যান্টি-ইন্ডিয়া।’ অথবা তাঁর স্বভাবজাত মজায়, ‘প্রতিবেশী তিনটি দেশ থেকে আসা হিন্দুদের নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর গুজরাট আপন করে নেবে। ইকোনমিক বুস্টের দিকে যাচ্ছে দেশ।’ দালালির ভারতবর্ষে, পাইয়ে দেওয়া ভারতবর্ষে এই উচ্চারণ স্যালুটযোগ্য।
পাশে থাকা সেলুলয়েড। বলিউড। ক্যামেরার এপিঠ বা ওপিঠে থাকা মানুষের সমবেত উচ্চারণ। মুম্বই থেকে পুনে। রাহুল বোস, স্বরা ভাস্কর, সৈয়দ মীর্জা, ফারহান আখতার, হুমা কুরেশি এবং আরও অসংখ্য নাম। ‘I am personally very upset from CAA. Entire country is weeping, entire country is burning. If you still can’t see anything then it is unfortunate. If this is happening in our entire country and our young children have took to the streets then we have to notice that something is wrong.’ মুকেশ ভাটের প্রতিবাদ। সমান্তরাল, মূলধারা— ক্লিশের দেয়াল ভেঙে হেরিটেজ ভারতবর্ষ, মিলনের ভারতবর্ষ টিকিয়ে রাখার আকুতি।
এগারোশোটি কলেজ। হাজার দশেকের উপর ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক। আছেন রোমিলা থাপার, রাজমোহন গান্ধী, নোয়াম চমস্কি। ইলিনয়, অ্যারিজোনা বা জেএনইউ। জয়েন্ট পেটিশন। লিখিত বিবৃতি। ‘We are watching with extreme concern the situation unfolding at Jamia Millia Islamia and Aligarh Muslim University. We refuse to remain silent at the violence unleashed on our colleagues (students, staff, and faculty) peacefully protesting the imposition of a discriminatory and unjust law.’ আসমুদ্র হিমাচলের ভরসা। যাঁরা মিছিলে হাঁটেন না, তাঁরাও আসলে হাঁটেন। চমস্কি, রোমিলা ওই আলোটুকু দেখান।
সবকিছুর পরিণতি শাসকের ভয়। আরও অত্যাচার, ডিটেনশন এবং ধরপাকড়। দাগিয়ে দেওয়া আর্বান নকশাল। লাইব্রেরির ভেতর উর্দি আক্রমণ। গোধরা পরবর্তী গণহত্যার প্রকাশ্য উসকানি। শেষমেশ কোথায়? জানা নেই। তবু, এত উচ্চারণ ব্যর্থ হবে? হুলিগান মেরা ভারতের কাছে হেরে যাবে ঐতিহ্যের ভারতবর্ষ?
এত সহজ, এতই সহজ?