সঞ্জীব দেবলস্কর
দেশের বর্তমান হালচাল দেখে মনে হয় যে-জনগোষ্ঠী একটা সময় ভারতের জন্য অপরিহার্য ছিল এঁদের আর প্রয়োজন নেই এ দেশে। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি সর্বত্রই এদের দিকে তির্যক দৃষ্টি। যে দেশের রাষ্ট্রচিন্তা, জাতীয়তাবোধের উন্মেষ, শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষার অগ্রগতিতে যাঁদের ভূমিকা ছিল প্রথম সারিতে, এঁদের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা সর্বত্রই প্রকট। এই জাতিগোষ্ঠীই হচ্ছে বাঙালি। গালভরে আজও এরা উচ্চারণ করে এরা রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-বীর সুভাষের উত্তরসূরি, এই মহান দেশ নিয়ে এরা গর্বিত। এদের পিঠে আজ তকমা— বাংলাদেশি, বহিরাগত, উইপোকা ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের এই দুর্দশার কারণ অতি অবশ্যই দেশভাগ, যার নির্মম শিকার এই বাঙালিই। বিদেশি অনুপ্রবেশ, নাগরিকপঞ্জি থেকে ধর্মীয় হানাহানি, হিংসা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সবকিছুর মূলে ওই দেশভাগ। আজকের দিনে বহু আলোচিত এই সমস্যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ওই দেশভাগের প্রশ্নটি৷ একটি অখণ্ড দেশকে যখন দুই ভাগে ভাগ করা হয়, তখন অবধারিতভাবে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত অর্থাৎ বর্ডারের দুইপারের নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক থাকবে এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক কারণেও দুপারে আসা-যাওয়া থাকবে, যা ক্রমশ সমাপ্তির দিকে এগোতে থাকবে, যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।
ওই সবকিছু ঠিকঠাক থাকা বিষয়টি গোলমেলে। প্রথমত, একটা রাষ্ট্রের বুকের উপর কাঁচি চালালে সবকিছু ঠিকঠাক থাকাটা কষ্টকল্পিত ব্যাপার। আর দেশবিভাগটি আবার যদি ধর্মীয় কারণে সংঘটিত হয়, এবং বিভাজিত জনগোষ্ঠী যদি ধর্মীয় পরিচিতি ছাড়াও ভাষিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যগত দিকে একই জাতিসত্তার অন্তর্গত হন৷ তাছাড়াও সবকিছু ঠিকঠাকের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়ে বা স্বেচ্ছায় স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেই বসবাস করার উদ্দেশ্যে যাঁরা সীমান্তের এপারে চলে এসেছেন বা আসতে চেয়েছিলেন এদের জন্য নতুন কোনও আইনি সংস্থানের বিষয়টিও রয়েছে; রয়েছে বঙ্গ-অনুষঙ্গ জুড়ে থাকা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভিন্নতর প্রদেশ, যেমন অসম, মেঘালয় এবং অন্যত্র— যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাসকারী বাঙালিদের এবং এদের সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত বাঙালিদের সাংবিধানিক অধিকার কী হওয়া উচিত এ নিয়েও সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারণ। নইলে স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস মিলিয়ে যেতে না যেতেই হানাহানি, কলহ, সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়, লাগেওনি। এখানে স্মরণ করে রাখা প্রয়োজন, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ৫ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে অসম বিধানসভার প্রথম অধিবেশনেই লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলুই মন্ত্রিসভা অনুমোদিত রাজ্যপালের ভাষণেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ বাঙালিদের ‘হীনবীর্য’, ‘ক্ষমতাচ্যুত’ এবং ‘আগন্তুক’ বলে উল্লেখ করে রাজ্যবাসীকে এদের প্রতি ‘আনুগত্যের বিনিময়ে’ মানবিক আচরণের অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিলেন। এই রাজ্যবাসীর (অসমবাসী) মধ্যে জনজাতির সংস্থান থাকলেও বাঙালিদের তো সরিয়েই রাখা হল, তাই রাজ্যবাসী বলতে অসমিয়াভাষীকে বোঝানোর ইঙ্গিত একেবারে সুস্পষ্ট। অধিকন্তু এ কথাটিও বলা হয়েছিল, ‘বাঙালিরা আর সমতল এবং পার্বত্য অঞ্চলে আধিপত্য করতে পারবে না’। ইতিহাসের পরিহাসই এটা, দুইটি দশক পেরোতে না পেরোতেই অসমে ঘর ভাঙার পর্ব শুরু হয়ে গেল। নাগারা বেরিয়ে গেল (১ ডিসেম্বর, ১৯৬৩), এরপর আলাদা হল মেঘালয় (২১ জানুয়ারি, ১৯৭২), অরুণাচল প্রদেশ নাম নিয়ে নেফাও আলাদা হল (২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭), ওই একই তারিখেই আলাদা রাজ্য হল মিজোরাম। এ সমস্ত কিছুর পিছনে একটি-জাতিগোষ্ঠী না ভাষিকসত্তার আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠাই অন্যতম লক্ষ্য। প্রাক-স্বাধীনতা পর্ব থেকে অসমকে একভাষী রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্নই বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে গেল। ১৯৬০ সালে যখন অসম বিধানসভায় অসমিয়া ভাষাকে বিকল্পহীন রাজ্যভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব উত্থিত হল, এবং রাজ্যে বঙ্গালখেদা আন্দোলন সংঘটিত করে ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ঘটানো হল, ভাঙনের সুর সেদিনই পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হল। তবে আমাদের অধিতব্য বিষয় এটা নয়।
আমরা বলতে সূচনা থেকেই বৈধ ভারতীয়দের অধিকার অস্বীকার করার এ প্রবণতা আজকের দিনের এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিটির জন্ম দিয়েছে, যে পরিস্থিতির রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাচ্ছেন আজ নানা গোষ্ঠী, এবং এর নির্মম শিকার হচ্ছে বাঙালিরা।
আজ যে-নাগরিকপঞ্জির কথা উঠেছে, এর প্রথম এবং শেষ উদ্দেশ্যই বাঙালিকে অসমে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে রূপান্তরিত করা। ২০১৪ সাল থেকে এ নিয়ে এই জনগোষ্ঠীকে গভীর মানসিক, শারীরিক পীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ১৯ লক্ষ বাঙালিকে (সেই সঙ্গে ভ্রান্তিবশত কতিপয় জনজাতি, অসমিয়াভাষীকেও) নাগরিকত্ব-হারা করার পরেও আক্রোশ মেটেনি, অসমের প্রতিবেশী প্রদেশগুলিতে বিশেষ প্রকল্প নিয়েই জনজাতিদের বাঙালিদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে ওখানেও নাগরিক পঞ্জিকরণের আওয়াজ তোলা হয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি, একেবারে জাতীয় স্তরে বিষয়টি উত্থাপন করে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রশক্তিকে দিয়ে দেশব্যাপী নাগরিক পঞ্জিকরণের প্রকল্প গ্রহণের ব্যবস্থাও আজ পাকা। ইংরেজি বাক্যটি বুঝি আজকের দিনে নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে— ‘হোয়াট অসম থিংকস টু-ডে, ইন্ডিয়া উইল থিংক টু-মরো’।
দুই
সামনে হাজারটা গুরুত্বপূর্ণ কাজকে পেছনে রেখে ঠিক এই মুহূর্তেই দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জির আজ আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রগত চরিত্রলক্ষণই মূলত একটি ঔপমহাদেশীয়, এখানে নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুত করাটা কোনও চটজলদি কার্যসূচি বলে গৃহীত হতে পারে না, কোনও একটি প্রদেশের জাত্যাভিমানের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে তো নয়ই। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই পঙক্তিগুলো স্মরণে রাখা প্রয়োজন— ‘কেহ নাহি জানে, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা, দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা’। এরকম একটি দেশের যে কোনও নৃতাত্ত্বিক, ভাষিক কিংবা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে যাওয়া নিশ্চিত একটি অবাস্তব প্রকল্প। নিরপেক্ষ, সর্বজনগ্রাহ্য, ঐতিহাসিক, সমাজতত্ত্ববিদ, জনতত্ত্ববিদদের বাদ দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের মন্ত্রণাদাতাদের পরামর্শে এরকম কাজে নামলে বিপত্তি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেরকম কোনও প্রস্তুতি না নিয়েই অতিশয় ব্যয়বহুল রাজ্যস্তরের একটি নাগরিক পঞ্জিকরণের সমস্ত ফলাফলকে (যা আবার উদ্যোক্তাদেরই মনঃপুত হয়নি) বাতিল করে আরেকটি জাতীয় পর্যায়ের নাগরিক পঞ্জিকরণের সিদ্ধান্তের অন্তর্নিহিত কারণটাই বা কী, এটা প্রশ্ন করা কি অসঙ্গত? এ যাবৎ একজন দক্ষিণীর নাগরিকত্ব নিয়ে কি কোনও সংশয় উঠেছে, যদিও সাগরের ওই পারে শ্রীলঙ্কা ছাড়াও মরিশাস, দিয়েগোগার্সিয়া, লাক্ষা মিনিকয় দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের সঙ্গে মূলভূমি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের নাগরিকের নৃতাত্ত্বিক, ভাষিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে গভীরভাবে (যেমন বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতীয় বাঙালির মিল), অপরদিকে কাশ্মিরি, বিহারি, ঝাড়খণ্ডি, ওড়িয়া, মারাঠি, গুজরাটি কিংবা অসমিয়াদের ভারতীয়ত্ব এদেশে প্রশ্নাতীত, সংশয়াতীত, কারণ বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, মারাঠা, গুজরাট নামে কোনও স্বতন্ত্র দেশ নেই, যে-দেশের সঙ্গে অবিভক্ত ভারতবর্ষের জমি ভাগবাটোয়ারার কোনও সম্পর্ক আছে৷ পাকিস্তান গঠনের সময় পঞ্জাব প্রদেশে অনুরূপ ভাগবাটোয়ারা, বাস্তুচ্যুতি, আশ্রয় গ্রহণ এবং সীমান্তের এপারে ওপারে সম্পর্কের সূত্রে আনাগোনা এসব ব্যাপার থাকলেও পঞ্জাবিদের ভারতীয়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস অবশ্য কেউ দেখাননি, যদিও ৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যা সম্বলিত আরেকটি পঞ্জাব প্রদেশেরও অস্তিত্ব রয়েছে পাকিস্তানের বুকের ভেতর৷ দুর্ভোগটা বাঙালিদেরই ভাগ্যলিপি। এদের নাগরিকত্ব আজ প্রমাণসাপেক্ষ, এদের স্বাভাবিক পরিচিতি বাংলাদেশি, যদি না ভারতীয়ত্ব প্রমাণিত হয়।
তিন
বাঙালিদের উৎসভূমিটি আজ ভিন্নতর রাষ্ট্রের অন্তর্গত হওয়াতে একটি সহস্রাব্দের স্বাভাবিক প্রব্রজনের ফলে যাঁদের বিস্তারভূমি আদি বঙ্গদেশের ভূসীমানা অতিক্রম করে বিস্তার লাভ করেছে কাছাড় (যা আবার বঙ্গীয়/গাঙ্গেয় সমভূমির স্বাভাবিক ভৌগোলিক সম্প্রসারিত ভূমিও বটে), কামরূপ (যার সম্প্রসারিত রূপই আজকের অসম), খাসিয়া এবং জয়ন্তীয়া রাজ্যে (বর্তমানের মেঘালয়)। ভিন্নতর রাষ্ট্রের সঙ্গে ভাষা শেয়ার করার জন্যই অসমের বাঙালি, যারা শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে এ রাজ্যের বাসিন্দা, এদের সন্দেহজনক বাংলাদেশি বলে প্রমাণ করার অন্তঃসারশূন্যতা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের বোঝার কথা না থাকলেও জাতীয় স্তরের নেতাদের তো না বোঝার কারণ নেই। আর বাংলাদেশ তো সেদিনের ঘটনা। ১৯৭১ সালের আগে থেকে, ১৯৫১ সালের, ১৯৪৭ সালের আগেও বাঙালিরা অসমের বাসিন্দা। আর বাংলা প্রদেশের সিলেট-গোয়ালপাড়া-কাছাড় তো ১৮৭৪ সাল থেকেই অসমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ওই ভূমির বাসিন্দার উত্তরসূরিদের যারা ৪৭ পরবর্তী দিনে অসমে বসবাস করতে এসেছে তাদের ভারতীয়ত্ব কোন বিবেচনায় সন্দেহজনক হয়? আমাদের এটাও ভুললে চলবে না, ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত অসমের নাম ছিল ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’, রাজধানী ছিল ঢাকা। এই ইতিহাসের পালাবদল প্রক্রিয়ায় পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মারাঠা কিংবা দ্রাবিড়, উৎকলকে যেতে হয়নি। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অসমের জনজীবনে বাঙালি মিশে গেছে, এদের অনেকে অসমের ভাষা-সংস্কৃতি আত্মস্থ করার দিকেও এগিয়ে গেছে, আবার অনেকে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতিতে স্থিত রয়েও অসমের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়িত করে ফেলেছে। এ কথাটিও মনে রাখা প্রয়োজন, কাছাড় কখনওই অসমের মূলভূমি, অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি। কাছাড়ের ইতিহাস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং এখানে খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দ থেকে ক্রমান্বয়ে/একই সঙ্গে পাশাপাশি এক একটি ভূখণ্ড একাধিক রাষ্ট্রশক্তির— যেমন হরিকেল, সমতট, ত্রিপুরি, কামরূপ (ভূতিবর্মা-ভাস্করবর্মার আমলে)—শাসনাধীনে আসে। কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ইংরেজ অধিগ্রহণ (১৮৩২) পর্যন্ত এ রাজ্য আহোম রাষ্ট্রশক্তির আওতায় আসেনি। এখানকার জনবিন্যাসে তাই বাঙালি জনগোষ্ঠীর আধিক্য। এই ইতিহাস যারা জানে না, জানলেও মানতে চায় না, এদের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রশক্তি, তাদের বঙ্গভাষী অনুগামীদের এটা না জানলে কেমন হবে? গোটা দেশের সামনে এটা প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হচ্ছে যে, অসম সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কেবলই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী, বাংলায় কথা বললেই তার নাগরিকত্ব প্রমাণসাপেক্ষ। এক সাংবিধানিক প্রধান তো টুপি আর লুঙ্গি দেখেই নাগরিকত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে কেন্দ্রের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিলেন যে, ১৯৭১ থেকে ৮০ এবং ১৯৮০ থেকে ৯০ পর্যন্ত দুই পর্যায়ে প্রথমে ৩৯ লক্ষ এবং পরে ৩৬ লক্ষ নিয়ে সর্বমোট ৭৫ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী অসমে ঢুকেছে। ১৯৯৮ সালে প্রদত্ত এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ২০০৬ সালে আইএমডিটি আইন বাতিল হয় এবং ক্রমান্বয়ে আসে ডি-ভোটার করণ, অসম চুক্তি রূপায়ণ, নাগরিকপঞ্জি নবায়ন ইত্যাদি।
এ কথাটি নিতান্তই কৌতূহল উদ্দীপক, অসমে জনসংখ্যা, অনুপ্রবেশ সংখ্যা এসব নির্ণয়ে গণিত নয়, গাজোয়ারিই প্রাধান্য লাভ করে। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি ১৯৫১ সালের জনগণনার ফলাফলে, যা দেখে সেন্সাস আধিকারিক বলেছিলেন, ‘এ তো বায়োলজিক্যাল মিরাকেল।’ জোর করে বা প্রলোভন দেখিয়ে সেন্সাসে অসমিয়া হিসাবে নাম লিখিয়ে জনসংখ্যা স্ফীতি দেখাতে গিয়ে এ কাণ্ড। সে যাই হোক, একাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত রাজ্যে ৭৫ লক্ষ বিদেশি অনুপ্রবেশ করল, দেশে কোনও নিরাপত্তা বিভাগ, বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স, পুলিশ প্রশাসন কি ছিল না? এটা কি শিবঠাকুরের আপন দেশ?
চার
আমরা বলেছিলাম ভারতবর্ষ একটি উপমহাদেশই, যেখানে এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে প্রব্রজনেই সমাজ এবং জাতিগঠন প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছে। উত্তর ভারত থেকে মধ্য, দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্বে এই প্রব্রজনের ফলেই কৃষি সম্প্রসারণ সম্ভব হয়েছে। এরই হাত ধরে রচিত হয়েছে জনবিন্যাস। অসম এবং বঙ্গভূমিতে এই প্রক্রিয়াতেই দক্ষিণী, মারাঠি জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, মিথিলা, কান্বকুব্জ, নবদ্বীপ, নদীয়া থেকে জনগোষ্ঠী অসমের সমাজজীবনে স্থান পেয়েছে। ‘মরুর দেশের অজানা ফকির’, ‘দিল্লির দিলোয়ার’, ‘পঞ্চনদীর তেগবাহাদুর’ এবং তাদের অনুগামীদের কথা তো ভূপেন হাজারিকার বহুশ্রুত গীতেই উচ্চারিত হয়েছে। মধ্যযুগে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আত্মপ্রকাশ— এও ইতিহাসসম্মত। এতসব প্রসঙ্গের অবতারণা এইজন্যই যে, অসম সহ সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় মূলভূমি থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দীর প্রব্রজনই অসমকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটি প্রদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। যেহেতু নতুন পর্যায়ে দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জির মাধ্যমে বিদেশি সনাক্তকরণের প্রশ্নটির মূলে রয়েছে অসম, তাই অসমের প্রসঙ্গটি এখানে উত্থাপিত।
আজকের যে অসম, এ রাজ্য গড়ে ওঠার পেছনে প্রব্রজনের একটা ভূমিকা রয়েছে। এ প্রব্রজন ভারতীয় মূলভূমি থেকে। সে সঙ্গে বার্মা, থাইল্যান্ড এবং শানদেশ থেকেও। মূলত পাঁচটি জেলা (এ অভিধাও ১৯২৬ পরবর্তী ঔপনিবেশিক আমলে প্রাপ্ত) নিয়ে অসমের আদি অবয়ব (আসাম নামটিও অবশ্য ঐস্লামিক সূত্রে প্রাপ্ত)। এ অসমের সঙ্গে বঙ্গভূমির বেশ কিছু অঞ্চলের সংযুক্তি, খাসি, গারো, নাগা, নেফা অঞ্চলের সংযুক্তিতে অসম একটি প্রদেশের (প্রভিন্স/স্টেট) মর্যাদা লাভ করেছে। ইতিহাসের গতিপথ অন্যদিকে গেলে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রনৈতিক অবয়ব কী হতে পারত সেটা আপাতত বিচারের অবকাশ নেই। ঔপনিবেশিক-প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতাই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক অসম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেকে সামিল করেছে এবং (১৮২৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) ১২১ বছর ব্রিটিশ ভারতের অঙ্গ হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের বিবর্তন নিয়েই সভ্যতার অগ্রগতিতে সামিল হয়েছে, সারা দেশের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছে। বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর যে প্রশ্ন এ প্রদেশটিকে পীড়িত করে আসছে তা হল, কারা এখানে বৈধ নাগরিক, কাদের ভাষিক অধিকার কতটুকু, কারা ‘মাস্টার্স’ আর কারা ‘স্ট্রেঞ্জার্স’। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজও চলছে, এবং এই অসমাধিত সমস্যাই এ মুহূর্তে অসমের সীমানা অতিক্রম করে সর্বভারতীয় স্তরে সম্প্রসারিত হতে চলেছে।
এ পরিস্থিতিতেই আবার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, পরে আইন। তা ধর্মীয় কারণে দেশভাগ হলেও যাঁরা মনেপ্রাণে এ বিভাজনকে মেনে নিতে পারেননি, এবং ওই কারণেই ভিন্ন রাষ্ট্রটির সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েও যাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় পীড়িত (ধর্মীয় নিপীড়ন কেবল কি সংখ্যালঘুর ওপরেই সংঘটিত হয়?! তা হলে ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলিতে এত নিপীড়ন হয় কেন?), তাঁরা যদি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে স্থিত রাষ্ট্রে (যে রাষ্ট্র একদিন তাঁদেরও ছিল) আসতে চায়, বা এসেই থাকে, তবে এঁদের জন্য কি কোনও সংস্থান থাকতে পারে না এই বিলে? এটাও আমাদের ভুললে চলবে না, ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে গ্রহণ করেছে কোনও চাপের কাছে নতিস্বীকার করে নয়, ভারতীয় ঐতিহ্যের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায়ই। একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ভারতবর্ষ একটি আধুনিক, স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতন্ত্রী, সমাজবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করেছে। পরিস্থিতি যদি অন্যরকম হত, তাহলে ওপারের অনুকরণে এপারেও আরেকটি ধর্মীয় রাষ্ট্র (থিওক্র্যাসি) জন্মলাভ করত এই মহাদেশে, রচিত হত মধ্যযুগীয় বর্বরতার আরেকটি অধ্যায়। সেদিন যা সম্ভব হয়নি, আজ যদি এধরনের চিন্তাকে জাতীয় জীবনে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস দেখা যায় সেটা আমাদের দুর্ভাগ্যের কারণই হবে। আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি, ক্যাব উত্থাপন দেশের বিশেষ করে অসমে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির পথে সাফল্য এনে দিয়েছে যথেষ্ট। এ মোহে আক্রান্ত হয়ে যারে স্বপ্ন দেখেছিল সেই উনিশ লক্ষেরই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হয়েছে। এই অসহায় মানুষকে দ্বিতীয়বার বোকা বানানোর জন্য একই বিলের পুনরুত্থান ভাবনা। কী জানি, মানুষকে বারবার বোকা বানানো গেলেও সব মানুষকে সব সময় যে বোকা বানানো যায় না এটা আব্রাহাম লিঙ্কনই শুনিয়ে গেছেন।
পাঁচ
ক্যা আইনটি নিয়ে আরেকটি সংশয় আছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদানের যে ঢালাও আয়োজন, প্রকাশ্যে নিমন্ত্রণ, এর মধ্যে একটা রাষ্ট্রীয় হেজিমনির ব্যাপার যেমন আছে তেমনই প্রচ্ছন্ন রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি উস্কানিও। ওইসব দেশের আজকের সংখ্যালঘুকে আগামী দিনের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দেখানোর প্রবণতা যে প্রকট হয়ে আছে এ নাগরিকত্ব বিলের প্রস্তাবে৷ একাত্তর-পরবর্তী নবসৃষ্ট বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল, যদিও শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদ, জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনকালে এ নিরপেক্ষতার উপর হস্তক্ষেপ ঘটেছে (তখন ভারতবর্ষ সামান্য একটা আশঙ্কা প্রকাশ পর্যন্ত করেনি)। মুজিবকন্যা হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে এসে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দেশকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার, নিরাপত্তা প্রদানেও বাংলাদেশ সরকার তৎপর (নানা সীমাবদ্ধতা নিয়েই)। এ অবস্থায় ২০১৪ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের আমন্ত্রণ জানানো মানে ওপারের সংখ্যালঘুদের মনে নিজদেশের প্রতি আস্থাহীন হতে প্ররোচিত করারই নামান্তর।
পরিশেষে বলব, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) এবং ক্যাব এক নয়— এ কথাটা যতই শোনানো হোক না কেন, এ দুটোর মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক স্পষ্ট। আগামী দিনে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বলা মুশকিল, তবে অসম থেকে যে আওয়াজ উত্থিত হচ্ছে সেটা ইতিমধ্যেই সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এর অভিসন্ধি তো একটি বিশেষ ভাষিক গোষ্ঠীকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা, এটাও স্পষ্ট৷ যদি ধরে নেওয়া হয়, অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের (হিন্দুদের) এ দেশে নাগরিকত্ব দেওয়াই হয়, তবে এই প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়ে এদের বিদেশি বা অনুপ্রবেশকারীর সারিতে দাঁড় করিয়ে এরপর গুনে গুনে ভারতীয় ছাপ মেরে ঘরে ফিরিয়ে আনা হবে, ব্যাপারটা তো তা’ই দাঁড়াচ্ছে৷ এবং আবহমানকালকে বাদ দিলেও দশম, পঞ্চদশ বা অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকের বাসিন্দা আর ২০১৪ সালের আগন্তুকদের তো একাকার করেই দেখা হবে৷ এ বড় আজব কুদরতি!