অশোক মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক জুনায়েদ হাফিজ কি ভয় পেয়েছেন? পাকিস্তানের ধর্মীয় বিচারালয় আল্লাহ্র অবমাননার দায়ে তাঁর ফাঁসির হুকুম দিয়েছেন। তাঁর উকিলকে হত্যা করা হয়েছে। ফলে অন্য উকিলরা অত্যন্ত ভয় পেয়েছেন। তাঁর পক্ষে মামলা লড়তে আর কেউ এগিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে অ্যাপিল করতে হলেও হাফিজ উকিল পাবেন না, তাঁকে নিজেকেই আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য রাখতে হবে। যদি আদৌ তিনি অবশ্য সেই সুযোগ পান। ভয় পেলে তা খুব স্বাভাবিক।
তবে তিনি নিশ্চয়ই মজহব বা আল্লাহ্ নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করার সময় এরকম পরিণতির কথা জানতেন। তাঁর দেশে যে ধর্মদ্রোহ বিরোধী একটা মধ্যযুগীয় বর্বর আইন আছে তাও নিশ্চয়ই তাঁর জানা ছিল। সুতরাং সেই আইনের প্রয়োগ হবে বা করা যাবে— এরকম একটা অবকাশ পেলে যে হুজুর বা মাতব্বররা চুপ করে বসে থাকবে না— এটা তিনি অবশ্যই জানতেন। প্রাণে ডরভয় থাকলে তিনি এরকম কাজ করতে যেতেনই না। ভয়ের বাঁধন কেটে ফেলেছেন বলেই কাজটা করেছেন।
আসলে শুধু পাকিস্তান কেন? ভারতেই কি সংবিধানে “সেকুলার” শব্দটা থাকার ফলে মৌলবাদীদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে? নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গিকে ধর্মীয় কারণে মৌলবাদী জঞ্জাল রক্ষায় হত্যা করতে অসুবিধা হয়েছে নাকি? গৌরী লঙ্কেশও তো জানতেন, তিনি মৌলবাদীদের খতম তালিকায় আছেন। জেনেও তো তিনি কাজ করে গেছেন। ভয় তাঁরা কেউ পাননি। ভয় পেলে এসব কাজ করা যায় না। এই পথে নামাও সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশেও যে চোদ্দো জন মুক্তমনা ব্লগার পর পর খুন হলেন জামাতিদের চাপাতিতে, তাঁরাও ভয় পাননি। একজনের হত্যায় তেরো জন ভয় পাননি। দুজনের হত্যাকাণ্ডের পরেও বারো জন ব্লগ লিখেছেন। তিনজনকে মেরে ফেলার পরও সেই এগারো জন কলম নামিয়ে রাখেননি। …চোদ্দোতম খুনের পরেও যুক্তিবাদের লেখালেখি বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে।
এটা একটা সার্বজনিক নিয়ম। ভয় একটা সংক্রামক রোগ। শক্তিমান দুর্বৃত্তরা যখন প্রথম প্রথম ভয় দেখায়, তারা একজন দুজনকেই ভয় দেখায়। মানুষ যখন ভয় পেতে শুরু করে, তা ছোঁয়াচে রোগের মতোই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। কর্মীরা ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন। লেখকরা ভয়ের কারণে লিখতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। যুক্তিবাদী এবং প্রতিবাদীরা অনেক রকম কুসংস্কার এবং অন্যায় দেখেও চোখ মুখ এবং হাত তালাবন্ধ করে রাখেন। হোমিনিড মেরুদণ্ড বিবর্তনে তার কাজ বা ভূমিকা ভুলে গিয়ে সরীসৃপ মডেলকেই আশ্রয় করে বসে।
পক্ষান্তরে, ভয়ের মতোই সাহসও একটা সংক্রামক ব্যাধি। যদি একে ব্যাধি বলতে আপত্তি না করি। সাহসও প্রথমে এক দুজনই প্রদর্শন করেন। যাঁদের মেরুদণ্ড শক্ত এবং সিধে। যাঁরা জানেন যে তাঁরা হোমিনিড থেকে হোমো হয়েছেন, অবশেষে স্যাপিয়েন্স হওয়ার মর্যাদা অর্জন করেছেন। সেই দু-একজন থেকে অনেকের মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হয়। সেই অনেক থেকে আরও বহু অনেক… অবশেষে অসংখ্যের মধ্যে ঢেউ হয়ে সাহস বইতে শুরু করে। দিক থেকে দিগন্তরে।
কিন্তু এত সব জেনেও আমি ভয় পাচ্ছি।
কেন?
কারণ, আমি এখন বসে আছি সংক্রামিত ভয় থেকে আসন্ন সাহস সংক্রমণের ঠিক মাঝখানের সময়টাতে।
এই আমি মানে যে কেউ— জুনায়েদ কিংবা অভিজিৎ কিংবা ওয়াশিকুর। এই ‘আমি’-রা বসে আছি যে কোনও একটা দেশে— ভারত বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে।
এই ‘আমি’ কি মোদি বা ইমরান বা হাসিনাকে ভয় পাচ্ছি?
না। ওরা ক্ষমতার মসনদে বসে আছে, ওরা ওদের কাজ করে যাচ্ছে। নিখুঁতভাবে। যারা অন্য কিছু আশা করেছিল, বা এখনও করছে, আশাভঙ্গের দায় তাদের। এই শাসকদের নয়। তারা যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বা এখনও দেয়, তারা সেটা স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই করে। শাসন এবং শাসকের ব্যাকরণ মেনেই। সেই গ্রিক যুগের দাস সমাজের মনীষী প্লাতোর পরামর্শ মেনেই। কিংবা আমাদের তিন পুরুষকাল আগের হিটলারের প্রস্তাবিত ট্রাফিক রুল্স অনুযায়ী। সংসদীয় ক্ষমতার বন্ধনীর বাইরে যে আসল স্থায়ী ক্ষমতাবলয়, যেখানে ভোটের তীর পৌঁছয় না, পুলিশ, প্রশাসন, বিচারবিভাগ, সেনা, ইত্যাদি— সেখানেও কোনও বিধিভঙ্গের উদাহরণ চোখে পড়েনি। একেবারে কঠোর বিধিবদ্ধভাবে তারা সবলের পক্ষে দুর্বলের বিপক্ষে গভীর একাগ্রতার সঙ্গেই নিষ্ঠাভরে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম নেই কোনও দেশেই।
সুতরাং এদের ভয় পাওয়ার প্রশ্ন নেই।
ধর্মাশ্রিত মৌলবাদী শিবিরগুলোকে কি ভয় পাচ্ছি?
না। ইসলামই হোক, আর হিন্দুধর্মই হোক, হিমালয়ের কোলে সিন্ধু গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র নীরবিধৌত প্রতিটি ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের আচরণেও কোনও বিচ্যুতি আমার চোখে এখনও পড়েনি, যার জন্য তাদের ভয় পেতে হবে। যুক্তি হত্যায়, তথ্যের বিরোধিতায়, শুভবুদ্ধির ধ্বংসকার্যে, বিবেকের শ্বাসরোধে, সত্যের প্রতি অ্যালার্জিতে— একটাও জায়গায় তাদের কাউকে অন্যরকম কার্যকলাপ করতে আজ অবধি দেখিনি। তাদের ঠিক যেমনটি করার কথা, তাদের শাস্ত্রে, সংহিতায় যা যা লেখা আছে, তারা সেই মতো কাজ করে চলেছে।
অতএব এদেরও ভয় পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।
ঈশ্বর আল্লাহ্ ইয়াহবে গড— এদের কি এই সব ‘আমি’ ভয় পাচ্ছি?
না, এদেরও ভয় করার মতো কিছু আমার নজরে আসেনি। এরা খুবই নিরীহ প্রাণী (যদি এদেরকে আদৌ প্রাণ যুক্ত বলে ধরা যায়), কারও সাতেপাঁচে থাকে না। বিশ্বজগতের কোথায় কে কী করছে তা নিয়ে এদের সামান্যতমও মাথাব্যথা নেই। কোন তারা নিভে গেল, কোন ধূমকেতু উর্ট মেঘ ছেড়ে রওনা হল সূর্যের কাছ দিয়ে এক পাক খেতে— এদের তা নিয়ে কোনও উদ্বেগ বা আগ্রহ নেই। এরা সাপকেও বলে না, “ব্যাঙ খেও না”, আবার ব্যাঙকেও বলে না, “সাপের ধারেপাড়ে যেও না।” ফরাসি সম্রাটদেরও নিয়ন্ত্রণ করেনি, আবার ফরাসি বিপ্লবকেও আটকাতে যায়নি। এরা কেউ কখনও ভূমিকম্প বা সুনামিও ঠেকাতে যায়নি, অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি বন্যা খরাও থামাতে চেষ্টা করেনি। টাইটানিক জাহাজ ডুবে গেলেও এদের ঘুম বিঘ্নিত হয়েছে বলে শুনিনি, চেঙ্গিজ খান লক্ষাধিক যুদ্ধবন্দিকে কচাকচ মুন্ডু কেটে ফেললেও এই স্বর্গাধিপতিদের লম্বা শ্বাস পড়েছে বলে খবর নেই (ভায়া বিদ্যাসাগর)। নোয়াখালিতেও ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যায়নি, গুজরাতেও আল্লাহ্ আসার ফুরসত পায়নি। হিটলারের বন্দিশিবিরের অতিথিরা তো গডের কাছে দাবি করেছিলেন, সে এসে ক্ষমা চেয়ে নিক। কেউ আসেনি। বরং সেদিন এই বেহেস্তওয়ালারা যা হেসেছিল না! আর হেসেছিল, যেদিন সারা বিশ্বের জহাঁপনা হিটলার পাশে কোনও গোমস্তা দেখতে না পেয়ে একাই কেরসিন স্নান করতে গেল, সেদিন। জাগতিক ব্যাপারে উহজগতের সর্দাররা বিচ্ছিরি রকম উদাসীন। (জুনায়েদ কি এটাই বলতে চেয়েছিলেন?)
যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, ঈশ্বর বা আল্লাহ্কেও বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছি না।
তবে কাকে?
হ্যাঁ, সেই কথাই বলতে চাই।
ভয় পাচ্ছি, আমরা যারা বর্তমান কালের ভয়দানবদের বিরুদ্ধে চতুর্দিকের ভীতসন্ত্রস্ত মানুষদের সাহস যোগাব, আমরা কি তার জন্য তৈরি হয়েছি? সর্বগ্রাসী ভয় কাটিয়ে সর্বব্যাপ্ত সাহসের আবহ তৈরি করতে হলে আমাদের যুক্তিবাদীদের, সত্যের ধ্বজাধারীদের যে অনেক কিছু করতে হবে, খুব তাড়াতাড়ি, আমরা যে তার জন্য এখনও প্রস্তুতি গ্রহণ করে উঠতে পারিনি— ‘আমি’ ভয় পাচ্ছি এই অবস্থাকে।
এক কথায় বলতে গেলে, ‘আমি’ ‘আমাকে’ই ভয় পাচ্ছি।
অল্প সময়ের মধ্যে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। ধর্ম সম্পর্কে, ইতিহাস সম্পর্কে, ভারত বা কাশ্মির সম্পর্কে, বালুচিস্তান সম্পর্কে, চাক্মাদের ব্যাপারে, অনেক কিছু তথ্য তুলে ধরতে হবে অগণিত মানুষের কাছে। দেশ, অর্থনীতি, ধর্ম, ইত্যাদি বিষয়ে নানা রকম ভ্রান্ত ধারণা যারা ছড়াচ্ছে তাদের এখন অসীম ক্ষমতা। হাতে তাদের অনেক রকমের শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র। মুদ্রিত এবং ইলেকট্রনিক। এক পাল পোষা গণমাধ্যম। ভুলের ব্যাক্টিরিয়াগুলো জন্মলাভ করছে অবিশ্বাস্য হারে, সমাজ দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে যাচ্ছে অসম্ভব দ্রুত গতিতে। আমাদেরও পালটা টীকাকরণে নামতে হবে। সমান গতিতে, বা পারলে আরও দ্রুত বেগে।
না, পারব না, এরকম ভয় পাচ্ছি না। পারব বলেই আমার বিশ্বাস। আসলে আমাদের মধ্যে অনেক রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করছে। অসংখ্য রকম মতপার্থক্য। ছোট ছোট পার্থক্যই কিন্তু বড় বড় ফাটলের জন্ম দিচ্ছে। আমরা মিলতে পারছি না। মিলিতভাবে কিছু করতে পারছি না শুধু নয়, এখনও ভালো করে এক যোগে এক মঞ্চে মিলিত হয়ে কাজ করতে চাইছি না। ভয় পাচ্ছি এই অনীহাকে, এই প্রস্তুতিহীনতাকেই। চাপাতিওয়ালারা মিলে যায়। নিজেদের মধ্যেও, পরস্পরও। দিল্লিশ্বর ঢাকেশ্বরী এবং পিন্ডিশাহ-দের মধ্যে অবিশ্বাস্য রকমের মিলমিশ। শাস্ত্রযোগী আর হুজুরদের মধ্যেও খাতিরের অভাব নেই কোনও কালেই। অভিজিৎ রায় বা তসলিমা নাসরিনকে, বলুক আর না বলুক, জামাত-এ-ইসলাম এবং নাগপুর সঙ্ঘ— উভয়ই অপছন্দ করে। সম্মিলিতভাবে। মিলে যায়।
ভয় এখানে। প্রচণ্ড ভয়। কেন না, সময় কম। অবিলম্বে মিলতে হবে। এক মঞ্চে মিলতে না পারলেও মঞ্চে মঞ্চে সংযোগ গড়ে তুলতে হবে। কাজের পরিকল্পনা ছকে ফেলতে হবে। যে সকল শক্তি জুনায়েদের ফাঁসির দাবি করে, যারা সেই দাবি মঞ্জুর করে, এবং যারা সেই দাবি পূরণের ব্যবস্থা করে, তাদের নখ এবং দাঁত চিরকালের জন্য ভেঙে দেবার আয়োজন করতে হলে বিজ্ঞান ইতিহাস যুক্তি তর্ক ঘরে ঘরে ফেরি করতে হবে আমাদের। ভয় পাচ্ছি, বেরোতে দেরি না করে ফেলি।