Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্যাম্পাস আজ গণতন্ত্রের পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে মাথা তুলেছে

শুভাশিস মৈত্র

 

I came to the conclusion long ago that all religions were true and that also that all had some error in them, and while I hold by my own religion, I should hold other religions as dear as Hinduism. So we can only pray, if we were Hindus, not that a Christian should become a Hindu; but our innermost prayer should be that a Hindu should become a better Hindu, a Muslim a better Muslim, and a Christian a better Christian.

― Mahatma Gandhi

যুদ্ধটা রাস্তাতেই হচ্ছে। রাস্তাতেই হবে। এবং প্রথম রাউন্ডে ছাত্র-ছাত্রীরা জিতে গিয়েছেন। জয় হয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রী এক কদম পিছু হটে ঢোক গিলে বলেছেন, কই, কখনও তো বলিনি আমরা এনআরসি করব! যিনি দুদিন আগেও হুঙ্কার দিচ্ছিলেন, চুন চুনকে নিকাল দেঙ্গে, গুজরাটের সেই নেতাও দুদিন অপেক্ষা করে একই সুরে বলেছেন, ঠিকই তো ঠিকই তো! কোথায় আবার আমরা বললাম, এনআরসি হবে!

অমিত শাহ কিছু দিন আগে লোকসভায় বলেছিলেন, ভয় পাওয়াই উচিত। নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে এত দিন বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, ‘ইউএপিএ’, ‘সিডিশন আইন’, ‘সিবিআই’, ‘ইডি’ দিয়ে সরকার ভয় দেখিয়ে বিরোধী স্বর চেপে দিচ্ছে। এবং সত্যি কথা হল, ভয় না পেলে রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব বিল এত সহজে পাশ হত না। এই ভয়টাই আজ ভেঙে দিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা। ভয় ভেঙে দিয়েছে ক্যাম্পাস। ভয় ভেঙে দিয়েছে কম বয়স। মনে হচ্ছে যেন সত্যিই এদেশের বুকে আঠারো এসেছে নেমে। নরেন্দ্র মোদি নাকি দেড় লাখ টাকা দামের চশমা দিয়ে কদিন আগে সূর্যগ্রহণ দেখেছেন। সে বেশ করেছেন। পোশাক দিয়ে তিনি দেশ চেনেন। চশমা দিয়ে দেশ নেতা চিনবে এবার। কিন্তু কথা সেটা নয়। লোকে বলছে, বলয়গ্রাস আক্রান্ত সূর্যের দিকেই আপনি চোখ রাখুন। মাটির দিকে তাকালে, আন্দোলনের আঁচে চোখ জ্বালা করতে পারে। দেড় লাখ টাকার চশমাতেও ওই আঁচ চোখ-সওয়া করে তোলা যাবে না।

৩০৩ আসনের অহঙ্কারে ফু দিয়ে কেউ উড়িয়ে দিতেই পারে তারুণ্যের এই দাবি। কিন্তু দেশে যদি নির্বাচন ব্যবস্থা টিকে থাকে, একদিন না একদিন নতুন কোনও সরকার এসে এই নাগরিকত্ব আইন বাতিল করবেই। যেমন ইন্দিরা গান্ধির তৈরি অগণতান্ত্রিক আইনের ক্ষেত্রে হয়েছিল জরুরি অবস্থার পর। ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস ১৯৭১ সালে লোকসভা ভোটে ৩৫২ আসন পেয়েছিল। ভোট পেয়েছিল ৪৪ শতাংশ। ১৯৮৪-র লোকসভা ভোটে কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল প্রায় ৫০ শতাংশ, আসনের সংখ্যা ছিল ৪০৪। ৭১-এর বিপুল জয়ের পর ক্ষমতা ধরে রাখতে  জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধিকে। ১৯৮৪-তে ৪০৪ আসন পেয়েও ১৯৮৯-এর ভোটে আর ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি কংগ্রেস। তিনশো-তিনওয়ালারা স্বীকার করুক আর না করুক, ইতিহাস এমনই নির্মম।

ইতিহাসে এ এক অদ্ভুত সময়। তখন বয়স কুড়ি পেরোয়নি, বিপ্লব ভেবে গান্ধিমূর্তি ভাঙাকে সমর্থন করেছিলাম। আর তার পর, বয়স যত বেড়েছে, এই হাঁটুর উপর ধুতি পরা মানুষটার কাছে ফিরে ফিরে আসতে হয়েছে মাথা নত করে, ছাত্র হিসেবে। আজ যখন ভারত জুড়ে এদেশের বুকে ‘আঠারো’ নেমে এসেছে, তারা জেনে বা না জেনে যা বলছে তার অনেকটাই ওই হিন্দুত্ববাদীদের হাতে গুলি খাওয়া রঘুপতিরাঘব মানুষটার কথা। গান্ধি এখনও আমাদের আশ্রয়। এ খুব ভালো কথা। কিন্তু এর অন্য দিকও আছে। শুধু গান্ধি নয়। স্লোগান উঠছে আম্বেদকার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের নামেও। সবাই স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। তাহলে কি গত ৭০-৭২ বছরে আর কোনও নেতা তৈরি হয়নি যিনি বিদ্রোহীদের কাছে গ্রহণযোগ্য? ৭৪-এর ছাত্রসমাজ সামনে জয়প্রকাশ নারায়ণকে পেয়েছিল। আজ তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এটা কিন্তু একটা শূন্যতার ইঙ্গিত। যদিও আপাতত এই শূন্যতা চাপা পড়ে আছে আন্দোলনের আবেগে। তবে এটাও ঠিক, এই শূন্যতা শুধু এখানে নয়। নির্দিষ্ট নেতৃত্ববিহীন, দলীয়পতাকাহীন আন্দোলন বেশ কিছু সময় ধরেই সারা পৃথিবীতেই বিদ্রোহী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে। এ এক নতুন দিশা।

বামপন্থীরা, যখন তাদের প্রয়োজন ছিল সব থেকে বেশি, তখন বাস্তব অবস্থা হল, একের পর এক রাজ্যে পিছু হঠতে হঠতে আজ তাদের অবস্থান সদর দরজার চৌকাঠের ওপারে। তবে যেহেতু বামপন্থার প্রয়োজন ফুরোয়নি, নতুন কথা শোনার জন্য মানুষ অপেক্ষা করে থাকবে। অন্যদিকে একের পর এক রাজ্যের ভোটে প্রমাণিত, কংগ্রেসকে এখনও মানুষ অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প ভাবছে। কিন্তু দলটা গান্ধি পরিবারের প্রতি চাটুকারিতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় এমন হাস্যকর হয়ে উঠছে, যা লজ্জার। একসময় বহু যোগ্য নেতা-নেত্রী, যাদের পিছনে কোনও তথাকথিত নেহরু-গান্ধি পরিচয় ছিল না, তাঁরা কংগ্রেস সভাপতি হয়েছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে দল পরিচালনা করেছেন। আজ মনে হয় সেসব কথা আর কারও মনে নেই।

এখন, এই মুহূর্তে ক্যাম্পাস-ই বামপন্থীদের ভূমিকায়। ক্যাম্পাস-ই প্রধান বিরোধীদল।

রাষ্ট্রের পুলিশ, মিলিটারি, অস্ত্রভাণ্ডার থাকে। রাষ্ট্র যখন চায় হিংসা বা ভায়োলেন্সকে ব্যবহার করে যে কোনও বিরোধকে যুক্তির বাইরে গিয়ে সমাধান করতে। ইতিহাস বলে, উল্টো দিকেও যুগে যুগে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য হিংসার ব্যবহার হয়েছে। যদিও আজ যারা সরকারের নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তা মূলত অহিংস। দু-একটি সামান্য ব্যতিক্রম বাদে। অত্যন্ত নামী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লেখা-পড়া করা ছেলে-মেয়েরা পথে নেমেছে। বন্দুক নয়, শিক্ষাই তাদের প্রধান অস্ত্র। আন্দোলনকারীদের হিংসা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি মন্তব্য করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও কিন্তু হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল, যখন তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। গুজরাট দাঙ্গার সময় তিনি গোধরার কথা বলে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের দোহাই দিয়েছিলেন। যেন তা ছিল গোধরা পরবর্তী একটি স্বাভাবিক ঘটনা। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গেরুয়ধারী যোগী আদিত্যনাথ অবশ্য নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সাফল্যের প্রমাণ দিতে নিজেই অবতারের ভূমিকায়, বলেছেন বদলা নেবেন। নিয়েওছেন। উত্তরপ্রদেশে গুলিতে মৃতের সংখ্যা ২১। সবাই বলেছেন আন্দোলনের নামে, প্রতিবাদের নামে সম্পত্তি ধ্বংস করা অনুচিত। এবং অবশ্যই মানতে হবে এই কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু যখন বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল তখন কি এই নেতারা নিন্দা করেছিলেন? সেটা কি জাতীয় সম্পদ ছিল না? তখন বিজেপি নেতা কল্যাণ সিং গর্ব করে কলকাতায় এক জনসভায় বলেছিলেন, ঠিকাদার দিয়ে ভাঙলে এক মাস লাগত, করসেবকরা দু দিনে ভেঙে দিয়েছেন।

সময় বলবে এই আন্দোলনের পরিণতি কী। কতদূর যাবে? কতটা সফল হবে? পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও আন্দোলনকেই শুধু সাফল্য দিয়ে মাপা হয় না। ক্যাম্পাস থেকে এই যে নতুন ভারত আজ জেগে উঠল, এ ঘুম ভাঙার গান। এই গানের সুর দীর্ঘদিন কানে বাজবে। ৩০৩ কেন ৫০০ আসন জিতেও ভবিষ্যতে আর কেউ, জেগে ওঠার এই সুরকে অস্বীকার করতে সাহস পাবে না। ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে মাথা তুলেছে। এর উচ্চতা বেড়েই চলবে। কখনও কমবে না।