পীযূষ ভট্টাচার্য
নবম পর্বের পর
খেরেস্তানি ঘরটা আসলে যে একটা গির্জা সেটা বুঝতেই অনেকটা সময় লেগে গেছে। ঠিকঠাক বুঝে উঠতে প্রায় বছর বারো সময় নিয়েছিল। গির্জাঘরটি ছিল মিস রায়দের নিজস্ব, অনেকটা পারিবারিক। নিজে অবশ্য কোনও দিনই ঢুকিনি। মা কিন্তু বালুরঘাটে এলেই একবারের জন্য হলেও মিস রায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যেত কেননা তিনি ছিলেন আমার ধাত্রী। আসলে মিস রায়ের সঙ্গে মার সখ্যতা এমন পর্যায়ে ছিল যে আমাকে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হত। মিস রায় প্রতিবারই আপত্তি করতেন আর মার একই কথা ‘ধাত্রী মাকে সম্মান করতে শিখুক— তুমি বাধা দিও না।’
তখন বুঝতাম না এখন বুঝি— তোমাকে পৃথিবীতে আনতে ইনি সাহায্য করেছেন, অতএব তোমাকে শ্রদ্ধা জানাতেই হবে। কিন্তু সেদিন সবাইকে অবাক করে নানকে প্রণাম করে বসি। এর ফলে তিনি এতটাই হতবাক যে প্রথমে কিছুই বলে উঠতে পারেননি। শেষে মাকে বলেছিলেন “দেখলে তোমার ছেলের কাণ্ড!”
–মিস রায় তো ওর ধাত্রী মা। ওনাকেও প্রণাম করে তো ও।
যেন মা বোঝাতে চাইছেন প্রণামের মধ্যে ধর্মীয় কোনও অনুষঙ্গ নেই— শ্রদ্ধা জানানোর একটা মুদ্রা বিশেষ।
কিন্তু নান হাঁটু মুড়ে বসে নিজেকে আমার উচ্চতায় নিয়ে এসে ক্রুশটা নিজের গলা থেকে খুলে এগিয়ে দিলেন— তুমি প্রভুকে চুম্বন করো। এবং তা করতেই তিনি বলে উঠলেন— ‘আমেন!’
আসলে ঘুমিয়ে পড়বার আগে ওনাকে দেখেছিলাম মার শাড়ি পরা অবস্থায়। এখন তিনি নানের পোশাকে ভিনগ্রহের বাসিন্দা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেহেতু বেলা করে ঘুম ভেঙেছিল, তাই দিনের শুরুটা হয়েছিল চরম এক বিভ্রান্তি দিয়ে। যেন আপাত কোনও বিভ্রম, কিন্তু তার মধ্যে চরম এক সত্য যাকে খুঁজে নিতে হয়। তার উপস্থিতিই মনে করিয়ে দিচ্ছে বেলুদির কথা। যদি এ যাত্রায় বেলুদি বেঁচে যায় তবে তারই দেওয়া রক্তের প্রতিরোধে বাঁচবে। ও নেগেটিভ গ্রুপের রক্তই হয়ে উঠেছে এ রোগের মহৌষধ।
–আবার যদি প্রয়োজন হয়…। মেজমাসি কথা শেষ না করে কেঁদে উঠলে নান তাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন— ডাকলেই চলে আসব। মেজমাসির ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক এখানে লুপ্ত হয়ে সমকালের একটিই বার্তা— মেয়েটা বাঁচবে তো? কখন যে নিবিড় এই অনুভূতি নানের ভিতরে প্রবেশ করেছে, এবং তা সহজেই বুঝে নিয়েছেন নান জানি না। তারপর তার সর্বশক্তিমান প্রভুর উদ্দেশে বলে ওঠেন— আমেন।
একসময় ধীরে ধীরে মেজমাসির বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে যাবার সময় আরও একবার মেজমাসিকে দেখে নেন, চোখ দুটি ওনার চিকচিক করে উঠেছিল মুহূর্তের জন্য। সেখানে সকালে প্রথম রোদ রামধনু সৃষ্টির উপস্থাপনায় স্থির। তখন বুঝিনি, বড় হয়ে বুঝেছি এও একপ্রকারের মায়া। কিন্তু যা কোনও দিনই বুঝতে পারিনি—এই ‘মায়া’র কি গার্হস্থ্যের ফেলে আসা জীবন থেকে উৎপত্তি? না, শুধুমাত্র আর্তর জন্যই মায়া?
বাড়ির সকলেই তাকে গাড়িতে তুলে দিতে নীচে নেমে গেল, শুধু আমি একলা থাকলাম বোনের পাহারায়।
প্রায় দিন সাতেক স্যানিটোরিয়ামে থাকার পর ডাক্তার জানিয়ে দেন এ যাত্রায় বেলুদি বিপদমুক্ত। বাড়ি চলে যেতে পারে। বাড়িতে ফিরে আসাকে কেন যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘ছুটি’ বলে সেদিনও বুঝে উঠতে পারিনি, আজও পারি না, কেননা সেই প্রথা আজও একইভাবে প্রচলিত। তবে কি হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্রগুলি একপ্রকারের মৃত্যুফাঁদ যেখান থেকে বাড়িতে ফিরে আসাটাও ‘ছুটি’, আবার একবারের জন্য চলে যাওয়াও তো ‘ছুটি’। আবার ছুটি-র অর্থ খুবই সহজ, কিন্তু গূঢ়ার্থ কঠিন। অথচ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আপ ট্রেন চলে যাবার পর দুজন ধুনরিকে দেখতে পাওয়া যায়। তারা তাদের ধনুকাকৃতি ধুনা যন্ত্র নিয়ে টং টং শব্দ তুলতেই বাবলু এক দৌড়ে পৌঁছে যায় সেখানে। ওখান থেকে চিৎকার করে বলে— বড়দির জন্য নতুন লেপ-তোষক বানাতে চলে এসেছে। যদিও এ কথাগুলি বলার চেয়ে তার ভীষণ আগ্রহ ওই যন্ত্রগুলি থেকে এরকম সুর ওঠে কীভাবে? যতবার ওদের হাতে ধনুকের মতো যন্ত্রটার ছিলাতে সুর তুলবার চেষ্টা করছে ততবারই বিফল। সুর টুর কিছুই উঠছে না, এতটাই টানটান ও নাড়াতেই পারছে না। একসময় ধুনরি টং ধ্বনি তুলে বাবলুকে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু সেই একটিমাত্র ধ্বনি এ-পাহাড়ে ও-পাহাড়ে আছড়ে পড়ে প্রতিধ্বনি তুলল। আমি চিরটাকালই তাল-লয় কানা হওয়া সত্ত্বেও সেদিন শুনতে পেয়েছিলাম দূরাগত একটি ধ্বনি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে নামছে এমনভাবে— যেখানে তার উৎস সেখানেই পৌঁছাবার একমাত্র লক্ষ্য যেন।
ঠিক সেই সময় মেসোমশাই স্টেশনমাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ধ্বনিটা যেন তার কাছেই পৌঁছে গেল। আর তখনই এক চরম ব্যস্ততা সৃষ্টি হল ধুনকরদের মধ্যে। বাবলুকে টং ধ্বনি শোনানো বন্ধ রেখে এক দৌড়ে মেসোমশাইয়ের কাছে পৌঁছে গিয়ে জানতে চায় কাজটা কোথায় করবে।
এত দূর থেকে এইসব কথোপকথন শোনা সম্ভব নয়, শুনিওনি। তবে এরকম কিছু কথাবার্তা হয়েছিল তাদের মধ্যে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই রেলওয়ের গোডাউন থেকে চটের বস্তা নিয়ে এসে বিছিয়ে দেয়। মেজমাসি ওপর থেকে হুকুম দেয় জায়গাটা ঝাড়ু দিতে। এবং তা হয়ে গেলে নিজেই গঙ্গাজলের শিশি হাতে নেমে এসে প্রথমে জায়গাটিতে জল ছিটিয়ে তারপর লেপতোষকের কাপড় ও তুলোতে জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে দেয়। একেবারে শেষে ধুনুরি দুজনকেও গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়।
তখন বুঝতে পারিনি মেজমাসি কেন ধুনুরিদেরও শুদ্ধ করল। কিন্তু তাকে কেউ প্রশ্ন করেনি অথচ নিজে থেকেই বলে উঠল— ও দুজন তো মোছলমান, ওদেরও শুদ্ধিকরণ করে এলাম।
তারপর রামছাগলের মার উদ্দেশে হাঁক পাড়ে— ‘দিদির ঘরটা পরিষ্কার কর আগে।’
তবে কি আজকেই ফিরে আসবে বেলুদি? গতকালই বাড়িতে কথাবার্তার মধ্যে উঠে এসেছিল দু-একদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবে স্যানিটোরিয়াম থেকে— আজকেই জানা যাবে সঠিক দিনক্ষণটি। কালুদা ডাউন ট্রেনে খাবার দিতে যাবে, তখনই শুনে আসবে সঠিক দিন।
এদিকে ধুনুরি দুজন তাদের যন্ত্রে অঙ্কুশের মতন কিছু একটা দিয়ে একই সঙ্গে শব্দ তুলল টং। সে শব্দ আরও গম্ভীর— অনেকটা ওঁকারের মতো। উড়ন্ত তুলোর আকাশের ভেতরেই তার খেলা। বাইরের পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে না। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের ভেতরেই তার অবস্থান— তাই যেন বিলুপ্ত তুলোর শস্যবীজ-শস্যক্ষেত। এসবের আয়োজন একটু উষ্ণতার জন্য। আর উষ্ণতাই বেলুদিকে সন্ধান দিতে পারে আরোগ্যের ঠিকানার।
কালুদা ডাউন ট্রেন ধরতে বেলুদির জন্য গরম দুধের ফ্লাস্ক, টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে নীচে নামার সময় আমাকে ডেকে নেয়। মা আপত্তি করতে পারে না।
বাবলু তো প্রথম থেকেই ওখানে আছে আর এমনভাবে বসে যেন টং ধ্বনির ভেতর নিজের নাচের জন্য নুপূরের ঝঙ্কার তুলবার প্রয়াস ছিল, তা খুঁজে না পেয়ে হতাশ। আমি যেতেই প্রশ্ন করে “আমার নুপূরে এরকম বোল ওঠে না কেন?”
আমি বাবলুর নুপূর পরে নাচ দেখিনি, যা দেখেছি বা শুনেছি বেলুদির আরোগ্যের জন্য আনা রামছাগলের পায়ে বাঁধা স্খলিত নুপূরের ধ্বনি, তাও আবার কয়েক মুহূর্তের জন্য। তখন যে ধ্বনি উঠেছিল তা এতটাই ক্ষণিকের যে বেলুদির শরীরের অবস্থা খারাপ হবার ত্রাসের মধ্যে হারিয়ে যায়।
একসময় আমিও বাবলুর সঙ্গে টং টং ধ্বনির ভেতর সুরের সন্ধানে হারিয়ে যাই। কিন্তু অজানা একটা পাখি ডেকে ওঠে কু কু শব্দে—তার তীব্রতায় মনে পড়ে যায় আমাদের দুজনের সকাল থেকে সেরকম কিছু খাওয়াই হয়নি।
আবার আগামী সংখ্যায়