Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পৃথিবীর জৈবক্ষমতা ও আমাদের বাকির খাতা

তথাগত দাশমজুমদার

 

সামনের সপ্তাহ থেকে আমাদের সবাইকে ধারে বাঁচতে হবে, কারণ আমরা ইতিমধ্যেই এতটা কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে ছেড়েছি যে সারা পৃথিবীর সমস্ত গাছপালা গোটা ২০১৭-তে তা শুষে নিতে পারবে না। আমরা এর মধ্যেই এত জল ব্যবহার করে ফেলেছি, এত মাছ ধরে ফেলেছি, এত গাছ কেটে ফেলেছি যে পৃথিবী গোটা ২০১৭-তে তা পূরণ করতে পারবে না। আরও ভয়ের ব্যাপার হল, এই ধারে বাঁচতে শুরু করার দিনটা যাকে কিনা Earth Overshoot Day বলে তা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, এবছর যেটা ২ আগস্ট, ২০১৬ সালে সেটাই ছিল ৮ আগস্ট, ১৯৯৩ সালে তা ছিল ২১ অক্টোবর।

তবু আমরা গাড়ি নিয়ে এক কিলোমিটার দূরে বাজার করতে যাব, অদরকারে এসি চালাব, অফিস যাওয়ার সময় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বদলে গাড়ি ব্যবহার করব (খুব দূরে যাদের বাড়ি বা যেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই তাদের কথা বলছি না) এবং অপেক্ষা করব কবে Earth Overshoot Day টা ২ জানুয়ারীতে আসে।

Earth Overshoot Day হল একটা ধারণা, যদি প্রাকৃতিক সম্পদ যা আমরা বিনা দ্বিধায় ব্যবহার করি, তাকে যদি অর্থনীতির যুক্তির মধ্যে ধরা যেত তাহলে তো সেই ডেবিট ক্রেডিটের হিসেবের মধ্যে ঢুকতে হত, তাই না? এখানে আরেকটু ক্ল্যারিফিকেশন দিই, ধরা যাক আমরা কাগজ বানাব বলে গাছ কাটছি, আমাদের অর্থনীতি কিন্তু শুরুই হচ্ছে গাছ কাটতে কতটা শ্রম ব্যয় করা হচ্ছে, তার মূল্য কতটা সেই জায়গা থেকে (ক্যাপিটাল থেকে টুকলাম), গাছটা কাটার আগে গাছের কোনও মূল্য কিন্তু নেই, আমরা শুধুই শ্রমের মূল্য থেকে শুরু করছি আমাদের হিসাবপত্র, কিন্তু যদি গাছটার মূল্য হত?

কীভাবে? সেই গাছটা এক বছরে কতটা অক্সিজেন পরিবেশে দিচ্ছে তা যদি আমাদের কারখানায় তৈরি করতে হত তাহলে কত খরচ হত (শ্রমেরই খরচ) তার হিসেব করা একটা উপায়। আরও আছে, গাছটা কতটা মাটিকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করছে, গাছের পাতা মাটিতে পড়ে কতটা উর্বর করছে জমিকে ইত্যাদি দিকগুলোও আছে।

ঠিক এভাবেই সারা পৃথিবীর একবছরের প্রাকৃতিক সম্পদ তৈরির ক্ষমতা হিসেব কষে বের করা যায়, যেটাকে বলে পৃথিবীর biocapacity, যার মধ্যে আছে সারা বছরে পৃথিবী কতটা অক্সিজেন তৈরি করছে, কতটা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে, কতটা জমিকে উর্বর করে তুলছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। সোজা ভাষায় বললে, প্রকৃতি তথা পৃথিবী মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সারা বছরে কতটা তৈরি করছে তার পরিমাণই হল পৃথিবীর biocapacity।

এর পরের ধাপে আমাদের দেখতে হবে যে পৃথিবীর সকল মানুষের ecological footprint কতটা। এই ecological footprint জিনিসটা কি? এটা হল মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সব্জিপাতির উৎপাদন, মাছ মাংসের উৎপাদন, পেট্রোল ডিজেল কয়লা জ্বালানোর ফলে উদ্ভূত কার্বন ডাই অক্সাইডের শোষণ, বাড়ি বানানো, ইত্যাদি কাজের জন্য যতটা জায়গা লাগবে তার পরিমাণ।

এবারে Earth Overshoot Day হল পৃথিবীর biocapacity-কে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ecological footprint দিয়ে ভাগ করে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করলে যতগুলো দিন পাওয়া যাচ্ছে তা বছরের যে তারিখে শেষ হচ্ছে সেই তারিখটা। একটু অন্যভাবে ভাবলে বলা যায়, এবছর যেহেতু Earth Overshoot Day ২ আগস্ট পড়েছে তাই পৃথিবীর সকল মানুষের প্রয়োজন একটা পৃথিবী মেটাতে পারবে না, তার জন্য ১.৭ বা প্রায় দুটো পৃথিবী লাগবে। এই Earth Overshoot Day-র ধারণাটা তৈরি করে Global Footprint Network নামক সংস্থাটি, ১৯৬১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি বছরের Earth Overshoot Day নির্ধারণ করে যা দেখা যাচ্ছে সেটা আমাদের প্রগতির ধারণাকেই প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে ফেলে দেয়। নিচের গ্রাফটি দেখুন, দেখবেন যে যে দেশের HDI (Human Development Index) যত বেশি, মানে যে দেশের লোকজন যত বেশি তথাকথিত সুখে স্বাচ্ছন্দে আছে তাদের Ecological Footprint তত বেশি, মানে যে এককগুলো দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের বিচার করা হচ্ছে সেগুলো পৃথিবীর সীমিত সম্পদের ওপর এত বেশি পরিমাণে চাপ দিচ্ছে যে একটা পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন আর মিটছে না।

মানে যে American Dream-এর দিকে চেয়ে বর্তমানে সারা পৃথিবীর দৌড়, আরও বড় গাড়ি, আরও বড় বাড়ি, আরও বেশি বিদ্যুৎ সেগুলোই কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বেঁচে থাকাটাকে করে দিচ্ছে আরও বেশি কঠিন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে ধারেই যদি বাঁচতে হয় বা দুটো পৃথিবীই যদি লাগে, তাহলে ২রা আগস্টের পর মানুষ বাঁচবে কী করে? কীভাবে আবার? কার্বন ডাই অক্সাইড আর শোষিত হবে না, জমতে থাকবে বায়ুমণ্ডলে, গ্রিনহাউস এফেক্টে পৃথিবী আরও একটু গরম হয়ে উঠবে, আরও কিছু আইসবার্গ ভেঙে আসবে মেরু অঞ্চল থেকে, সমুদ্রের কোরাল রিফগুলো আরও একটু করে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়বে। আর এই পরিবেশ প্রলয়ে আমরা ক্রমশ হারাব আরও একটু স্বাস্থ্য, আরও একটু খাদ্য সুরক্ষা, আরও বেশি মানুষ হবে উদ্বাস্তু।

তাহলে উপায়? উপায় আছে, আমাদের জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন করতে হবে। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের। চলুন না, গরম লাগলে একটু এসিটা কম চালাই, জানলাটা খুলে দিই, মানুষ বিবর্তনের পথে তো নিজের এসি নিজের শরীরের মধ্যেই তৈরি করে নিয়েছিল, যখন সে গায়ের লোম ঝরিয়ে ফেলে ঘামের মাধ্যমে নিজের শরীর ঠাণ্ডা করার উপায় খুঁজে নিয়েছিল। চলুন না, হেঁটে বাজার করি, তাতে শরীরটাও চর্চা করা হবে আর একটু কার্বন ডাই অক্সাইড কম বেরোবে। সুপারমার্কেটের বদলে পাড়ার শ্যামল বা রহমতের দোকান থেকে সব্জি কিনি, তাতে তাদের ছেলেরাও স্কুলে যেতে পারবে আর বহুদূর থেকে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ছড়িয়ে সব্জি বয়ে আনার দরকার পড়বে না। জানেন কি, পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায় শুধু সংরক্ষণ ও পরিবহণের মাধ্যমে। কিন্তু আমরা যদি লোকালি উৎপাদিত খাদ্য কিনি তাহলে কিন্তু সেটা হয় না। আসুন বাসে করে অফিস যাওয়া শুরু করি, একান্তই গাড়ি করে যেতে হলে পুল করা শুরু করি। এভাবেই নিজেদের ছোট ছোট প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজনটাকে দুটো পৃথিবীর থেকে একটা পৃথিবীতে নামিয়ে আনা যায়। আরেকটা আশার কথা বলে শেষ করি, নিচের গ্রাফটা দেখুন, Earth Overshoot Day এগিয়ে আসার হারটা কিন্তু ক্রমশ কমছে যেটা বেশ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু শুধু এতে হবে না, এটাকে পেছোতে হবে, আর তার জন্য আমাদেরকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিতে হবে।