সৌমিত্র দস্তিদার
পূর্ব প্রসঙ্গ: শ্যামাপ্রসাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নির্মাণ
ব্যক্তি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে খাঁটি কথা বলেছেন পৃথিবীবিখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইরন উইনার, যে সে মানুষ নন, ইনি ভারতবর্ষ তথা উপমহাদেশের রাজনীতির বিশেষজ্ঞ হিসেবে সারা পৃথিবীতে শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি বলতেন— শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন আদ্যন্ত চতুর ও সুযোগসন্ধানী এক রাজনীতিক, যাঁর কাছে কোনও আদর্শবাদ নয়, ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকাটাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। যখন যেখানে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, তিনি সেখানেই ছুটে গেছেন।
উইনার সাহেব কোনও বিশ্লেষণ ছাড়া শুধুমাত্র মনগড়া তথ্যের ভিত্তিতে আশুতোষ-পুত্রের ভাবমূর্তি খাটো করতে চেয়েছিলেন তা যে নয়, তা শ্যামাপ্রসাদের সারা জীবনের রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া একজন বিদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভারতের এক রাজনৈতিক চরিত্রের প্রতি সাধারণভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হবেন না, এটা বলাই যায়। অবশ্য এইসব পরোক্ষ কথার মধ্যে না গিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের সালতামামি একটু দেখে নেওয়া যাক। রাজনীতিতে আশুতোষ-পুত্রের হাতেখড়ি কংগ্রেসের কর্মী হিসেবেই। ১৯২০ সালের কিছু আগে-পরে মহাত্মা গান্ধির নানান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট হয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। প্রথম দশ বছর গান্ধিঅন্তপ্রাণ শ্যামাপ্রসাদ হোঁচট খেলেন ১৯৩০ সালে গান্ধিজির আইনসভা বয়কটের সিদ্ধান্তে এসে। আসলে রাজনীতি করতে করতে ততদিনে শ্যামাপ্রসাদ এটা বুঝে গেছিলেন যে ক্ষমতার মধুভাণ্ডটি প্রকৃতপক্ষে সংসদীয় রাজনীতিতেই। পরবর্তী সময়ে সুভাষচন্দ্র বসু যখন সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’-র ডাক দিয়েছেন এবং বৃটিশ বাহিনির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন, তখনও ওসব কঠিন কৃচ্ছসাধনের পথ থেকে শ্যামাপ্রসাদের অবস্থান যোজন যোজন দূরে।
অবশ্য সে সব তো অনেক দূরের কথা। সুভাষচন্দ্র যখন আজাদ হিন্দ বাহিনি নিয়ে মালয় হয়ে মনিপুরে পৌঁছেছেন, ততদিনে শ্যামাপ্রসাদও একজন চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক হিসেবে এদেশের অস্থির পরিস্থিতিতে পাকাপাকিভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক সময়রেখা মোটামুটিভাবে এইরকম— ১৯৩০ সালে গান্ধিসঙ্গত্যাগ, তারপর ১৯৩৭-এ নির্দল প্রার্থী হিসেবে আইনসভায় যাওয়া, ঠিক ওই সময় মুসলিম লিগ ও ফজলুল হকের সঙ্গে জোট বেঁধে ফের ক্ষমতার কাছাকাছি আসা, পরবর্তীকালে প্রয়োজনমতো ফজলুল হককে বিপাকে ফেলে মুসলিমবিদ্বেষী হয়ে বাংলা ভাগের অন্যতম অংশীদার হওয়া, দেশ স্বাধীন হবার পর হিন্দু মসিহা সেজে কংগ্রেসের মধ্যেকার দক্ষিণপন্থী লবিকে হাত করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া— সবমিলিয়ে রাজনৈতিক ধূর্ততায় ও ডিগবাজিতে আজকের যে ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি আমরা দেখে থাকি তারও জনক যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এই নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
হেন কোনও রাজনৈতিক শঠতা নেই যার সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে শ্যামাপ্রসাদ জড়িত থাকেননি। নেহরু মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও একইসঙ্গে হিন্দু মহাসভার রাজনীতি করে দেশের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ বিষিয়ে তোলার পিছনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল আমাদের এই ‘মহান’ বঙ্গসন্তানের। ফলে গান্ধিহত্যার দায়ও কিছুটা হলেও বর্তায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ওপর। দেশভাগ নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত বাণী অনেকেই জানেন যে— ‘ভারত ভাগ হোক বা না হোক বাংলাকে ভাগ করতেই হবে।’ অনেকেই যা জানেন না, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূল শক্তি ছিল তৎকালীন পুব বাংলায়, বরিশাল, খুলনা, নোয়াখালি, রাজশাহীতে। সেখানকার বহু হিন্দু নেতা চিঠি লিখে কাতর হয়ে শ্যামাপ্রসাদকে জানিয়ে ছিলেন যে ‘আমাদের কি কোনও ভূমিকা ছিল না দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে? আমরা তার এই পুরস্কার পেলাম? দেশভাগের পর আমাদের কী পরিণতি হতে পারে আপনি ভেবে দেখেছেন?!’ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এত সব ভাবার মতো ইচ্ছে বা গভীর অন্তর্দৃষ্টি কোনওদিনই ছিল না। আসলে এখন যেভাবে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি নির্মাণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছে, উনি কোনওকালেই অত উচ্চমাপের রাজনীতিক ছিলেন না। সত্যি কথা বলতে কি, শ্যামাপ্রসাদ বাঙালির নয়, পশ্চিমবঙ্গীয়, বিশেষ করে কলকাতা-কেন্দ্রিক যে উচ্চবর্গীয় বাবু বাঙালি, তাদের এক ক্ষুদ্র অংশের নেতা ছিলেন মাত্র।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চরিত্র অনেক বেশি ফ্ল্যাট। সাদামাটা। নেহরু ও জিন্নার গ্ল্যামার তাঁর নেই। সুভাষচন্দ্র বোসের ঔজ্জ্বল্য তাঁর কোনওকালেই ছিল না। মহাত্মা গান্ধির উচ্চতার কাছে তিনি নিতান্তই লিলিপুট। এমনকি মৌলানা আজাদ বা বল্লভভাই প্যাটেলের জৌলুষও শ্যামাপ্রসাদ পাননি। নিঃসন্দেহে শ্যামাপ্রসাদ অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ছিলেন দক্ষ সংগঠক। কিন্তু সবার ওপরে ছিলেন ধূর্ত চতুর ক্ষমতালোভী এক রাজনীতিক৷ যিনি শুধুমাত্র ক্ষমতা অর্জনের জন্য সবসময় পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক তাস খেলে গেছেন। আজকে ভারতীয় জনতা পার্টির যে রাজনৈতিক পুঁজি তার মুল প্রবক্তা অবশ্যই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি কোনওকালেই তাঁর ধাতে ছিল না। বাগ্মী ছিলেন কিন্তু সে বাগ্মিতা ভয়ঙ্কর রকম সাম্প্রদায়িক। মুসলিম লিগের সঙ্গে একসময় উনি ক্ষমতা ভাগাভাগি করে মন্ত্রীও হয়েছিলেন, আবার সেই মুসলিম জনতার প্রতি চরম বিদ্বেষই ওঁকে ভারতের রাজনীতিতে অন্তত আজ না হোক আগামী দিনে নায়ক নয়, খলনায়ক হিসেবেই বাঁচিয়ে রাখবে।
এই বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতিই এখন যে মতাদর্শের ভিত্তি তার অগ্রপথিক হিসেবে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেনানীদের মধ্যে কোনও অগ্রণী চরিত্র না হয়েও নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও চিত্রনাট্যকার মোহিত চট্টপধ্যায় প্রায়ই বলতেন কোনও চরিত্র আপাত ফ্ল্যাট বা একরৈখিক হলে তাকে ফুটিয়ে তোলা বা চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সামনে আনতে গেলে নানা দিকে আলো ফেলতে হয়, তার ভিতরের সব অন্ধকার প্রকাশ্যে আনতে হয়। তাই, হিন্দুত্ববাদীদের শ্যামাপ্রসাদ একরৈখিক, দেশনেতা হিসেবে তাঁর নির্মাণ পুরোপুরিভাবে এক পরিকল্পিত নির্মাণ। এর সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক কম। ইতিহাসের শ্যামাপ্রসাদ এক আদ্যন্ত কমিউনাল চরিত্র। পশ্চিমবঙ্গের মুক্তিদাতা, রূপকার ইত্যাদি আদেখলাপনা করে যারা ইদানিং বাজার গরম করেই চলেছে তাদের আরাধ্য ‘ভগবান’ যে আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক এবং ক্ষমতালোভী ছিলেন, ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার বহু প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। আর ক্ষমতালোভী শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে সঙ্ঘপরিবারের ভেতরেও কতশত অপ্রিয় আলোচনা চালু ছিল, গোলওয়ালকরের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রের আদানপ্রদান তাঁকে কী অস্বস্তিকর আলোয় চিত্রিত করেছে, হিন্দু মহাসভাকে ছেড়ে জনসঙ্ঘ গড়ে তোলার নথিপত্রগুলি, অথবা জনসঙ্ঘের পিছনে আরএসএসের সমর্থন কতটাই বা স্বতঃস্ফূর্ত— শুধু এসব নিয়ে আলোচনা করেই আস্ত একটা গবেষণাগ্রন্থ লিখে ফেলা যায়। পাশাপাশি আর একটা কথাও বলা বোধহয় খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমাদের একটা চেনা ধারণা আছে যে সঙ্ঘপরিবারের মধ্যে কোথাও কোনও সঙ্কট বা দ্বন্দ্ব নেই, তারা একেবারে টিভি সিরিয়ালের জয়েন্ট ফ্যামিলি বা যৌথ পরিবারের মতো সুখী চেহারার বিজ্ঞাপন। বাস্তবে তা কিন্তু নয়। তাদের ভেতরকার অন্তঃকলহ বাইরে কম আসে, এটা ঠিক। কিন্তু সবটাই যে শান্তিকল্যাণরূপ বলে মনে করা হয়, মোটেও তা নয়। বরং শ্যামাপ্রসাদ বনাম সঙ্ঘের সঙ্ঘাত ঐতিহাসিক সত্য। তা হিন্দু মহাসভা ছেড়ে শ্যামাপ্রসাদের জনসঙ্ঘী হওয়ার আখ্যানের ছত্রে ছত্রে পরিষ্কার।
সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য পদে থাকাকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিমদের অবস্থা ছিল সঙ্গীন। অধ্যাপকদের মধ্যে ২৩ জন ছিলেন হিন্দু। মুসলিম মাত্র দুই। পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষকদের মধ্যে এই ভাগটা ছিল আরও খারাপ। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হিন্দুর সংখ্যা দেড়শোর পাশে মুসলিম ছিলেন মোটে বারোজন। তার মধ্যে আরবি ফার্সিতে আটজন। চারজন অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক। রেজিস্টার অফিসে একজন মুসলিম স্টাফও ছিলেন না। অন্যান্য বিভাগেও মেরেকেটে ১৮ জন৷ হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা বলাবাহুল্য তার তিনগুণেরও বেশি। শুক্রবার অর্থাৎ জুম্মাবারে, শ্যামাপ্রসাদ পরীক্ষা ইত্যাদি নানা অজুহাতে মুসলিমদের ন্যায্য অধিকার, ছুটি ও পার্বণ পালনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে একধরনের কুৎসিত আনন্দ পেতেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও চরম সঙ্কীর্ণ ও রক্ষণশীল। মুসলিম-বিরোধী এই হিংস্র রাজনীতি বা দৃষ্টিভঙ্গিই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে আজকের ভারতের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
ব্যক্তি শ্যামাপ্রসাদ কতটা সাদা বা কালো, সেটা আলোচনা করাটা একটা দিক। নিশ্চিত একটা বড় দিক। এবং ব্যক্তি ও রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তবু বলব যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের যে সমালোচনা তা মূলত তাঁর চরম সুবিধেভোগী ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জন্য। প্রথম পর্বে যে সামন্তবাদী শ্যামাপ্রসাদের ছবি এঁকেছিলাম, ৪৩-এর ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সময় নিজের প্রভাব খাটিয়ে প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরি করেছিলেন, তা যে কতটা অশ্লীল তা যে কোনও সংবেদী মানুষের বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। অর্থনীতি ও ভূমিসংস্কার নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। কাশ্মিরসহ অন্যান্য প্রশ্নে নেহরু বা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সঙ্গে আজকের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর যে বিরোধ, তার পিছনেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা বিরাট। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করব পরের পর্বে।