হিন্দোল ভট্টাচার্য
লেখক কবি ও গদ্যকার।
সেনাবাহিনি ও পুলিশবন্ধুরা,
মনে হয়, নিজেদের দিকে তাকানোর সময় হয়েছে আপনাদের। দেশকে রক্ষা করা, দেশের মানুষকে রক্ষা করা আপনাদের কাজ। আর সে কাজে আপনারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেন। শীত বর্ষা গ্রীষ্ম উপেক্ষা করেই। কত মাইনে পান? জানি না। নিশ্চয় তা এমএলএ, এমপিদের মতো নয়। যেমন একজন ডাক্তার দেশকে সেবা করেন, উকিল করেন, কৃষক করেন, শিক্ষক করেন, তেমন আপনারাও করেন। কিন্তু দেশ মানে কী? দেশ মানে কি কাঁটাতার? সীমান্তের মানচিত্র? শত্রু মানে কী? শত্রু মানে কি কাঁটাতারের ওপারে যারা থাকে শুধুই? গুন্ডা মানে কী? স্মাগলার মানে কী? খুনী মানে কী? সংগঠিত হত্যাকাণ্ড মানে কী? হিংসা মানে কী? দাঙ্গা মানে কী? অর্ডার মানে কী? কী আপনাদের ধর্ম? আপনাদের নেতা যদি আসলে এই দেশের মানুষদের বিরোধী হয়, আর আপনারা যদি তাঁদের অর্ডার মেনে আচরণ করেই যান, তাহলে কি আপনি দেশভক্ত? দেশপ্রেমিক? দেশের জন্য আত্মনিবেদন করছেন? একটু ভেবে দেখুন। কয়েকজন খুনি হত্যাকারী অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট শাসক যদি আপনাদের বলে মারো জনগণকে, গুলি চালাও, লাশের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাও বুলডোজার, আপনারা কেন পুতুলের মতো আচরণ করবেন? এই যে এবিভিপির গুন্ডারা জেএনইউ-এর ভিতরে ঢুকে হোস্টেলে ঢুকে রড নিয়ে অস্ত্র নিয়ে তাণ্ডব চালাল ছাত্রছাত্রী শিক্ষকশিক্ষিকাদের উপর নির্লজ্জভাবে, আপনারা চুপ করে থাকলেন। প্রকারান্তরে, আপনারাও আক্রমণ করলেন। আপনাদের মধ্যে থেকেও আওয়াজ উঠল— গদ্দারদের গুলি করো। কেন? কারা গদ্দার? মাইনে পেতে পেতে, অর্ডার পেতে পেতে আপনারা কি মস্তিষ্কশূন্য হাতিয়ার হয়ে গেছেন ফ্যাসিস্টদের? ভেবে দেখুন, আপনারা আর মানুষ নেই, আপনারা শুধুই হাতিয়ার। কারণ মানুষ শুধুই অর্ডার পালন করে না। কোথাও সে অর্ডার পালন করার আগে নিজেকেও প্রশ্ন করে, এই কি তার দায়িত্ব ছিল? প্রশ্ন করে, যাদের বিশ্বাসঘাতক বলা হচ্ছে, তারাই কি আসল বিশ্বাসঘাতক না কি যারা নির্দেশ দিচ্ছে, তারাই বিশ্বাসঘাতক?
ভারতবর্ষে এখন একটা স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে এ দেশকে মুক্ত করার স্বাধীনতা সংগ্রাম। একটা সময়ে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছিল বৃটিশদের বিরুদ্ধে। তখন আপনারাও হয়ে উঠেছিলেন হাতিয়ার। প্রশ্ন এটাই, কেন পুলিশ মিলিটারি কোর্ট মার্শাল হওয়ার ভয়ে শুধুই নির্দেশ পালন করার হাতিয়ার হয়ে যাবে? কেন বন্দুক যারা চালায়, তারা নিজেরাও হয়ে উঠবে বন্দুকের বাঁট? মস্তিষ্কহীন ট্রিগার? না কি, স্বৈরাচারী শাসকদের হিংসা আপনাদের রক্তের মধ্যেও খেলা করে? রক্তের স্বাদ পাওয়া আদিম বাঘের মতো হাতিয়ার নিয়ে আপনারাও শিকারি হয়ে ওঠেন?
ঠিক যেভাবে কখনও গেস্টাপো বাহিনি হয়ে উঠেছিল।
শাসক আপনার দেশ নয় হে পুলিশ, হে সেনা, দেশ হল দেশের মানুষ। সেই মানুষকে মরতে দেবেন না। সেই মানুষকে মারতে দেবেন না। এ দেশের শাসক এখন সর্বসমক্ষে বলছে— বিরোধীদের লাশের উপর দিয়ে এনআরসি হবে। সর্বসমক্ষে যোগীর মতো মুখ্যমন্ত্রী বলছে— বদলা চাই। উত্তরপ্রদেশে যে কত লাশ পড়েছে তার সীমা নেই।
গতকাল দিল্লিতে এবিভিপির গুন্ডাদের আক্রমণে রক্তে লাল হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। আপনারাও কি এমনটাই মনে করেন, যে বিরোধী হলেই তাকে শেষ করে দিতে হবে? বিরোধীর লাশের উপর দিয়ে বিছিয়ে দিতে হবে ফ্যাসিস্ট শাসক মোদি আর শাহ-দের রেড কার্পেট?
নিজের বিবেকের কাছে কী উত্তর দেবেন? ঘুম আসবে তো? নিজের সন্তানের মুখের দিকে তাকাতে পারবেন? একটাই জীবন। মৃত্যুর সময়ে নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য শ্রদ্ধা করতে পারবেন?
দেশ মানে পার্লামেন্ট নয়, বিধানসভা নয়, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি নয়। দেশ মানে সীমান্ত নয়। দেশ মানে দেশের মানুষ।
আজ যাদের রক্ত ঝরছে।
আপনারা কিন্তু আপনাদের কাজ করতে পারছেন না। বরং দেশকেই আক্রমণ করছেন। চুপ করে আছেন দেশের মানুষের উপর এই অত্যাচার,এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দেখতে দেখতে। এই নগ্ন ফ্যাসিস্ট আক্রমণ যে দেশে চলে, সে দেশ কি আমার আপনার বলা যায়?
আজ দিল্লিতে রক্ত ঝরেছে ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলে ক্যাম্পাসে। কাল আপনার শহরে হবে, গ্রামে হবে, বাড়িতে হবে। আর কী ট্র্যাজিক আপনাদের ভূমিকা। ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হয়তো নিজের ভাই, নিজের স্ত্রী নিজের বোন নিজের বন্ধুর রক্ত ঝরাবেন আপনারাই।
অনুগ্রহ করে পক্ষ নিন। হয় হিন্দুরাষ্ট্র নয় ভারতবর্ষ। হয় মানুষ নয় ফ্যাসিস্ট। হয় নাগরিক নয় বিজেপি- এবিভিপির হিংস্র আদিম সেনা। কোনটা হবেন বন্ধু?
মাঝামাঝি কিছু নেই।
ইতি-
একজন করদাতা নাগরিক।