প্রসূন মজুমদার
লেখক কবি ও শিক্ষক।
কোন জানলার পাশে উদগ্রীব দাঁড়িয়ে
মৃত সময়ের দিকে তাকিয়েছিলাম!
স্থির থাকতে পারছি না। সমস্ত ভাবনার জগৎ দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এ কোন সময়ে বাস করছি আমরা! এমন কি হওয়ার কথা ছিল! এমনই কি হওয়ার কথা ছিল না! আমাদের বৃহত্তর ভারতবাসীর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে আজও সাম্প্রদায়িকতার বিষ। অনেক বছরের চাপা আগুন উস্কে দিয়েছে ভাজপা নামের উগ্র সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী দল।
কিন্তু আমরা কি জানতাম না এই বাস্তবতা? সকলেই জানতাম, তবু আমরা যারা লিবারাল তারাও তো ভাবের ঘরে অনেক চুরি করেছি এতদিন। নিরাপদ দূরত্বে বসে থেকে কেবল সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে ভাবনার আদানপ্রদান করে সুখ পেয়েছি। আর সেই ফাঁকে রেজিমেন্টেড স্বয়ংসেবকরা দেশের বৃহত্তর জনমানসে রুয়ে দিয়েছে প্রবল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সেঁকো বিষ। তাই আজ যখন বুঝতে পারছি দ্রুত নেমে এসেছে সন্ধ্যা, অন্ধকার যখন গাঢ় থেকে গাঢ়তর, তখন নিরুপায় আক্রোশে ফেটে পড়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকছে না হয়তো।
তবুও তো সব ভুল ভুলে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। জানি দেরি হয়ে গেছে, তবু কেবলই মনে হচ্ছে আর পলমাত্র দেরিও হতে দেওয়া যায় না। নরকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে আমার দেশ। ধর্মের ধ্বজাধারীরা যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে দেশপ্রেমের নামে সাধারণের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে দ্বেষের গরল। সেই বিষরক্তের যন্ত্রবৎ মানুষগুলো আজ এই ক্ষমতালোভীদের অস্ত্র। আর তাদের চলার পথকে সহজতর করে তুলছে উদাসীন সহনাগরিকেরা। আমাদের আগামী প্রজন্ম জামিয়ায়, জেএনইউ-তে, যাদবপুরে বর্বর সঙ্ঘীদের নৃশংস, পাশবিক অত্যাচারে কেঁপে উঠছে; আর আমাদের প্রতিবেশী একদল মানুষ কী আশ্চর্য ঔদাসীন্যে এখনও শালগ্রামশিলার মতো নিশ্চল! এই ভোগবাদী পৃথিবীতে তাদের থেকে অন্যরকম আচরণ আশা করাই হয়তো এখন অবিবেচনার কাজ, তবু মনে হয় কোথাও মনের নির্জন কোণেও কি এই চুপ করে থাকা সুবিধাবাদীদের লজ্জা হয় না নিজের দিকে তাকিয়ে?
যারা রাতের অন্ধকারে মুখ ঢেকে ছাত্রছাত্রীদের পশুর মতো মেরে যায় তাদের জন্য মনের আর কোথাও সামান্যতম করুণারও স্থান দিতে পারছি না। জানি না কেন, নিজেকে এই গুণ্ডারাজ কায়েম করা শাসকের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকে সংযত করতে পারছি না আমি। কী হবে আজ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিবাদে? কতখানি হবে? রাষ্ট্র যখন তার পেটোয়া সঙ্ঘীবাহিনীকে সন্ত্রাসে লেলিয়ে দেয়, তখনও শান্তির বাণী বর্ষণ করে যাওয়ার মতো সংযম দেখাতে পারছি না কিছুতেই। জেনেছি সার্ত্রের মতো চিন্তাবিদও এমন অসহনীয় পরিস্থিতে রাষ্ট্রীয় ঠ্যাঙাড়েদের দিকে ঢিল ছুড়ে দিয়েছেন একদিন। আসলে কখনও এমনই সময় আসে যখন পরম স্থীতধীর মনেও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এমনই চরম অপমান আর রাগেই স্বয়ং শিব প্রলয়নাচনে মাতেন। দ্রুত আমরা সেই প্রলয়ের দিকেই এগোচ্ছি না কি?
মনে হচ্ছে, দেশ এক ভয়াবহ গণহত্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রায় রকেটগতিতে। আমাদের দেশব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলোর সিংহভাগ নীতিহীন ক্ষমতাতন্ত্রের জালে জড়িয়ে রয়েছে এখনও। যখন বিরোধীদের একজোট হয়ে লড়াই করার সময়, তখন প্রতিবাদ প্রদর্শনেও বিরোধীরা একে অপরকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে নারাজ। এমন অসহায় পরিস্থিতে ভারতের গণতন্ত্র এর আগে বড় একটা পড়েছে বলে মনে হয় না। আমরা আসলে বড় অদ্ভুতভাবে মানুষ হতে চেয়েও হিন্দু-মুসলমান হয়ে আছি, সিপিএম-তৃণমূল হয়ে আছি। অথচ সঙ্ঘ পরিবার বছরের পর বছর ধরে রীতিমতো মহড়া দিয়ে,প্রশিক্ষণ দিয়ে সশস্ত্র হিন্দু রেজিমেন্টেড বাহিনী তৈরি করে ফেলেছে। আমরা এতদিন তাদের দেখেও দেখিনি। তারা আজ হানা দিচ্ছে প্রবল শক্তিতে, আর আমরা সেই পেশিশক্তির সামনে তুমুল অপ্রস্তুত, নিরস্ত্র, একা। যে অবস্থার ইঙ্গিত স্পষ্ট সেটা কিন্তু এই আকালেও গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কারণ ঠ্যাঙাড়ে ফ্যাসিস্টরা আজ ছাত্রীছাত্রদের মার দিচ্ছে দেখে যারা প্রতিক্রিয়াহীন, তারা হয়তো জানেও না যে, ফ্যাসিবাদীর এই মার এখানেই থামবে না। ইতিহাস তার সাক্ষী। এই সন্ত্রাসের আঁচ কিছুদিনের মধ্যেই এসে পড়বে সেইসব প্রতিবেশীদেরও উপর যারা এই শীতের সন্ধ্যায় মলে, মার্কেটে, ক্যাফের নির্জনতায় নিরাপদ উষ্ণতা খুঁজে নিচ্ছে অনায়াসে। এই স্থিতিশীলতার পূজারী আমাদের সম্ভোগপ্রিয় মধ্যবিত্ততার সূতিকাগৃহে যেদিন আগুন লাগবে সেইদিন হয়তো মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে রাস্তায় নামবে, তৈরি হবে গণ-প্রতিরোধ। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। অনেক অনেক বেশি মানুষের মৃত্যুর দায় নিতে হবে আমাদের; কলঙ্কের কাজল মেখে সেদিন প্রায়শ্চিত্ত করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক মতো লোক বেঁচে থাকবে তো?
সঙ্ঘী-দাঙ্গাবাজদের ভয়াবহ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজই যদি রুখে না দাঁড়াই তা হলে ইতিহাস তো দূর নিজের বিবেকও আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। এই জহ্লাদের উল্লাসমঞ্চ কোনভাবেই আমার দেশ হতে পারে না। যতক্ষণ না এই বর্বর রাষ্ট্রশাসকের পরাজয় হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্লজ্জ শাসকের প্রতি নিরন্তর লেখা থাক ক্রোধ, লেখা থাক ঘৃণা।