Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নো পাসারান, আত্মসমর্পণ নয়

সৌমিত্র দস্তিদার

 



লেখক তথ্যচিত্র-নির্মাতা এবং প্রাবন্ধিক।

 

 

 

একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি, যারা মনে করছেন যে জেএনইউ-এর ওপর হামলা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমি তাদের দলে নেই। তাদের দলেও নই যারা স্রেফ বিবৃতি বা বড় জোর মোমবাতি মিছিল করে যাবতীয় প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধিজিকে খুন করার পরে পরেই কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপাত্র স্বাধীনতায় সোমনাথ লাহিড়ী সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। যার শিরোনাম ছিল— ‘শোক নয়, ক্রোধ’। আমি এতবছর পরে এই প্রবীণ বয়সেও মনে করি যেভাবে হিন্দুত্ববাদী গুন্ডাবাহিনি হামলা চালিয়েছে আমাদের সন্তানসম তরুণদের ওপর তাতে নিছক হাহুতাশ করে কোনও লাভ নেই। বিশুদ্ধ শুভ্র ক্রোধই এখন ফাসিস্ত জুন্তার বিরুদ্ধে আপামর ভারতের ভাষা হোক।

কী কী ঘটনা সেদিন জেএনইউ-এর ভেতরে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা ঘটিয়েছিল, কীভাবে বিনা প্ররোচনায় অল্পবয়সি ছাত্র, মূলত ছাত্রীদের মারধর করা হয়েছে, পেশাদার গুন্ডাদের মতন তছনছ করা হয়েছে সবরমতী হোস্টেল তা এখন সারা দুনিয়া জেনে গেছে। গোটা দেশ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। ভারতের বাইরেও নানা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে এই স্বৈরতান্ত্রিক গুন্ডাগিরির বিরুদ্ধে। পৃথিবীর অন্তত সাতটি দেশ তাদের নাগরিকদের ভারতে যেতে বারণ করে দিয়েছে। বহু দেশ এখানে লগ্নি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।

ভারত এখন সত্যিই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এবারের পরিস্থিতি তাই স্রেফ জেএনইউ-এ বা জামিয়া মিলিয়া কিম্বা দেশের অন্যান্য নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা বলে আলাদা করে দেখলে ভুল হবে ।

এবারের লড়াই আক্ষরিক অর্থেই প্রায় স্বাধীনতা যুদ্ধ ।

বাবরি মসজিদ যখন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় তখন আমরা প্রতিবাদ করেছি নিশ্চিত, কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল শহরের অল্প কিছু মানুষের মধ্যে। তারপর গুজরাত গণহত্যা। মোদি-অমিত শার আজকের রাজনৈতিক কৌশলের ল্যাবরেটরি। মেরুকরণের রাজনীতির সূচনা পর্ব। স্বাধীনতার পরে মুসলিম জনগণের ওপর সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা। কয়েক হাজার মুসলিম নিধন। অসংখ্য মসজিদ মাজার দরগা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে সরাসরি বার্তা— হয় পাকিস্তান নয় কবরস্থান। সারা ভারত প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অসংখ্য গান, কবিতা, মিছিল, মিটিং, সিনেমা। এখন এতদিন পরে মনে হয় তা অনেকটাই ছিল শৌখিন। দেখনদারি। ভান। কত কত জায়গায় গেছি গুজরাত ডকুমেন্টারি দেখাতে। মুসলিম মহল্লায়। তথাকথিত বামপন্থীদের নানা ‘অসাম্প্রদায়িক’ মঞ্চে। হাততালি পেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছি অন্তত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সত্যিই অসাম্প্রদায়িক। তখন বুঝতেও পারিনি যিনি বা যারা ছবি দেখছেন ও দেখানোর উদ্যোক্তা তিনিই ছবিতে মুসলিম নিধন দেখতে দেখতে একধরনের তৃপ্তি পাচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে আনন্দ পাচ্ছেন সংখ্যালঘুর হেনস্থায়।

আর মুসলিম মানসে চারিয়ে গেছে একধরনের অসহায়তা। ভয়। তখন যদি সত্যি আমরা প্রতিবাদ করতাম তাহলে সেদিনের বিষবৃক্ষ আজ এভাবে মহীরুহ হয়ে দাঁড়াতে পারত না। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মনে এরকম মুসলিম বিদ্বেষ চারিয়ে যেত না। বিজেপি যত্নে বিষবৃক্ষ লালন করেছে। হাওয়া দিয়ে, সার দিয়ে পরম মমতায় তাকে সর্বভারতীয় করেছে। আমরা, তথাকথিত প্রগতিবাদীরা পলিটিক্স অফ টোকেনেজিম চালিয়ে গেছি। ওই টোকেন বা প্রতীকী রাজনীতির লক্ষ্য যত না সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা, তার চেয়ে ঢের বেশি ভোট রাজনীতি। তাত্ত্বিক লড়াই না করে আমরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিরোধিতাকে স্রেফ কাগজে কলমে আর একটা দুটো মিছিল মিটিং-এ সীমাবদ্ধ রেখেছি। দুহাজার দুই গুজরাতের পরেও আমরা গুরুত্ব দিইনি বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে ঠেকানোর। ঘরে ঘরে গিয়ে আমরা জনমনে চারিয়ে দিতে পারিনি বা হয়তো চাইওনি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা।

আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার শিকড় কখনও মাটির গভীরে পৌঁছয়নি। ওপর ওপর থেকে গেছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। পলকা হাওয়া আসামাত্র তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যাবতীয় প্রতিরোধ। যিনি দুদিন আগেও ছিলেন আগমার্কা বামপন্থী তিনিই দল বদলে এখন কট্টর রামপন্থী। বিপদটা এখানেই। হামলা গুন্ডাগিরি চোখের সামনে হচ্ছে বলে আমরা ছি ছি করছি। কিন্তু মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতা যে বাঘ হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে কী করে আটকানো যায় তা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। আসলে বাঘ বাঘ চিৎকারে আমরা শৌখিন রাজনীতি করে গেছি। মানুষ গুরুত্ব দেয়নি। এখন সত্যি বাঘ এসেছে বলে আপনি যতই বোঝাতে চেষ্টা করছেন, সে আর তখন তার বিপদের গুরুত্ব বুঝতে চাইছে না।

এই পরিসরেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। জেএনইউ বা জামিয়া কিম্বা যাদবপুর কোনওটাই একটার থেকে অন্যটা আলাদা নয়।

এখনও সময় আছে। রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি সঙ্ঘপরিবারের তৈরি ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ফেডারেল কাঠামো ধ্বংস করার বিজেপির কৌশল প্রতিহত না করতে পারলে আজ জেএনইউ হবে। কাল ইউপি। পরশু অন্য কোনও জায়গায় হামলা চালাবে নব্য হিটলারি বাহিনি। অনেক দিন আগে আগুনের ফুলকি আমরা পাত্তা দিইনি। এখন তার আঁচ গায়ে এসে লেগেছে বলে আমরা মধ্যেবিত্ত ভদ্দরলোকেরা আর্তনাদ করছি। কিন্তু ফ্যাসিবাদ আরও ভয়াবহ। মারাত্মক। তাকে আটকাতে হবে। হবেই। এখনও সময় আছে। রাজনীতির শৌখিন রাস্তা ছেড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা— দলিত, আদিবাসী, মুসলিমদের সামনের সারিতে এনে নতুন এক সেকুলার ব্রিগেড গড়ে সর্বত্রই পাল্টা প্রতিরোধের পথই পারে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি প্রতিহত করতে।