অভিজিৎ কুণ্ডু
লেখক জেএনইউয়ের প্রাক্তনী এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
আরএসএস-এর পক্ষে ড্রিল করে সীমান্তে গিয়ে দেশপ্রেম দেখানো সম্ভব নয়। তাই বড়জোর হাতে লাঠি আর রড নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় হামলা করা যায়। সন্ধ্যা নামলে মুখে কাপড় বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে পড়া যায়। মস্তিষ্কের চর্চা ওই ড্রিল করে হয় না, শরীরচর্চা হয়। সেই শরীরের আস্ফালনই আমরা দেখতে অভ্যস্ত, গত ৫ই জানুয়ারি সেই আস্ফালন একেবারে নগ্ন আকার ধারণ করে ঢুকে পড়ল জেএনইউ ক্যাম্পাসে। কাপড়ে মুখ ঢাকা আতঙ্কবাদীদের মতন। বাছুরগুলোকে ছাত্র বলে চালানো গেলেও, সঙ্গে ছিল বেশ কিছু এক্সটেন্ডেড বিদ্যার্থী পরিষদ, বজরঙ্গি দুর্বৃত্ত।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কম ড্রিল করেননি। বেশ ভালোই দৌড়ন মামিডালা জগদীশ কুমার। ওঁকে উপাচার্য করে আনাই হয়েছিল বছর চারেক আগে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র বদলে ফেলা যায়। একের পর এক কর্পোরেট অ্যাজেন্ডা– সে ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট কোর্স চালু করা থেকে বিস্তৃত খোলা ক্যাম্পাসকে রেজিমেন্টেড ব্যারাক বানানো, কনট্রাকচুয়াল নিযুক্তি থেকে পাবলিক সাবসিডি তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা এঁরই অবদান। ইনি শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী কারও ‘সাথে’ আলাপ-আলোচনায় আগ্রহী নন। ভালো দৌড়তে পারেন। কাউনসিল মিটিং থেকে দৌড় দেন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে। উপাচার্য দৌড়চ্ছেন, পেছনে ছাত্র বা শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
জেএনইউ রক্তাক্ত হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক আহত। এই ক্যাম্পাসে শিক্ষকেরা ছাত্রদের আপদে-বিপদে সামনে দাঁড়িয়ে আশ্রয় দেন। নয়া কায়দায় আর একেবারে ছাপ্পামারা সঙ্ঘীদের ফ্যাকাল্টিতে নিযুক্ত করে মামিডালা চেয়েছিলেন নাগপুরের মনের মত ক্যাম্পাস তৈরি করবেন। কিন্তু নাছোড় এই ছেলেপুলেরা লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে নয়া শিক্ষাবিলের বিরোধিতা। পাবলিক এডুকেশন বাঁচিয়ে রাখতে ছাত্র-শিক্ষক ইউনিয়ন সক্রিয়। গোদের ওপর বিষফোঁড়া। শুধু জেএনইউ নয়, সারা ভারতবর্ষে– দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া, মহারাষ্ট্র থেকে কেরালা– সিটিজেনশিপ এক্ট-এর বিরোধী এই ছাত্র-যুবসমাজকে বাগেই আনা যাচ্ছে না। আলিগড়-এ হিংসার বিরোধিতায় জামিয়া মিলিয়া পথে নামছে তো জামিয়ার পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক পথে নামছে। বিচ্ছিন্ন হয়েও ঠিক বিচ্ছিন্ন নয়– কোনদিক সামলাবে স্বরাষ্ট্র দপ্তর? তাই বেশ ভাবনাচিন্তা করেই একেবারে ‘দেশদ্রোহী’দের আড্ডায় আঘাতটা হানা হল।
ওই যে বলছিলাম শুধু ড্রিল করলে আর যাই হোক মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে না। ভুল হয়ে গেছে বিস্তর। মুখ ঢাকা হাতে রড– এইসব ভিস্যুয়াল ভাইরাল। পরিকল্পিত আক্রমণের আগে দুদিন ধরেই ‘ইউনিটি এগেইন্সট লেফট’ হোয়াটস্যাপ গ্রুপে ঢুকে পড়ে কিছু ‘দেশদ্রোহী’ লিক করে দিয়েছে তাদের আদান-প্রদান। আঠারোজন অ্যাডমিন এই গ্রুপের। ট্রু কলার-এর মাধ্যমে ইতিমধ্যে নয়জনকে সনাক্ত করা গেছে, সকলেই বিদ্যার্থী পরিষদের নানা পরিচিত কর্মকর্তা। বাকি নয়জনের ফোন নাম্বারও পাওয়া গেছে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি পুলিশের কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন। অনেকে ব্যঙ্গ করে বলছেন, তিনি আসলে জানতে চেয়েছেন অপারেশন সফল কিনা, সেই রিপোর্ট। কারণ, দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পেরিয়ে সশস্ত্র আক্রমণকারীরা যখন ক্যাম্পাসে ঢুকছে, পুলিশ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি নিষ্ক্রিয় ছিল। অথচ, বৈধ আইডেন্টিটি কার্ড থাকা সত্ত্বেও বাইরে বেরিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারেনি অনেকে। আলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মূল গেটের সামনের রাস্তায়৷ আর নাৎসি কায়দায় স্লোগান উঠেছে– এখানেই কবর দাও কম্যুনিস্টদের। দেশ কি গদ্দারোকো, গোলি মারো শালো কো। নিজেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে আমরা অসহায়ের মতো দেখেছি এইসব ঘটনা।
পরেরদিন। সন্ধে নামার আগেই সেইসব কুৎসিত স্লোগান মূল গেটের বাইরে শুরু হয়েছে। ওয়ান ইন্ডিয়া, স্বরাজ্য– এই ধরনের নিউজ পোর্টাল সম্প্রতি চালু করেছে– সেই নতুন দুহাজার টাকার নোটে ন্যানো চিপ-এর মতো প্যারালাল গালগল্প। কে প্রথম আঘাত হেনেছে৷ লিখলাম, যা যা চাক্ষুষ করেছি গত রবিবার। ইতিমধ্যে বাঁহাতে প্লাস্টার, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে ছাত্রসংসদের প্রেসিডেন্ট প্রেস মিট করে ফেলেছে ক্যাম্পাসে ফিরেই। অদম্য স্পিরিটেড ঐশী বলছে, “প্রত্যেকটি লোহার রড, আঘাত ডিবেট আর ডিসকাশনের মধ্যে দিয়েই ফেরত দেবে।” বন্ধু অধ্যাপিকা সুচরিতা আঘাত নিয়েও বলেছে– “এ আঘাত সেরে যাবে। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাসটাকে স্পেস অফ টেরর করে ছেড়েছে এরা।”
বাই দ্য ওয়ে, ডিবেট ডিসকাশনে কি ফ্যাসিবাদকে হারানো গিয়েছিল?