অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
লেখক কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক।
চিতা যখন জ্বলছে তোমরা চাও তখন আমি আলোর কথা বলি। বলব আলোর কথা।
কিন্তু মুশকিল হল এই যে চিতার আগুনের যে আলো, তাতে বড় বেশি মাংস পোড়া গন্ধ। এই গন্ধটা থেকে থেকেই পাচ্ছি জানেন? দেশ মানে যে “আমি”র কাছে একটা ভূখণ্ড নয় কেবল, একটা প্রায় ত্রিভুজাকার মানচিত্র নয়, অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ নয়, এমনকি কোন নির্দিষ্ট রংও নয়, বরং অনেক অনেক আরও অনেক মানুষের সমষ্টিগত বেঁচে থাকা– সেখানে, যদি কণ্ঠরোধকারী শক্তি নিজের সবকটি দাঁত নখ বিস্তার করে পেশী প্রদর্শনের খেলায় নামে, তখন এই পোড়া গন্ধটা বড় তীব্র ঠেকে।
এ কোন সময়ে এসে দাঁড়ালাম আমরা যখন এক ভয়ানক অস্থিরতায় নিজেদের বিপন্নতা বয়ান করতে গিয়েও শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের সতর্কবাণী শুনে নিতে হয়! সাবধান করে দেন তাঁরা। কারণ নিজের কথা নিজের মত করে বললে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না আর। কিন্তু শিক্ষক জীবনের কুড়ি বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে যখন দেখি এক বিপুল তরঙ্গধারা প্রবল জোয়ারে এগিয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিপরীতে তখন শিক্ষক হিসেবে গর্বে উজ্জীবিত হই বইকি। তবে যে শুনছিলাম এই প্রজন্ম নাকি মোবাইল গেম, হরর সিরিজ, নিজের কেরিয়ার, বিদেশে যাওয়ার সুযোগ, আর মলসংস্কৃতির মধ্যে আটকে স্থবির! ধান্দাবাজি শব্দটা যে আসলে ওদের আগের প্রজন্মগুলোরই তৈরি করা, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ছেলেমেয়েগুলো। আর তাইই দেশ, সমাজ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, নাগরিকতা, সংবিধান সমস্ত কিছু যখন হয় বিকিয়ে যাওয়া অথবা লুঠ ও লাঞ্ছনার পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ভয়ানক সম্ভাবনার সামনে দাঁড়াতে দেখে এরা পিঠ পেতে মাথা পেতে লাঠি আর বুলেট সামলায় তখন ওই প্রত্যেক মারের দাগ, কালশিটে, রক্তবিন্দু আমার হাড়ে মজ্জায় চামড়ায় আছড়ে পড়ে। প্রতিদিন স্কুলের প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে যে আমি কচি মুখগুলোর সঙ্গে, কিশোর গলাগুলোর সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলানোর সময় “তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে/ গাহে তব জয়গাথা” উচ্চারণ করে ভিতর থেকে আর্দ্র হই এক সত্যিকারের শুভ বোধে, সেই আমিই ভয়ানক বিপন্ন বোধ করি রাজনৈতিকভাবে সারা দেশ জুড়ে ঘনিয়ে তোলা অস্থিরতার খেলায়। আমরা শেখাব প্রতিবাদ, আমরা শেখাব নৈতিকতা, আমরা শেখাব কাঁচা মাটির তালগুলোকে ভাস্কর্যের রূপ নিতে আর সেই আমরাই ওদের সত্যিকারের বিপদে চোখ বন্ধ করে বসে থাকব? হয় না, সে হয় না। রাজধানীর বুকে বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই হোক, বা আমার প্রান্তিক মফস্বলের প্রতিদিনের জীবনে অজস্র লড়াইয়ে জড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলো– তোরা আমাদের সন্তান। আমরা যে প্রতিবাদ গলা তুলে করতে পারি না, ভয় পাই প্রতি মুহূর্তে নিজেদের স্থিতি হারানোর, এরা সেই না-পারার দায়ভার নিজেদের শরীরে তুলে নিচ্ছে। স্যালুট রে তোদের। অগ্রজের শ্রদ্ধাও।
উল্টো দিকে বরং দেখি ভীতু ন্যুব্জ হাফগেরস্ত আপসকামী অসীম সহ্যক্ষমতায় আচ্ছে দিনের ওপর ভয়ে বা ভক্তিতে প্রকাশ্যে মৌন আর আড়ালে সাবধানী বয়স্ক বাচ্চেলোগদের উদাসীন সেজে থাকা মুখ। যিনি হয়ত বলতে চেয়েও কিছু পারছেন না বলতে তিনিও দিনের শেষে শ্বাস লুকিয়ে ফিসফিস করছেন– বড্ড খারাপ দিন এলো! তাকে সাহস দিচ্ছে এই উচ্ছল জনজোয়ার। কিন্তু অন্যরকম ফ্যাসিস্ত মুখগুলো? রাজার মন্দিরে যারা ভক্ত সেজে না এসেও পাশ কাটিয়ে “কী দরকার বাবা!” বলে স্বেচ্ছা অন্ধতা বেছে নিচ্ছেন, তারা? প্রত্যেক দশকের নিজস্ব কিছু সঙ্কট ও সমস্যার কথা বলে এই সময়ের আসন্ন বিপদকে বোধহয় লঘু করা যায় না। এরকম তীব্র জাতপাতের রাজনীতি, মানুষের ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তীব্র নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি, যেকোনও সংস্থার যেকোনও মুহূর্তে বন্ধ বা বেসরকারিকরণের সম্ভাবনা আর প্রতিবাদ করলেই তীব্র ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখোমুখি হতে হওয়া সময়ে যে পারস্পরিক ঘৃণা অবিশ্বাস আর সন্দেহর মেঘ ঘনিয়ে উঠছে, যেভাবে ভাগ হয়ে যাচ্ছি আমরা দেশবাসী এক বিপরীত শিবিরে, চূড়ান্ত পর্যায়ে যা হয়ত অবশ্যম্ভাবীই– কাম্য নয় কখনওই। বারবার শিক্ষালয়গুলির ওপর বর্বর আক্রমণ– একটা কথা বুঝিয়ে দেয় স্বৈরাচারী শাসক আসলে মেধাকে ভয় পায়। শিক্ষিত জনগণকে ভয় পায়। কারণ মেধাবী মন, প্রকৃত শিক্ষিত মনগুলোকে যে ধর্ম জাতপাত জাতীয়তা কোন কিছুর আফিম গিলিয়েই চুপ করিয়ে রাখা যায় না। প্রশ্ন, নিরন্তর প্রশ্ন তুলতে শিখে যায় তারা আর ফ্যাসিস্ট শাসকের তো সেখানেই সমস্যা। গো-পূজারী ভারতবর্ষের স্বপ্ন তো এই সচেতন মগজগুলো বিশ্বাস করে না। সুতরাং ঘাতক সৈন্য ডেকে, মারো মারো ওঠো হেঁকে। খুলিটাই দাও ফাটিয়ে। নাহলেই প্রশ্ন তুলবে এরা কিসের অধিকারে অন্যায়ভাবে মানুষের ন্যূনতম দাবি ও মৌলিক অধিকার বিঘ্নিত করার সাহস দেখায় একটা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল! মধ্যপন্থী সুবিধাভোগী ভীতু মাঝবয়েসী ভাতঘুমের প্রজন্ম আমরা আর কিছু না পারি মুক্তচিন্তার পরিসরের জন্য লড়ে যাওয়া কাঁচা মুখগুলোর পাশে দাঁড়াতে তো পারি! নয়ত সমকাল বা মহাকাল কেউই কিন্তু ক্ষমা করবে না আমাদের।
ইতিহাস বলে– স্বৈরাচারী শাসকের শেষের সেদিন শোচনীয়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে থাকব আমরা? নাকি এই হাতে এই সময়ের রক্ত ঘাম কান্না মুছিয়ে দিতে উদ্যোগী হব? সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় ও অধিকার আমাদের একান্তই নিজস্ব। কিন্তু যে কোনও পদক্ষেপ আমাদের দেশের মুক্তচিন্তা, সুস্থচিন্তা ও নিরপেক্ষতার পক্ষেই যেন হয়। দুষ্কৃতি ও গুন্ডাবাহিনি পুষে রাখা সরকার বা রাষ্ট্রের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে একবার আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখুন। দেখুন তো নিজের নিস্পৃহতা আর নিষ্ক্রিয়তার জন্য নিজের প্রতিই ঘৃণা তাতে প্রতিফলিত হচ্ছে না তো?