Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফ্যাসিস্টদের শিক্ষা হয় না

পবিত্র সরকার

 



লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

 

 

 

 

বিজেপি কি ক্রমশ মহা ফুর্তিতে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে চলেছে? নইলে গতকাল জেএনইউ হোস্টেলের ঘটনাটা ঘটে/ঘটায় কি করে? এই সে দিন পরপর কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনে সে দল মনোরমভাবে হারল, সরকার থেকে উৎখাত হল, তারপর এনআরসি, সিএএ– এ সবকিছুর বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে দেশ টালমাটাল হল– এখনও তার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে এখানে-ওখানে– আবার কখন কোন স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবে তারই সুখকর প্রতীক্ষায় ছিলাম আমরা। সেই প্রতীক্ষার বুঝি অবসান হল। এর মধ্যে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বসেছিল যে ছাত্রছাত্রীরা, তাদের ওপর মুখোশধারী গুন্ডারা লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, রক্তাক্ত করে দিল তাদের! আক্রমণকারীরা নামধারী বিজেপি নয়, তাদের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের ‘জয় শ্রীরাম’ উদ্বেলিত মস্তান বাহিনি। তারা মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছে ছাত্র সংসদের সভাপতি ঐশী ঘোষকে, অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন আর আরও অনেক অধ্যাপক আর ছাত্রছাত্রীদের। লাঠি আর রড হাতে নিয়ে এই বীরপুঙ্গবেরা অস্ত্রহীন ছাত্রছাত্রী– মহিলা বলে কাউকে রেয়াত করার হাস্যকর কাপুরুষতা দেখায়নি এই বজরঙ্গবলীর শিষ্যরা– বেধড়ক পিটিয়ে হাতের সুখ আর মনের সুখ নিয়ে ফিরে গেছে।

এরা যে অতুলনীয় কাপুরুষ, তার এক নম্বর প্রমাণ এদের মুখোশ– মুখটি ঢেকে এসেছে সযত্নে পাছে, কেউ চিনে ফেলে বিজেপির চেনা গুণ্ডাসদস্য হিসেবে। ছাত্রজীবনে আমাদেরও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে মারপিট হত, কিন্তু স্বপ্নেও মনে হয়নি মুখ ঢেকে মারপিট করার কথা। আর এ তো রুটিন মারপিট নয়, মেয়েদের ওপর হিংস্র, বর্বর আক্রমণ। কাপুরুষতার দ্বিতীয় প্রমাণ হল অস্ত্রধারী পুলিশকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে এই দাঙ্গা। ওরা কি ভেবেছিল প্রতি-আক্রমণ হলে পুলিশ তাদের রক্ষা করবে, মার খেয়ে বাপ বাপ বলে পালাতে গেলে পুলিশ তাদের অনারব্ধ ব্রত হাতে তুলে নেবে? মেয়েদের এত ভয়– সত্যি কি অসাধারণ বীরপুরুষ এরা! উত্তর প্রদেশে পুলিশই ছিল আক্রমণকারী, গুলি চালিয়ে মানুষ খুন করে শেষ করতে চেয়েছিল প্রতিবাদ। আর এখানে কি পুলিশ সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স? বীরপুরুষেরা ব্যর্থ হলে পুলিশ তুলে নেবে মারধর করার পবিত্র দায়িত্ব? তাই কি ছিল এবারকার গেম প্ল্যান?

প্রশ্ন হল পুলিশকে ডাকল কে? পুলিশ যে আগেভাগে সেখানে উপস্থিত ছিল, সেটা কার নির্দেশে? তাদের কি কেউ বলে রেখেছিল যে, দেখো ভাই, আমার বাছারা একটু পেটাবে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের, তাদের ওপর ঝামেলা হলে তোমাদের হাতে তো লাঠি-রাইফেল আছেই, তাই সঙ্কটকালে কী করতে হবে আশা করি তা বাপধনরা অ্যাদ্দিন পরে আর বলে দিতে হবে না। উত্তর প্রদেশে তোমাদের ভাই-বেরাদরেরা কী করেছে তা তো জানোই। এই লেখকের ছেলেবেলায় বিহারে শ্রীকৃষ্ণ সিংহ বলে একজন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি এক ছাত্র-মস্তানবাহিনি তৈরি করেছিলেন, তাদের তিনি বলতেন ‘জিগরে-কে টুকরে’, মানে হৃদপিণ্ডের টুকরো। তা বিজেপি এই হৃদপিণ্ডের টুকরোরা আরও জিগরে-কে টুকরে পুলিশকে পাশে নিয়ে যখন জেএনইউর হোস্টেলে লাঠির সুখ করছে, পুলিশেরা দাঁড়িয়ে দু চোখ পরিতৃপ্ত করছে, আর সেই সঙ্গে নিশ্চয়ই ভাবছে আমাদের হাতে এরা একবার কেন ব্যাপারটা ছেড়ে দিচ্ছে না, তাহলে যোগীবাবার ইউপি তো ইউপি, ইউপি বাবার বাবা দেখিয়ে দিতাম।

আবার ওই ঘ্যানঘ্যানে বিরক্তিকর প্রশ্ন, পুলিশকে ডাকল কে? তাদের কি বিনাটিকিটের দর্শক হিসেবে নিছক বিনোদনের জন্য ডাকা হয়েছিল, এই ‘শো’-টি দ্যাখার জন্য? উপাচার্যের হুকুম ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পুলিশ ঢুকতে পারে? যে উপাচার্য নিজের ছাত্রছাত্রীদের নির্যাতন দেখানোর জন্য পুলিশকে ডাকে, তাকে লক্ষ বার ‘ছিঃ ছিঃ’ আর ‘ধিক’ বলেও ঘেন্না যায় না। নিজে একসময় ওই ফালতু চাকরি করেছি বলে আরও বেশি ক্ষোভ, আরও বেশি ঘেন্না। এই অবস্থায় যেকোনও উপাচার্যের পদত্যাগ করা উচিত ছিল, যদি সে মনুষ্যপদবাচ্য জীব হত। কী জানি, মানুষের মতো দেখতে হলেই যে সকলে নির্ভুলভাবে মানুষই হবে, আর কিছু নয়, তা কে বলতে পারে?

পৃথিবীর ফ্যাসিস্ট আর শিক্ষানবিশ ফ্যাসিস্টরা আর কবে শিখবে, কতবার ধ্বংস আর বিলুপ্ত হতে হতে শিখবে যে, অত্যাচার করে প্রতিবাদের শেষ করা যায় না। উত্তর প্রদেশের পুলিশ হয়তো এখন বুঝেছে যে, খুন করলে একটা প্রতিবাদী কণ্ঠ নিস্তব্ধ হয়, কিন্তু তার পাশে হাজার নতুন প্রতিবাদী কণ্ঠ জেগে ওঠে। মুখে যাই বলুক, এইখানে বিজেপি বড় ভুল করল, আর-একবার সারা দেশে প্রতিবাদ জ্বলে ওঠবার প্ররোচনা দিল। এই প্রতিবাদ তাদের কোন্‌ আস্তাকুঁড়ে নিয়ে ফেলবে তারা হয়তো নিজেরাও তা জানে না।