Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঐশী ও তার বন্ধুরা, শোনো

দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 



লেখক কবি ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক।

 

 

 

প্রথমে জামিয়া তারপর জেএনইউ। প্রত্যাশিতই ছিল এই আক্রমণ। হস্টেলে ঢুকে অপ্রস্তুত পড়ুয়াদের ওপর হামলা, মেয়েদের হস্টেলে তান্ডব, বেছে বেছে প্রতিবাদী ছাত্রীদের ঘরে ঢুকে বেপরোয়া মারধর, ভ্যাজাইনা লক্ষ্য করে লাঠি আর রড দিয়ে নির্মম আঘাত, ঐশী ঘোষের রক্তাক্ত মুখ– এসব আজ আর হতবাক করছে না আমাদের। বরং আমি দেখতে পাচ্ছি একটা শেষের শুরুকে। স্পষ্ট হচ্ছে ফ্যাসিস্ট শাসকের ভয়। হ্যাঁ, ভয়। ওরা ভয় পেয়েছে। অন্ধকার যেমন আলোকে ভয় পায়, মিথ্যা যেমন সত্যকে। লাঠি-রড-হুমকি-গুন্ডামির মুখে যারা দেশের সংবিধানকে তুলে ধরে, যারা মেধাবী বলেই জাতির অর্থে পড়াশোনাকে অধিকার মনে করে, শাসকের এই ভয় তাদের হক। আমি একজন সামান্য শিক্ষক হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরতা একটি মেয়ের বাবা হিসেবে এই ছেলেমেয়েগুলির জন্য গর্বিত।

ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি অবিসংবাদিতভাবে শ্রেষ্ঠ। এই বিশাল ভূখণ্ডের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র যারা, বিশেষত মানবিকী বিদ্যার ছাত্রছাত্রীরা, দশকের পর দশক জেএনইউতেই পড়তে চেয়েছে। এই ক্যাম্পাসের মাটিঘেঁষা বিদ্যাচর্চার ধারা, এর মুক্তচিন্তার পরিসর, সুস্থ রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চা কেবল দেশের মধ্যে নয়, দেশের বাইরেও মর্যাদা পেয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। এই বিদ্যায়তন বহুবার দেশকে গর্বিত করেছে। অথচ, দুর্ভাগ্যজনক হলেও অবধারিত এই সত্য, দেশের সরকার ও সরকারি দলের কাছে জেএনইউ একটি ঘোষিত শত্রু। এক একবার মনে হয় সম্ভব হলে এরা জেএনইউ ক্যাম্পাসে কার্পেট বম্বিং করবে। আসলে এরা ভয় পায় এই সতর্ক বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রটিকে। একই রকম ভয় যাদবপুর, হায়দ্রাবাদ, ইদানিং পন্ডিচেরিকেও। ভয় থেকেই আক্রমণ। আর এই ভয়ের মধ্যেই নিহিত আছে ফ্যাসিবাদের মৃত্যুবীজ।

যেমন সত্যের মধ্যে মিথ্যার, আলোর মধ্যে অন্ধকারের মৃত্যুর পরোয়ানা লেখা থাকে।

আজ গোটা ভারতবর্ষ দাঁড়িয়ে গেছে মারখাওয়া ওই ছেলেমেয়েদের পিছনে। হিন্দু বা মুসলিম ভারতবর্ষ নয়, বহুধা বিভক্ত এই দেশের পোশাকি চেহারার অন্তরালে যে দেশ, সেই দেশ আজ ফিরিয়ে নিতে চায় তার সমর্থন। দেশের এই জেগে ওঠার পিছনে আছে অনেক বড় এক দুঃখের, অপমানের আঘাত। ভারতীয়কে আজ হঠাৎ প্রমাণ করতে হবে সে ভারতীয়। তার ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশনকার্ড সব বৃথা। তাকে খুঁজে বার করতে হবে ঠাকুরদার দলিল, সেই ঠাকুরদার সঙ্গে তার সম্পর্কের নিশ্চিত কাগুজে প্রমাণ। না পারলে সে আর নাগরিক নয়, উদ্বাস্তু কিংবা অনুপ্রবেশকারী। শাসকের কী হুঙ্কার– ‘সারা দেশে এনআরসি হবে’। আরও ভয়ঙ্কর– বলছে সব হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেবে, কিন্তু…। দেশটা সেক্যুলার না? এরা তো দাঙ্গা বাধাতে চায়। দাঙ্গা তবু বাধে না। ছাত্ররা খুলে দিচ্ছে অপরাজনীতির মুখোশ। মার খাচ্ছে, তবু তেরঙ্গা পতাকা হাতে গান গাইছে। জেএনইউ, জামিয়া, হায়দ্রাবাদ, যাদবপুর নয় কেবল, সুর উঠছে ঝাড়খণ্ডে, ছত্তিশগড়ে, এমনকী গুজরাটেও। কোথায় ছিল রে এরা? আমারই সন্তান, আমারই, আমারই?

ঐশী ও তার বন্ধুরা শোনো, দেশ আজ তোমাদের দিকে তাকিয়ে। ভয় যে তোমরা পাবে না তা আমরা জানি। সেই সঙ্গে আশা করতে চাই, শিক্ষিতে-অশিক্ষিতে কিংবা সুশিক্ষিতে-কুশিক্ষিতে যে ভেদ আজও রয়ে গেছে, তোমরা ছিঁড়ে ফেলবে সেই কাঁটাতার। তোমাদের ভাষায় যারা ‘ভক্‌ত’, যারা ‘চাড্ডি’, তাদের পরাজিত করো, কিন্তু ঘৃণা নয়। হতভাগ্য ওই যুবগোষ্টীও আমার স্বদেশ। আমার সন্তান। দলে টানো– কেবল হতভাগ্য ত্রিশঙ্কুকেই নয়, ওদেরও। চাই ধৈর্য, সাহস, মনোবল আর অপার ভালোবাসা। তোমরা তোমাদের চেয়েও বড় হয়ে ওঠো।