মণিশংকর বিশ্বাস
লেখক কবি ও গদ্যকার।
The biggest mistake of a democratic country is to underestimate the power of a democratically elected pro-fascist leader because it is always easier to destroy a castle from within!
―Mehmet Murat ildan
প্রথমেই বলে রাখি, জেএনইউ-র সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিষয়ে আমি এমন কিছুই জানি না, যা আপনারা জানেন না। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহকে ধন্যবাদ, যে এরা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধস্বরগুলিকে একত্রিত হবার জন্য সর্বতো সাহায্য করেছেন। তবে হ্যাঁ, ভারতবর্ষে এখনও কোনও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়নি। আমরা যারা ‘সংখ্যালঘু’ অর্থাৎ সমকামী, ডিসলেক্সিক, বনবাসী, বানজারা, বিধর্মী, নাস্তিক, ‘দেশদ্রোহী’, তাঁরা একজোট হতে পারিনি। রক্ত বয়েলিং পয়েন্টের কিছুটা আগে বুড়বুড়ি কাটছে। এর জন্য কি ডিসেম্বর/জানুয়ারির অভূতপূর্ব শীত দায়ী? আমি জানি না। সত্যি বলতে কী, ওই ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চির’ প্রজ্ঞাবান ভাঁড়ও হয়তো এতটা আঁচ করতে পারেনি। আমার তো ধারণা, ফ্যাসিস্টরা চেয়েছিল দুঃসময়ে ‘সংখ্যালঘু’রা সব নিজ নিজ পতাকাতলে সমবেত হয়ে রাজপথে মিছিল করতে গিয়ে সংখ্যাগুরুর পদপিষ্ট হবে।
জমি প্রস্তুতই আছে। এই শুকনো মাটি এখন সিঁদুরলেপা হাড়িকাঠের নীচে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত। কে-না জানেন, সংখ্যালঘুর রক্তে একটা থকথকে জেলিভাব থাকে! ভারতবর্ষকে উপর থেকে দেখলে এখন মনে হবে, একটি বিশাল ধর্মান্ধ জন্তু। তার এই জবরজং শরীর, রোমশ শরীরের নীচে উদগ্র চর্বির বাহুল্য ও দাহ্যতা… তবু আশ্চর্য, তার গায়ে এখনও একটি মশাল তো দূরের কথা, একটা জ্বলন্ত দেশলাই কাঠিও কেউ ছুঁড়ে মারেনি! আমার স্পষ্ট মনে হয়, তার একটা কারণ— শিক্ষিত, পরিশীলিত মানুষ এখনও হাসছে!
আমরা নৈতিকভাবে হিংস্র ও মোটিভেটেড একটা রেজিমেন্টকে বলছি, হাফপ্যান্ট-পরা হনুমানের দল। আমরা ধূর্ত ও হিংসাশ্রয়ী এক ফ্যাসিস্টের শারীরিক চেহারায় জাম্বুবানকে আবিষ্কার করে যারপরনাই আহ্লাদিত। দিলীপ ঘোষের মাথায় ঠিক কতটা গোমূত্র আছে, সে বিষয়ে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্তর গবেষণা করেছি। বিপ্লব দেব ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হবার পর যে ‘ছিপিএম’ আর ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ বলতে পারছে না, সেই নিয়ে মিম বানিয়েছি। নিজেদের এই ক্রিয়েটিভটি দেখে নিজেরাই হেসে গড়িয়ে পড়েছি আমরা। আমরা বুঝেছি ও বুঝিয়েছি, রাজ্যপাল পাশের বাড়ির বিয়েতে নেমন্তন্ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হয়েছেন। সিরাজদৌল্লার সঙ্গে উচ্চারণগত মিল থাকায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী রসগোল্লা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ভুল বানানের মিম দেখে, হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরেছে, চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। আর সেই প্রায়ান্ধ, বোজা চোখের সুযোগে কাশ্মিরের অপ্রেসর, হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা শাসকদল, সংখ্যালঘুদের রাস্তায় জ্বলন্ত কয়লা বিছিয়ে দেওয়া মিসোজিনিস্টিক সরকার, আবার নতুন নতুন অপকর্মে হাত পাকিয়েছে। অপকর্মের এই তালিকার খুব নীচের দিকে থাকবে, শিক্ষাঙ্গনে করসেবকদের ‘ছাত্র’ হিসেবে ঢুকিয়ে দেওয়া। হিন্দুস্থান টাইমস-এ লিখেছে এবারকার ঘটনার দিনে ‘বহিরাগত’ গুণ্ডারা এবিভিপির ছাত্রদের সারি সারি ঘরগুলিতে কেউ টাচও করেনি। এরা কিন্তু ছাত্রই, বহিরাগত নয়। মানে চিরকাল বামপন্থায় বিশ্বাস করা জেএনইউতে ইতিমধ্যে প্রচুর এবিভিপি ক্যাডার তৈরি হয়েছে। সঙ্গে তো আরএসএস-এর অধ্যাপক, একটা পুতুল অধ্যক্ষ আছেনই। তো এইভাবেই বিজেপি সর্বত্র গৈরিকীকরণের পোঁচ দিয়ে চলেছে। জেএনইউ-র মতো স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বাদ পড়েনি!
একটা বিষয় আমাদের পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে। এই যে আমরা চারিদিকে ফুঁসে ওঠা জনগর্জন, জনরোষ শুনতে ও দেখতে পাচ্ছি, এই যে এত এত গুণীজন, সংবিধান-বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, ফিল্মমেকার, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, এনআরসি, সিএএ, জেএনইউ ইত্যাদি নিয়ে সরব হচ্ছেন, আপনার আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যা ভাবছি— সেইসব কথায়, দুঃখে রাগে বেদনায় বিষোদ্গারে আমাদের নিউজ ফিড ভরে যাচ্ছে, তার সবকিছুর লক্ষ্যপরিধি কিন্তু খুব সীমিত। আমি জানি এই লেখাটিও যারা পড়বেন, তাঁদের অধিকাংশই আগে থেকেই মোটামুটি আমার সঙ্গে একমত। বর্তমান ভারতের সংখ্যাগুরু মানুষের মনে সংখ্যালঘুর প্রতি যে ঘৃণার শিকড়টি ক্রমে দীর্ঘায়ত হয়েছে তা উপড়ে ফেলা ক্রমে আরও কঠিন হচ্ছে, বরং সে আরও ডালপালা মেলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির ছেলেটি বা বহুজাতিক কোম্পানির মোটা টাকার ম্যানেজারকে শুধুমাত্র এলিটিজম দোষে উপেক্ষা আর অবজ্ঞা করে এই শিকড় উপড়ে ফেলা যাবেও না। দেশপ্রেমের সবচেয়ে সহজ সেন্টিমেন্টাল সংজ্ঞাটিকে যেভাবে ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ভারতের শাসক দল সংজ্ঞায়িত করেছে, তাকে বদলে দিতে গেলে একটা শক্তিশালী, সাধারণ মানুষের বোধগম্য ন্যারেটিভকে সামনে নিয়ে আসা অনিবার্য। সে যে ভাষা বোঝে সেই ভাষাতেই তাকে বোঝাতে হবে। একটা উদাহরণ দিই, জেএনইউর এই সময়েই প্রমীলা বর্মণকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সাধারণ মানুষ বলতে শুরু করেছে, বুদ্ধিজীবীরা জেএনইউ বা ঐশী ঘোষকে নিয়ে যতটা বলছেন, প্রমীলাকে নিয়ে ততটাই নীরব। অথচ দুটো ঘটনার তুলনাই হয় না। একটা ঘটনায় ক্ষমতাসীন সরকারের মদত, প্রকারান্তরে ছদ্মবেশে রাষ্ট্রশক্তি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুণ্ডা ঢুকিয়ে বিরুদ্ধমতকে কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে, আর অন্যটি ঘৃণ্য অপরাধ, মর্মান্তিক, দুঃসহ এবং অভাবনীয় ঘটনা। এই ঘটনা নিয়ে ভাবতে গেলে এত কষ্ট হয় যে মানবতার উপর সাময়িকভাবে বিশ্বাস চলে যায়। শিশুকন্যাটির দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারি না। কিন্তু এতে দেড়শো কোটি মানুষের নির্বাচিত সরকারের পরোক্ষ মদতের ছায়াটুকুও নেই। তাছাড়া এটাও বুঝিয়ে বলতে হবে যে, “বুদ্ধিজীবীরা এই ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না”— এই প্রচারও বৃহৎ এক রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার অংশ।
একটা ছবি দেখেছিলাম। স্লেটে অজস্র হিজিবিজি। অন্তত প্রথম দেখায় আমার তাই মনে হয়েছিল। পরে জানতে পারি ওটি একটি মাকড়সার জাল। মহাকাশে স্পেস স্টেশনে ভারশূন্য স্থানে একটি মাকড়সা ভেবলে গিয়ে ওটি নির্মাণ করেছে। এই ভারতের অবস্থা ঠিক ওরকম। হিজিবিজি। এরপর, আমি পরের ছবিটার কথা বলব। পরের ছবিতে সেই একই মাকড়সা যে জালটি রচনা করেছে, তা কিন্তু দিব্য। ঐ ক্ষুদ্র একটি মাথা, সেও নিজেকে অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে মহাকাশের ভারশূন্যতায়। মানে অভিকর্ষহীনতাকে জয় করে নিয়েছে। চালিকাশক্তি? মাইক্রোগ্র্যাভিটি। বর্তমান ভারতেও একমাত্র মাইক্রোগ্র্যাভিটি হল ভালোবাসা, ধৈর্য, সময় নিয়ে বোঝানো, উপেক্ষা বা অবজ্ঞার হাসি নয়।