Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমার ভারতবর্ষ

পূর্বা মুখোপাধ্যায়

 




লেখক কবি ও গদ্যকার।

 

 

 

 

আপসহীন বেঁচে থাকা বলে কিছু হয় না। স্বার্থ যতদিন, আপস ততদিন। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একটি মহাআপস। আপনি আমি মরুভূমির উট, কাঁটা বেছে খেতে পারি না। কাঁটা খেয়ে হজম করার মতন পাকস্থলীর জোর, বংশানুক্রমে আমাদের আছে। আমাদের স্তম্ভিত করে একটা অতর্কিত ঝড় উঠল। আমরা কি আপসের বোঝা পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব?

দেশ বলতে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে কী ছিল, কতটুকু ছিল, কতটুকু চাক্ষুষ করেছি যে দেশপ্রেম হবে? চমৎকার রঙিন ভারতবর্ষ ম্যাপবইয়ের পাতায়, জাতীয় পতাকায় আর স্বাধীনতা দিবসের হৈচৈয়ের ভেতর, ভারতমাতারূপী কিশোরীর নৃত্যপর দেহবিভঙ্গে বারবার জেগে উঠে মিলিয়ে গেল। ‘তব শুভনামে’ সে জাগল কি, জনগণমন? যতটুকু শিরশির করল গা, সে খালি ওই গান শুনে।

“সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হমারা… ” ইকবাল সাহেব যখন লিখছিলেন, তখনও ওই নিরীহ হিন্দুস্তাঁ শব্দটির গায়ে ‘হিন্দু’ত্বের ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। ওঠেনি, কিন্তু ঘুমিয়ে থাকাটাও থাকা। অন্তত না-থাকা নয়।

একটা উপমহাদেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, তাকে বাঁটোয়ারা করছে এক দেশ এক আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা যবন আর কাফের মিলে, বিষ তো পোঁতা হল এইখানেই!

পাকিস্তান মুসলমানের ছিল, হিন্দুস্তানও হিন্দুর। নামের ভেতর লুকনো এ একটা অহঙ্কার। ‘আমাদের দেশে তোমাদের রেখে দয়া করছি’ মনোভাবের মূল। এই দয়া বড় চঞ্চল, ‘খেদিয়ে দূর করে দেব’ মনোভাবের আশপাশে এর ঘনঘন যাতায়াত। না, সংবিধানে অবশ্য ফলাও করে ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ লেখা আছে। ধোঁকার টাঁটি। মেরা ভারত মহান।

মিলেজুলেই তাও ছিলাম আমরা। ছোট ছোট ব্যক্তিস্বার্থ, মিটে গেলে বিরোধ কিসের? আমরা রাজনীতির কুমির নই তো যে বড় বড় খিদে পাবে! আমরা নিশ্চিন্তে ছিলাম যে ওরা, ওই বড় কুমিরগুলো আমাদের মতো চুনোদের খায় না। কাজ গোছানোর মতো ঢের কাজ আছে ওদের। অন্তত আগের কুমিরগুলো খায়নি বলে আমরা বংশে বেড়েছি। বেঁচেবর্তে আছি। দেশ বলতে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিটুকু বুঝে বুড়ো হয়ে গেলাম। ব্যস, ম্যাপের বাকিটা ঝাপসা।

তো খেয়েপরে একগাদা বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দিয়ে যে অনাছিষ্টিরকম রাষ্ট্রসম্পদ ধ্বংসের ঘটা আমরা ইতোমধ্যে সেরে ফেলেছি, তাতে ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’ আতান্তরে। তার ওপর মুসলমানের বাড়বৃদ্ধি তো আছেই, তাদের সুবাদে ভিনদেশি মুসলমানের উৎপাতও চরম বেড়েছে। উঁহু, নাশকতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং এইসব বাহানায় বৈধ কাগজ দেখাও। নিশ্চিত করো তুমি একাত্তরের পর থেকে এদেশেরই। কিন্তু বাপু হে, হে রাম, সেই বৈধ কাগজ কোনটা? সাতাত্তর সালের আগে জন্মেছেন এমন কে আছেন ভাই যার বার্থ সার্টিফিকেট রয়েছে? যাঁর মাথা থেকে এই বৈধ কাগজের কনসেপ্ট বেরিয়েছিল, তাঁর কাগজ আছে? মোদিজি শাহজি জোড়া মানিকের? অনুপ্রবেশ আটকে দিতে জোড়া মানিক যা করছেন তা আক্ষরিকভাবে মশা মারতে কামান দাগা। জাতিবিদ্বেষের গোলাভরা কামান নিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত একদলতন্ত্র ময়দানে নেমেছে। এ কিন্তু কোনও হঠকারিতার প্রমাণ নয়। ক্ষমতার স্থায়িত্ববাসনা এমনই দুর্বারভাবে হীন হতে পারে, হীন হল।

শান্তভাবে, একটুও আলোড়ন না তুলে, চোরা স্রোতে ডুবে কাছে এসে যে হিংস্র প্রাণীটি সহসা ঘাতকরূপ দেখাচ্ছে, দেশ বলতে চিরকাল যা বুঝেছি সেই নিশ্চয়তার মাটি থেকে যে ছিনিয়ে গ্রাস করবে, তাকে কীভাবে নিকেশ করা যায়? অরক্ষিত অগোছালো প্রতিরোধ? কতখানি কার্যকর? ভাববারও সময় নেই এখন, শুধু কাতার দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। দেশ বলতে যা বুঝি, যতটুকু বুঝি, আপাতত ওইটুকু সম্বল নিয়ে, ঝপাঝপ ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এর নাম লড়াই। অস্তিত্বের। যেমন দর্শন রাজনীতি সমাজতত্ত্ব কিচ্ছু ভাববার বোঝবার অবকাশ না পেয়ে প্রথম চাবুকের মতন সটান ঘুরে দাঁড়িয়েছে ছাত্রছাত্রীর দল, দিল্লি আলিগড় ঝাড়খণ্ড মুম্বাই পঞ্জাব চেন্নাই কলকাতা জুড়ে… সব মুখ মিলেমিশে একাকার… ওরাই তো আমাদের উত্তরকাল! দিন তো ওদেরই আসছে! আমরা যতদিন আছি, যতদিন ফুরোইনি, ওদের পাশে পাশে থাকি একটু, ছুঁয়ে থাকি? ওদেরই সমাজসংসার, একটু গুছিয়ে দিয়ে যাই? এই করতে গিয়ে যদি এই বয়সে এসেও আমাদের চোখের পর্দা সরে, প্রাদেশিকতার ব্যবধান ঘোচে, হয়তো বাকিজীবন অভূতপূর্ব একটা তরঙ্গ ছুঁতে পাব।

শাসক বলবে আস্পর্ধা। আমরা বলব লড়াই। দেশের জন্যে লড়াই। আমার দেশ। একখানা গোটা ভারতবর্ষ।