সর্বজিৎ সরকার
লেখক কবি, গদ্যকার, আর্টিস্ট, অনুবাদক।
কিছু বলার আছে আপনার? হ্যাঁ, বলার আছে। বলার এটাই যে তারা গুঁড়ি মেরে আসে। আসে অন্ধকারে। অন্ধকারের আড়াল ছাড়া তারা আসতে পারে না। তাদের মুখ ঢাকা থাকে কাপড়ে, মাফলারে, টুপিতে কিংবা চাদরে। তাদের হাতে বেশিরভাগ ধাগা নয়তো লোহার বালা থাকে। এই অন্ধকার, আর মুখ মাথা এসব ঢেকে রাখা খুব দরকার তাদের। তাদের চোখ খোলা থাকে। খোলা রাখতেই হয়, কেননা সে চোখ আসলে শ্বাপদের। পোষা জানোয়ারের। যাদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্ধকারে, দলবেঁধে, একসঙ্গে জড়ো হয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে মেরে আসার জন্যে। প্রয়োজন হলে আর সুযোগ পেলে জানে মেরে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া আছে তাদের। অস্ত্র আছে তাদের কাছে? হ্যাঁ, আছে তো! তাদের কারও হাতে আছে লাঠি, কারও হাতে লোহার রড, কারও হাতে হাতুড়ি, হকিস্টিক, বা উইকেট। দু একটা পিস্তল থাকলে থাকতেই পারে। বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। আলো জ্বলে থাকা রাস্তায় তারা যখন জড়ো হয়, তার আগেই রাস্তার লাইটগুলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। এসব প্রোটেকশনের ব্যবস্থা রাষ্ট্র আগে থেকেই করে রেখেছে তাদের জন্য। রাষ্ট্রের পুলিশ আছে কি করতে যদি এইসব চোরা হামলাকারীদের প্রোটেকশন নাই দিতে পারবে? আলো তাই নেভানো হয়ে গেছে। আড়াল দেওয়ার কাজটাও পুলিশই করে দিয়েছে তাদের। যাতে তারা নির্বিঘ্নে, ক্যাম্পাসের ভেতরে শিক্ষক আর ছাত্রদের অজ্ঞাতেই, আচমকা আক্রমণ করতে পারে। পুলিশ আর কী করবে? তারাও তো হুকুমবরদার। উপরওয়ালার। উপরওয়ালা কে? কে আবার, রাষ্ট্র! রাষ্ট্র কে? উফফ! এত প্রশ্ন করবে না না তো! পরে বলছি রাষ্ট্র কে? রাষ্ট্র কী? সব পরে বোঝাব। এখন দেখুন জন্তুগুলো কী করে! আপাতত এইটুকু জানুন যে উপরওয়ালার নির্দেশ আছে এই শিকারি কুকুকরদের যেন প্রোটেক্ট করা হয়। এরা সব সংরক্ষিত প্রাণী যে! দেশভকত! রাষ্ট্রশক্তি এদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে অন্ধকারের আড়ালে চুপিসাড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্র শিক্ষক নির্বিশেষে মারধোর করে আসার। দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেওয়ার পারমিশনও দেওয়া আছে। ছাত্রেরা অবাধ্য? বেশি প্রশ্ন করছে? আন্দোলন করছে রাস্তায় নেমে? জেহাদ তুলছে অলিতে গলিতে বড় রাস্তায়? মারো শালাদের! মেরে খাল খিঁচে দাও! দেখি কোন শুয়োরের বাচ্চার হিম্মত থাকে রাষ্টের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার!
ফিকশন মনে হচ্ছে তো? না। এটা ফিকশন নয়। বাস্তব। নির্মম বাস্তব। ঘটনা। ঘটনাকাল– ৫ই জানুয়ারি, সন্ধেবেলা। ঘটনাস্থল–জওহরলাল নেহরু ইউনিভারিসিটি ক্যাম্পাস।
সামান্য অদলবদল করে নিলে একই ঘটনা এর আগেও, জামিয়া মিলিয়ায়, যাদবপুর ইউনিভারিসিটি, এবং আরও অনেক বিদ্যায়তনেই ঘটে যেতে দেখেছি আমরা। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের মনে প্রশ্ন আসে যে এই ঘটনাক্রমের পেছনে কী আরও বড় কোনও অভিসন্ধি, কোনও নকশা, কোনও ছক আছে? যত দিন যাচ্ছে, প্রশ্নটা একটা স্পষ্ট উত্তরের দিকে পৌঁছতে পারছে, যে, হ্যাঁ, আছে। এই সব কিছুর পেছনেই একটা বড় স্ট্র্যাটেজিক পরিকল্পনা কাজ করছে।
ঐশী ঘোষ শুধু নয়, আরও অনেক ছাত্র ও শিক্ষককেই ওইদিন পূর্বপরিকল্পিতভাবে, ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেই টার্গেট করে রাখা ছিল। রাখার কারণ হিসেবে যদিও আপাত অজুহাত একটা ছিল। ছাত্রদের সেশন ফি বাড়ানোর প্রতিবাদকে রুখে দেওয়া। কিন্তু সেটা সত্যি অজুহাত মাত্র। আসল কারণ, রাষ্ট্রের উপরওয়ালাদের বদ্ধমূল ধারণা যে বামপন্থী ছাত্র শিক্ষকদের আখড়াগুলোই আসলে সিএএ ও এনআরসি বিরোধিতার বীজ ধারণ করছে। সুতরাং ভাঙো তাদের। নির্মূল করে দাও। দিনের আলোয় তর্ক, বিতর্কের মধ্যে দিয়ে, আলোচনার মধ্যে দিয়ে সেটা যে সম্ভব হবে না, হচ্ছে না, সেটা এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের মাথাদের খুব ভালো করেই জানা আছে। এটা তারা ভালোই বোঝে যে নাগরিকপঞ্জি বানানোর নামে ভারতবর্ষের আপামর জনগণকে একটা ইউনিফর্ম চেহারা দেওয়া, যেখানে হিন্দুত্ববাদী ও মনুবাদী সংস্কৃতিকেই প্রধান বলে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, এবং বাকি সমস্ত ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষকে, একঘরে শুধু নয়, ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পরিসরে তাদের প্রায় পরবাসী, উদ্বাস্তু, আর বেঘর করে দেওয়ার জন্যে, দিনের আলোয়, সভাসমিতি আর ভার্চুয়াল স্পেসে মিত্রোঁ, মিত্রোঁ বলে জ্ঞান বিতরণ করাটাই যথেষ্ট নয়। সকালে ওসব বললেও, রাতের অন্ধকারে, মুখ ঢেকে, রাষ্ট্রক্ষমতার সবরকম শক্তি প্রয়োগ করেই একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্রের ভাবনা কে, দর্শন কে, কায়েম করা যাবে।
ফ্যাসিস্টরা এভাবেই কাজ করে সেটা ইতিহাস আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আরও একটু, ধরুন, প্রায় পাঁচশো বছর আগেও যদি ফিরে যাই, দেখব, একটি দেশের নাগরিক বিন্যাসকে, তাদের অন্তর্গত ফেব্রিক বা বুনোটকে কোনও রাষ্ট্রশক্তি যখনই এক পোশাক পরাতে চায় তখনই তারা এই স্ট্র্যাটেজিটাই বেছে নিয়েছে। যে স্ট্র্যাটেজি দাঁড়িয়ে থাকে হিংসা, দ্বেষ, সন্ত্রাস আর বিচ্ছিন্নতার উৎসমুখ খুলে দিয়ে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যখন ‘বদলা নেওয়া’র কথা বলে, তখন সেটা আর কোনও বিযুক্ত মন্তব্য থাকে না। রাষ্টীয় ন্যারেটিভের গ্র্যান্ড প্ল্যানের সঙ্গে সেটা খাপে খাপ মিলে যায়। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে পাঁচশো বছর আগে ম্যাকিয়াভেল্লি যখন লেখেন, “কিন্তু সত্যি হল এটাই যে, যে শহরে মানুষেরা স্বভাবগতভাবেই স্বাধীনতায় অভ্যস্ত, তাদেরকে বাধ্য করতে হলে, নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। কেননা, ধংসের মধ্যে দিয়ে দখল না করলে নাগরিকেরা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর নিজেদের মুক্তির স্বপক্ষে আবার বিদ্রোহ করবেই” (ম্যাকিয়াভেল্লি/ প্রিন্স)। এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্ঘীদের এবং ভাজপার ভাবাদর্শের কি বিপজ্জনক মিল। আর যতই সভ্যতার অগ্রগতির কথা বলা হোক না কেন, দমন ও দখলের ইতিহাস বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। তবু, তার প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের ভাষাও একই সঙ্গে জন্ম নেয়, এটাই সত্য।
একচ্ছত্র আধিপত্য আর নিয়ন্ত্রণের মতাদর্শ অনুসারী যে রাষ্ট্রক্ষমতা এখন শুধু ব্যালটের ভরসায় নয়, আইনের ভরসাতেও নয়, যুক্তি ইত্যাদির কথা তো অনেক দূরের ব্যাপার, ভায়োলেন্স আর বিভেদের শক্তি ব্যবহার করবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেখানে এই মুহূর্তে যাদের প্রতিরোধ আর রুখে দাঁড়ানোর ওপর আস্থা রাখতে পারি, তারাই আজ রুখে দাঁড়াচ্ছে সবথেকে বেশি। এই ছাত্রছাত্রীরা আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই ভবিষ্যত প্রজন্ম। তারা যে বিভেদকামী দানবদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস রাখে, রাখছে, সারা দেশ জুড়েই প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের রাস্তায় নামছে, এটাই আমাদের কাছে, ভারতবর্ষের বহুধর্ম, বহুবর্ণ, বহুসংস্কৃতির, বহুধায় উৎসারিত মানুষজনের কাছে সবথেকে বড় আশার কথা।
শিরোনাম কৃতজ্ঞতা – পাবলো নেরুদা