Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চেতনার ভিত নাড়িয়ে শপথের গান শেখাল জেএনইউ

গৌতম সরকার

 




লেখক প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

 

 

খাদের কিনারা শব্দটি কত চেনা। কতবার ব্যবহারও করেছি। কিন্তু এভাবে তার মর্মার্থ বোধহয় কখনও বুঝিনি। গত কয়েক বছর ধরে প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) আমাদের খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিল। আমাদের মানে শুধু বহুবচন নয়, এই আমাদের ব্যাপ্তি গোটা দেশ। ভারত খাদের কিনারায়। দীপিকা পাড়ুকোন ঠিকই বলেছেন, এটা আমাদের দেশের ভিত্তি নয়। জেএনইউয়ে হামলা সেই ভিত্তিটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। চেতনার ভিত। জওহরলাল নেহরুর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তের স্রোত বইল। আক্রান্ত হল ছাত্র-যৌবন। তাদের সঙ্গে আমার বা আমাদের মতের অমিল থাকতে পারে। সেজন্য তাদের রক্তাক্ত করার নাম তো মতাদর্শের রাজনীতি নয়।

জওহরলাল সেই রাজনীতির পাঠ দেননি। তিনিই তো আবিষ্কার করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়িকে। বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, এ ছেলের দেশের শীর্ষে বসবে। এই প্রশংসায় রাজনৈতিক মতভেদ অন্তরায় হয়নি। নেহরুর বিরুদ্ধে সমালোচনা কম নেই। দেশভাগের জন্য তিনি দায়ী। পাকিস্তানকে মারতে মারতে সেনাবাহিনি যখন কোনঠাসা করে ফেলেছিল, নেহরু তখন থামার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চিনকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন ইত্যাদি হাজার নিন্দামন্দ। কমিউনিস্টরাও কিছু কম করেনি। কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে গণতন্ত্রের নীরব পূজারি ছিলেন তিনি। মনে প্রাণে তাঁর মতো ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব দেশের রাজনীতিতে তো বটেই, গান্ধি-নেহরু পরিবারে দ্বিতীয়টি নেই। অনেক ক্ষেত্রে তিনি আপস করেছেন বটে। কিন্তু গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ, ও ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী ভারতের মর্মবাণী ছিল তাঁর হৃদয়ে গাঁথা। 

সেই জওহরলালের নামাঙ্কিত দেশের নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাল হল ঘৃণার রক্তে। বিদ্বেষের শোণিত ভাসিয়ে দিল জেএনইউয়ের চত্বর। সংখ্যার জোরে জেএনইউ দখল সম্ভব ছিল না বলে নিষ্ফল আক্রোশে অনৈতিকতার কাণ্ডারিরা ভয় দেখাতে পেশি শক্তির আস্ফালন করেছে। সঙ্গী ছিল পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও জেএনইউ কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। জেএনইউ এখন আর কোনও দলীয় রাজনীতির প্রতীক নয়। জেএনইউ এক স্ফুলিঙ্গের নাম। জেএনইউ চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে, মনের কথাগুলো যুক্তি সাজিয়ে বলব। যুক্তিকে ভয় পায় প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিস্টরা। এদের শক্তি বলা ভুল। এরা আসলে ভীত। প্রাণভয়ে এরা হামলা করে। কিন্তু জেএনইউয়ে ওদের হামলায় গোটা দেশ ফ্যাসিবাদের চেহারা চিনে নিয়েছে। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে বুঝে নিতে পারছে, কোন পক্ষে থাকা দরকার।

এই পক্ষের মধ্যে কোনও দল নেই, দলীয় রাজনীতি নেই। বিদ্বেষের, ধর্মীয় রাজনীতির বর্বরতার বিরুদ্ধে এই পক্ষে আছেন তাঁরাই, যাঁরা দীপিকা পাড়ুকোনের মতো সোচ্চারে উচ্চারণ করতে পারেন, এটা আমার দেশের ভিত্তি নয়। অর্থাৎ প্রতিবাদের আগুনের সামনে দেশবাসীকে এনে ফেলেছে জেএনইউ। হয় এই বর্বরতা রোখো, নাহয় ফ্যাসিবাদের শিকার হও কিংবা ওদের অনুগামী হও। মাঝামাঝি নিরাপদ অবস্থানের দিন শেষ। পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এপথ চেনা, জনস্রোতে, নানান মতে ……। বিরুদ্ধে বললে লাগাতার প্রচার হবে। এরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলে না কেন? এদের সুর পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে যায় কেন? এই প্রচারে দেশবাসী যাতে আর বিভ্রান্ত না হন, সেই বার্তাও দিয়েছে জেএনইউ। 

নরেন্দ্র মোদি হোন আর ডোনাল্ড ট্রাম্প, নেট যুগে ফ্যাসিবাদের নয়া কাণ্ডারিরা মানুষের নজর ঘোরাতে যুদ্ধের জিগির তোলে। ইমপিচমিন্টের মুখে দাঁড়িয়ে ধনকুবের ট্রাম্পকে ইরানের সেনাকর্তাকে কোতল করে যুদ্ধের দামামা বাজাতে হয়। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের জেরে দেশ জুড়ে আমআদমির জ্বালানো আগুনের উত্তাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে মোদিকেও পুলওয়ামা, বালাকোটের পর আবার পাকিস্তানের নাম জপতে হয়। জাতীয়তাবাদের ফানুসে পুড়িয়ে দেওয়া যায় দেশভক্তি, ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি। জেএনইউ শেখাল, আর পুড়ে যাওয়া নয়। বরং বিদ্বেষ বিষকে পুড়িয়ে মারো। গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাহি কিছু মহীয়ান। জেএনইউয়ের গলায় উঠে আসে হৃদয় নিংড়ে চেতনায় আঘাত হানা সেই উচ্চারণ, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। জেএনইউ তাই এক শপথেরও নাম। বিভাজনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ শপথ।