সুপ্রিয় সেন
লেখক তথ্যচিত্রনির্মাতা ও সমাজকর্মী।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তাক্ত সন্ধে, দুটো খুব স্ট্রং ইমেজের জন্ম দিয়েছিল। প্রথম ইমেজে দেখি আক্রমণকারীদের মধ্যে একটি মেয়ে হাতে ভোঁতা অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে একদল পুরুষকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সন্ত্রাসে। তার মুখ ঢাকা কাপড়ে তাই সন্দেহ করা সত্ত্বেও কেউ বলতে পারছে না এই কোমল শর্মা কিনা। এর কয়েক ঘণ্টা বাদেই আরেকটি ইমেজের জন্ম হয়। এক ছাত্রী, কপালে গভীর ক্ষত, সারা মুখে রক্ত, সাংবাদিকদের বর্ণনা দিচ্ছে দুষ্কৃতি অনুপ্রবেশের। ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই তাকে আবার দেখি ভাঙা হাত, ফাটা মাথা নিয়ে, হসপিটাল থেকে বন্ড দিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে। এই মেয়েটি ঐশী ঘোষ। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। সে বলছে আক্রমণ করে তাকে এবং তাদের ভয় দেখানো যাবে না। লড়াইয়ের ময়দান তারা ছাড়ছে না।
গত একমাস ধরে ভারতবর্ষের মানচিত্রের প্রায় পুরোটা জুড়ে যে বিপুল গণবিক্ষোভ একটার পর একটা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে আমাদের দৃশ্যতটে, তার প্রায় সবটা জুড়ে মুক্তোর মতো ছড়িয়ে আছে নতুন ভারতের কন্যাসন্তানরা যাদের বাঁচানোর আর পড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। বাঁচাতে তো তিনি পারেনইনি, বরং নিজের মতো ইতিহাস পড়ানোর আগেই এরা পড়ে ফেলেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নপাঠ, যাতে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমানাধিকারের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাই জামিয়ার দুই ছাত্রী পুলিশবাহিনির হাত থেকে তাদের ভাই বা বন্ধুকে বাঁচানোর সাহসী লড়াইয়ে যখন উদ্ধত আঙুল তুলে পুলিশবাহিনিকে রুখে দেয় তখন এই নতুন প্রজন্মের মেয়েরা এই বার্তাই রাষ্ট্রকে দেয় যে তারা নিজেরাই নিজেদের বাঁচাবে এই ঘোর অন্ধকারে। ওই তর্জনীই যেন দিকনির্দেশ করল কোন পথে, কীভাবে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে হবে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্র নির্মাণের চক্রান্তের বিরুদ্ধে।
নিউজ চ্যানেলের যুদ্ধ-উন্মাদনা, কুযুক্তি, চাটুকারিতা এড়িয়ে এরপর অভূতপূর্ব সব দৃশ্যাবলি ভেসে আসতে থাকল সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। ব্যাঙ্গালোরের ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে একা পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে তরুণী ভাব্যা খাকি পোশাককে পড়াল সংবিধানের সহজ পাঠ। দিল্লির রাস্তায় ল-এর ছাত্রী স্বাতী নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিসরে ঢুকে পোশাক, খাদ্যাভাস, পছন্দের অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করার অনধিকার চর্চাকে হাসিমুখে প্রত্যাখ্যান করল। এর পর থেকে সারা ভারত জুড়ে যেটা ঘটল সেটাকে রেকর্ড শীতে অকাল বসন্ত বলা যায়!
এখন দেশ জুড়ে প্রতিটি মিছিলে মেয়েরা সবার আগে। তারা স্লোগান দিচ্ছে, ব্যারিকেড ভাঙছে, লাঠি-গুলি-জলকামানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তাদের প্রতিবাদে আওয়াজ আছে, গর্জন নেই… প্রতিরোধ আছে, প্রতি আক্রমণ নেই… আরও মার খাওয়া আছে… পাল্টা মারার স্লোগান নেই, তাদের কথায় যুক্তি আছে, ভক্তি নেই। দুলে দুলে, নেচে নেচে আর গেয়ে গেয়ে, দিচ্ছে “আজাদি”র স্লোগান। এদের মধ্যে কারুর কারুর শরীর আপাদমস্তক বোরখা দিয়ে ঢাকা, কিন্তু পর্দার আড়ালে যে চোখ বেরিয়ে আছে তা মুহূর্তে জ্বালিয়ে দিতে পারে যুগযুগান্তের পিতৃতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র।
মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এদের ইমেজ, এদের শব্দকে এড়িয়ে গেলেও সোশাল মিডিয়াতে এরা ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মতো। আর তাদের মেয়েদের নামতে দেখে মায়েরাও নেমে পড়েছে ময়দানে, রাস্তার ধারে। রাত জাগছে কোলের শিশুকে নিয়ে শাহিনবাগে, পার্ক সার্কাসে।
পরাধীন বা স্বাধীন ভারতবর্ষে এভাবে প্রতিবাদের প্রতিটি ইমেজের কেন্দ্রবিন্দুতে মেয়েদের এমন উপস্থিতি কোনওদিন কেউ দেখেছে কিনা জানা নেই। সম্ভবত দেখেনি। এটা এমন এক নবতরঙ্গ যাতে তিন প্রজন্মের মেয়েরা, পুরুষদের পিছনে সরিয়ে সামনের সারিতে এসে জায়গা দখল করে নিয়েছে। কোথাও দলবদ্ধভাবে, কোথাও একা। এরা এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দিতে কেউ রাজি নয়। শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নয়, পরিবারের বিরুদ্ধেও এরা লড়ছে। মেয়েদের কী করা উচিত আর কী নয় বলে যাদের শেখানো হয়েছে এতকাল তারা সব বাধা সরিয়ে রাস্তায় নামার অধিকার অর্জন করছে। এটা প্রকৃত অর্থেই পূর্ণ নাগরিকতা অর্জনের লড়াই।
যারা জিন্স আর বোরখা দেখে মেয়েদের জাত আর চরিত্র বিচার করত তাদের গুলিয়ে দিয়েছে এরা। রাস্তায় নেচে গেয়ে মনুবাদী রাষ্ট্রকে বলছে “তুমি ধর্ষক”…। এরা তো শুধু রাষ্ট্রের কাগজ দেখতে চাইছে না, তার কাপড় কোথায় তাও জিজ্ঞেস করছে।
এ এক সন্ধিক্ষণ… জাতীয় পতাকা আর বীরদের ছিনিয়ে নিয়েছে ওরা ধান্দাবাজ, বিভেদকামীদের হাত থেকে। অর্ধেক আকাশের এটা পুরো ব্রহ্মাণ্ড দখল নেওয়ার সময়। এটা পুরুষের পিছনের সারিতে দাঁড়ানোর সময়। দাঁড়িয়ে সেলাম ঠোকা অথবা অনুসরণ করার সময়। এর থেকে বেশি কিছু বলার ভাষা নেই… কারণ পথিক কবি আমির আজিজ, যে নিজেও জামিয়ার ছাত্র, সে সবচেয়ে প্রাঞ্জলভাবে বলে দিয়েছে…
হিন্দু রাষ্ট্রকে বেকুব বানিয়েছে, গোলাপকে ইন্কেলাব বানিয়েছে, আমাদের লাল সেলাম জানিয়েছে জামিয়ার মেয়েরা… পিতৃতন্ত্রের চাড্ডি ফেটে গেছে, ভুলাভাল লোক ফুটে গেছে, যখন রাজপথ দিয়ে হেঁটে গেছে আজ জামিয়ার মেয়েরা… ওরা যখন হেঁটে গেল ওদের মধ্যে কোনও হিন্দু, কোনও মুসলিম, কোনও খ্রিস্টান, কোনও শিখ, কোনও নাস্তিক ছিল না… ছিল শুধু জামিয়ার মেয়েরা। এরা কারও বোন, কারও মা, কারও মেয়ে নয়, এরা জামিয়ার মেয়েরা।
কোমল শর্মার মুখোশটা পিতৃতন্ত্রের উপহা্র। কিন্তু যেভাবে নতুন ভারতের মেয়েরা সব উর্দিকে বেপর্দা করে দিচ্ছে তাতে ওই মুখোশ আর বেশি দিন অটুট থাকবে না। আর সব আড়াল ভেঙে গেলে ওই দুর্ভাগা মেয়েটা হয়তো ওই পথে হাঁটবে আবার যে পথের দিকে তর্জনি দেখিয়েছে জামিয়ার মেয়েরা…
জামিয়ার মেয়েরা এখন ভারতবর্ষের দায়িত্বে। তাই আমার আর “বন্দে মাতরম” বলতে সংশয় হচ্ছে না! খালি দু চোখ ভরে মিছিলের সেই পতাকাটার দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে যেখানে নতুন ভারতে নতুন করে জেগে উঠছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্বাধীনতার স্বপ্ন।