Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কি এখন শেষবেলায়?

সন্দীপ পাণ্ড্যে

 



লেখক ২০০২ সালে র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী।

 

 

 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি হয়েছিল এই ভেবে যে ছাত্ররা এখান থেকে শিক্ষা আহরণ করবে। কর্তৃপক্ষ এই জায়গাগুলিতে শিক্ষাপ্রদানের অনুকূল এক উদার পরিবেশ সৃষ্টি করবেন, এমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অংশে এমন পরিবেশই ছিল আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। অবশ্য তা মোদি সরকার ক্ষমতায় আসবার আগে অবধি। স্বাধীন এবং বৈচিত্রময় শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখবার ক্ষেত্রটিতে পশ্চিমের অগ্রগণ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করা হত জেএনইউ-কে। ক্যাম্পাসে হাতাহাতি চলত, কিন্তু তা মূলত ছাত্রদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর আদর্শগত মতাভেদ, কিছু বিশেষ সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া অথবা ভারতবর্ষের চিরাচরিত জাতিভেদের মধ্যেই সীমিত থাকত। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে আটের দশকে এবং আগে যে হিংস্র ঘটনাগুলি ধারাবাহিকভাবে ঘটবার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যতক্ষণ না সেখানকার কর্তৃপক্ষ আটের দশকের মাঝামাঝি ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন সাময়িককালের জন্য না আয়োজন করবার সিদ্ধান্ত নেন। লিংডো কমিশনের পরামর্শ মেনে ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে কোনও সমস্যাই নেই, তবে সব উপাচার্যের যে ছাত্র রাজনীতি সামলানোর মতো আত্মবিশ্বাস আছে, তেমনটা বলা যায় না।

ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে আজ অবধি অরাজকতা এবং হিংসার ঘটনা কম নেই। তবে গত ৫ই জানুয়ারি ২০২০ সরকারি মদতে জেএনইউ-তে যে গুণ্ডামি ঘটেছে, তাতে অধঃপতনের নতুন এক মান পাওয়া গেল। ২০১৪ সাল থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষাগত পরম্পরাকে নষ্ট করবার জন্য যা করেছে, তা যেন যথেষ্ট ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অথবা বৃহত্তর সমাজকে যদি বিজেপি এইভাবে নিয়ন্ত্রণ করবার পথ নেয়, তাহলে উদার চিন্তা-ভাবনা এবং ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাকে আমরা বিদায় জানাতে পারি। শক্তি প্রদর্শনই যদি উপাচার্য এম জগদীশ কুমারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তিনি পুলিশ ডেকে নিয়ন্ত্রণ না করে এমন একদল মুখোশধারীকে কেন ডেকে আনলেন যারা সম্ভবত অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্য, তা বোঝা গেল না। এটা কী ধরনের মানসিকতার পরিচয়? লুম্পেনদের দিয়ে তিনি ছাত্রদের প্রতিরোধ করলেন। তিনি কি নিজেকে একজন মাফিয়া ভেবে ছাত্রদের বিরুদ্ধে গ্যাং ওয়ার লড়ছেন?

এটাও অদ্ভুত যে ঘটনার কয়েকদিন আগে যখন পুলিশ জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ঢোকে, তখন সেখানকার উপাচার্যদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। অথচ জেএনইউ-তে ক্যাম্পাসে ঢোকবার জন্য তাঁরা উপাচার্যের অনুমতির অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষার দীর্ঘ সময়ের মধ্য দুষ্কৃতকারীরা নির্বিবাদে ক্যাম্পাস তছনছ করে যাচ্ছিল। এ থেকে বোঝা যায়, উপাচার্যের সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের যোগসাজশ ছিল, যাদের একজনও এখনও অবধি ধরা পড়েনি। কয়েক বছর আগে বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটি-র ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন গেটে জমায়েত ছাত্রীদের প্রতিবাদ মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ডেকে লাঠিচার্জ করাবার অপরাধে যদি সেখানকার উপাচার্য গিরীশ চন্দ্র ত্রিপাঠিকে বরাবরের জন্য ছুটি দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে জগদীশ কুমারকে উপাচার্য পদে বসিয়ে রাখবার কোনও কারণ নেই। তাঁর অপরাধের মাত্রা আরও অনেকটা বড় এবং অক্ষমনীয়।

জেএনইউ-তে যে ধরণের হিংস্র ঘটনা ঘটেছে, তার যোগসূত্র আমরা সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে এনআরসি এবং সিএএ-র প্রতিবাদে জমায়েত মানুষদের উপর ঘটা হিংস্র আচরণে পাই। মুখোসধারী দুষ্কৃতকারী, বাইরে থেকে লাখনাউতে আনা অপরিচিত যুবক এবং বিজেপি/আরএসএস-এর কর্মীরা মুজফফরনগরে স্থানীয় সান্সদ সঞ্জীব বালিয়ান-এর পরিচালনায় যে লুঠতরাজ, গুণ্ডামি ইত্যাদি চালায়, তার দায়ভার প্রতিবাদকারীদের উপর দেওয়া হয় এবং এফআইআর-এতে নিরপরাধ মানুষদের নাম নথিবদ্ধ করা হয়। ইউপি-র মুখ্যমন্ত্রীও ঘোষণা করেন যে ভাঙচুর হওয়া সরকারি সম্পত্তির জন্য ক্ষতিপূরণ তাঁদেরই দিতে হবে, যারা সেগুলি নষ্ট করেছেন। ইউপি-তে ধরে নেওয়া হচ্ছিল এফআইআর-এতে যাদের বিরুদ্ধে নামগুলি লেখা হয়েছে, তাঁরাই ভাঙচুর করেছে। জেএনইউ-তে কারা ভাঙচুর করেছে, তা তো সবার জানা। একই যুক্তিতে কি এবিভিপি অথবা উপাচার্যের থেকেই ক্ষতিপূরণ চাওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয় যারা নিঃসন্দেহে ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? এরকম একটা সিদ্ধান্ত এখন নেওয়া হলে পরবর্তীকালে অন্য কোনও দল কোথাও গুণ্ডামি চালানোর আগে অন্তত দুবার চিন্তা করবে।

ইউপি-তে ঠিক যেভাবে গুণ্ডামি এবং পুলিশি বর্বরতার যারা শিকার, তাঁদেরকেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই জেএনইউ-র স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষ এবং হিংসায় আক্রান্ত তাঁর সহপাঠীদের বিরুদ্ধে এফআইআর লেখানো হয়েছে। যদিও সব সরকারই এমনটা করতে অভ্যস্থ, তবুও বিজেপি-র ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে— ঘটনায় আক্রান্ত যারা, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লেখা। ঐশী ঘোষ, যিনি এই হিংসার বিশেষ একটি লক্ষ্য ছিলেন এবং যার মাথা গুরুতর জখম হয়েছে আক্রমণে, তিনি তাঁর বিবৃতিতে সমগ্র বিতর্কটি সম্পর্কে সবচেয়ে পরিণত কথাটি বলেছেন। তিনি বলেছেন প্রত্যেকটি লাঠি আর রডের আঘাতকে বিতর্কের মাধ্যমে প্রতিহত করা হবে। ওনার থেকে উপাচার্য এবং বিজেপি নেতৃবৃন্দের শেখা উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কেমন হওয়া উচিৎ। ওনার মধ্যে জগদীশ কুমারের চেয়েও যোগ্য একজন উপাচার্য হওয়ার উপাদান আছে। কিন্তু আরএসএস-এর সমস্যা হল আদর্শ নিয়ে বড় বড় বুকনি ঝাড়লেও তাঁদের ঝুলিতে কর্মযোগ্য মানুষ বলে কেউ নেই।