অনির্বাণ ভট্টাচার্য
লেখক কবি, গদ্যকার।
দৃশ্য এক: লখনৌ। মঞ্জরী চতুর্বেদী। সুফি-কথক নৃত্য ঘরানায় কাজ করে আসা মঞ্জরী। অবশ্য এক্ষেত্রে বিষয় অন্য। কাওয়ালি। সমস্যা সেখানেই। উত্তরপ্রদেশ সরকারের কমনওয়েলথ মেমোরিয়াল উৎসবের একটি অনুষ্ঠানে মঞ্জরীকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। বেশ কয়েকটি গানের পর, অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মাঝেই, মঞ্জরী যখন কাওয়ালি গাইতে উঠলেন, অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হল। টেকনিকাল এরর? মঞ্জরী তেমনটাই ভেবেছিলেন। বাদ সাধল সঙ্গে সঙ্গেই পরের অনুষ্ঠানের শুরুর তোড়জোড়। নাহ। প্রযুক্তিগত সমস্যা না। ইচ্ছাকৃত, ডেলিবারেট বাধা। কেন? শিল্পীর প্রশ্নের উত্তরে সাপের জিভের মতো উত্তর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মীর – ‘ইহাঁ কাওয়ালি নেহি চলেগা’।
দৃশ্য দুই: মির্জাপুর। টাঙ্গাইল। বাংলাদেশ। বয়াতি বা বাউল গান। বরাবরই ইসলামি মৌলবাদের চক্ষুশূল। সুফি বা বাউল ইসলাম-বিরোধী, এমন একটা ফতোয়ায় স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মৌলবাদীদের কমন ওয়ার-ক্রাই। যার নবতম শিকার বয়াতি গায়ক শরিয়ত সরকার। মির্জাপুরের শরিয়ত ঢাকার ধামরাই এলাকার একটি অনুষ্ঠানে সোচ্চারে ঘোষণা করেন– সুফি গান হারাম এমন উল্লেখ ইসলামে নেই। এই সঙ্গীতবিরোধিতা পরবর্তী টুপিধারী মৌলবাদীদের মস্তিষ্ক-প্রসূত। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন ইসলামে এমন উল্লেখ আছে, তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দেবেন এবং গান গাওয়া ছেড়ে দেবেন। না, চ্যালেঞ্জ কেউ নেয়নি। তবে, শরিয়তের মোকাবিলা করতে হয়েছে চোরাগোপ্তা পথে। এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য, ইউটিউবে শরিয়তের এই কথায় তাঁর ইসলামি ধর্মাবেগে আঘাত লেগেছে। অতএব মামলা। অতএব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ফেলে শরিয়তের তিন থেকে পাঁচ দিনের জেলহাজত।
দৃশ্য তিন: বছর দুয়েকের রিওয়াইন্ড। বাংলাদেশের নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল হালিমের বাড়ি। তিরিশ নভেম্বর নিয়মিতভাবে লালন সাঁইয়ের সঙ্গীতের আসর বসার কথা। দুহাজার ষোল। আর বসল না। স্থানীয় হেফাজতে ঈমান নামক একটি মৌলবাদী সংগঠন লালনের গানকে ইসলাম-বিরোধী আখ্যা দিয়ে থানায় যায়। কেন ‘জয় গুরু’, ‘খ্যাপা’ এসব শব্দ? এ তো পরিষ্কার ‘অ-ইসলামীয়’! শাসানি। লিফলেট বিলি। প্রশাসনিক সাঙ্গপাঙ্গদের তলব। হল না লালন-সঙ্গীত। লালন-ভক্তরা আরও বড় কোনও আশঙ্কায় দিন গুনছেন।
দুটো দেশ। একটা সীমান্ত। দুটো সরকার। ভুল। আসলে পড়ুন একটা সরকার। পোলারাইজেশনে, মতলবি প্রশাসনে পারফেক্ট একটা হেড অফ দ্য স্টেট। ধর্মীয় মৌলবাদের হাত ধরা রাজনীতির দাদা-দিদি। কেন গান? কারণ সঙ্গীত-কবিতা বিরোধিতার সাহস দেখায়। মৌলবাদকে প্রশ্ন করার সাহস দেখায়। রাষ্ট্রকে, ফ্যাসিবাদকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার দেখায়। আর তাতেই ভয়। তাতেই ফতোয়া। তাতেই নিপিং অন দ্য বাডের মতো ধূর্ত পদক্ষেপ। বিদ্রোহকে বাড়তে দিও না। একবার বেড়ে উঠলেই তখন হাতের বাইরে চলে যাবে। মৌলবাদী রাষ্ট্র শিল্পকলাকে এভাবেই দেখে। সরাসরি সরকার-বিরোধিতা না থাকলেও সরকার বা ধর্মীয় সংগঠনের মতবাদের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনওরকম শিল্পকলার চোরাগোপ্তা কন্ঠরোধ, সেন্সর।
এবার আসি, সাফাইয়ের দিকটা। লখনৌয়ের ঘটনায় ‘ইহাঁ কাওয়ালি নেহি চলেগা’র প্রসঙ্গে ওপরতলার সরাসরি অস্বীকার। ওটা আয়োজক আর শিল্পীর ব্যক্তিগত সমঝোতার অভাব। ধর্ম টর্ম টানবেন না। অথচ, প্রকাশ্যে শাসানি। সরাসরি কাওয়ালি বিরোধিতার প্রমাণ। মঞ্জরী তো সেসব রেকর্ড করে রাখেননি। কাকে শোনাবেন? কোন রাজ্যে? যেখানে তিনি খোদ জন্মেছেন? বয়াতি গান। শরিয়ত কেন ইউটিউবে দিলেন? অথচ যুক্তিপূর্ণ কথার প্রচার সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ায় অন্যায় কোথায়? তিনি তো ব্যক্তিগত কুৎসা ছড়াননি। চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। বুদ্ধির উত্তর বুদ্ধিতে দেওয়া যাক না। কিন্তু, সেখানেই গেঁড়ো। মৌলবাদ বুদ্ধির চর্চাতে অভ্যস্ত নয়। ধামাধারী প্রশাসনও। তাই, ডিজিটাল সিকিউরিটি ল। যেমনটি, নেত্রকোণার সঙ্গীত-উৎসব। শান্তি-শৃঙ্খলার অভাবের দোহাই। আলম উলেমারদের উপজেলা নির্বাহী কমিটিতে নালিশ। পৌরুষহীন প্রশাসন বিন্দুমাত্র সমীক্ষা বা যাচাই না করে উৎসব বন্ধ করে দেয়। কার উৎসব? লালন-সাঁই। ‘কেউ মালা কেউ তসবী গোনে, তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে। যাওয়া কিংবা আসার কালে, জাতের চিহ্ন কার রয় রে।’ হাসছেন ফরিস্তা। ধর্মহীন, জাতহীন এক মহামানব। সঙ্গীত-সাধক।
তাহলে থাকলটা কী? সাধক পাগলা বাবলুর আক্ষেপ– “কষ্টটা হইতাছে, যেখানে লালন বলছেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সেখানে এখনো যদি এরকম ঘটনা ঘটে, তাতে শুধু বাউল ব্যথিত হয় না, আমার মনে হয় গোটা মানবজাতিটাই ব্যথিত হয়। লালন বলছেন, ‘ঠিক পথে চলরে আমার মন, পরের নারী, পরের দ্রব্য হরণ করো না’। কিন্তু এটাও তো হরণ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে হরণ হয়ে যাচ্ছে।” মঞ্জরী লখনৌ শহরের মানুষ। তাঁর নিজের শহরে এভাবে ব্রাত্য শিল্পী? সম্পূর্ণ উদাসীন প্রশাসন? মুখ্যমন্ত্রীর আসার তাড়ার দোহাই দিয়ে সাঙ্গীতিক ফতোয়া? এখনও ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগছে মঞ্জরীর। আধুনিক এবং লোকজ গানের শিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলামের কথায়– ‘কবিগানের লড়াই, এটা তো চিরন্তন শরিয়ত এবং মারফতির একটা লড়াই। এই লড়াইটা বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমেই হত। কিন্তু এবার যেটা হল, তাতে আবার প্রমাণ হল যে আমাদের এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বার বার আহত হচ্ছে।’ বাংলা একাডেমির লোকসঙ্গীত গবেষক সাইমন জাকারিয়া অন্য একটা দিক তুলে ধরেছেন। তাঁর কথায়, ‘গ্রামের মানুষ থানায় গিয়ে একজন শিল্পীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে অন্য ব্যাপার জড়িত– এটা শুধু ধর্মের সাথে শিল্পীর দ্বন্দ্ব না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, আমাদের সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্ব পরিবর্তিত হয়ে গেছে, আমাদের শিক্ষায় ও প্রশাসনে এসব বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে। হয়তো প্রশাসনযন্ত্রই এই গানকে খুব ভালো চোখে দেখছেন না।’ লীনা পারভিনের চোখে আশঙ্কা এবং হতাশা। ‘তিনি কিছু প্রশ্ন করেছেন, যার জবাব যুক্তির মাধ্যমে দেয়া যেত। কিন্তু তা না করে এই গ্রেফতারের মাধ্যমে তাহলে প্রতিষ্ঠা করা হল যে, এই সমাজে কেউ গান গাইতে পারবে না, বা কেউ কি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে না?’
আশাটুকু থাকে। মঞ্জরী সেদিন গান থামালেও বলে গেছেন, জানুয়ারির শেষে ‘গ্র্যান্ড ইউপি ডে’-তে তিনি কাওয়ালি নিয়ে আসছেন। লালন-সঙ্গীত এবং গায়কদের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করে আসছেন আক্তারী মমতাজের মতো অসংখ্য মানুষ এবং তাঁদের সংস্থা। লালন-ভক্তরা আশঙ্কায় থাকলেও গান বন্ধ করেননি। বয়াতি গায়কেরাও থামবেন না। শরিয়ত রাস্তা দেখালেন মাত্র। আলো তার পথ ধরে আসবে।
শেষটুকু ফয়েজ আহমেদেই হোক। সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ছিয়াশি সালে লাহোরে কালো শাড়ি পরে ইকবাল বানোর সুরারোপিত ফয়েজের বিখ্যাত ‘হাম দেখেঙ্গে’ গান। আইআইটি কানপুরের পাঁচজন অধ্যাপকের একটি প্যানেল ঠিক করতে চলেছে এই ‘হাম দেখেঙ্গে’-র কয়েকটি লাইন কতটা রাষ্ট্রদ্রোহী। অ্যান্টি-ইন্ডিয়া। এক অধ্যাপকের আনা ফতোয়া অনুযায়ী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তানের জিয়া-উল-হকের জামানায় ওই কটা লাইন কোরান-বিরোধী বলে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ফয়েজ থাকলে কী বলতেন? ‘হামনে তো লিখ দিয়া, আব আপকে হালত নেহি বদলে তো কেয়া করে’। তো, কী ছিল ওই কটা কথা?
‘জব আর্জ-এ-খুদা কা কাবে সে, সব বুট উঠায়ে যায়েঙ্গে
হাম আহল-এ-সফা মরদুদ-এ-হারাম, মসনদ পে বিঠায়ে যায়েঙ্গে
সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে, সব তখত গিরায়ে যায়েঙ্গে’।
ভবিষ্যৎ জানা নেই। শাসানি আসবে। সঙ্গীত সাময়িক রুদ্ধ হবে। তবু, বিরুদ্ধতা কোনওদিন শিল্পকে আটকাতে পারবে না। মৌলবাদহীন, রাষ্ট্রযন্ত্রহীন পৃথিবীতে একদিন সঙ্গীতসাধনা, ঈশ্বরসাধনা, খ্যাপার সাধনা চলবেই।
‘বস নাম রহেগা আল্লাহ কা, হাম দেখেঙ্গে …’