অমিত দাশগুপ্ত
লেখক অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বাজেট পেশ করার সময় এগিয়ে এসেছে। আর মাত্র ৬ দিন বাদেই বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তবে বাজেট পেশ করার পরে নতুন কোনও অর্থমন্ত্রী নিয়োজিত হবেন কিনা তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে। কারণ, দেশের অর্থনীতি উত্তরোত্তর নিম্নাভিমুখী। এমনিতেই সর্বক্ষেত্রে কারচুপিতে দক্ষ এই সরকারের বাজেট তেমন কোনও ব্যয়-আয় সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করে না, ফলে বাজেট পরবর্তী বিশ্লেষণ বহুলাংশেই এক অ্যাকাডেমিক অনুশীলন হয়ে দাঁড়ায়। গত বছরে, নির্বাচনী বছরে, দেশ দুইখান বাজেট পেয়েছিল। একটি নির্বাচনের আগে অপরটি নির্বাচনের পরে। দুটি বাজেট পেশ করেছিলেন দুটি অর্থমন্ত্রী, একজন অস্থায়ী, শ্রী পীযূষ গোয়েল। অপরজন স্থায়ী, শ্রীমতি সীতারামন। যদিও রীতি অনুযায়ী নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ বাজেটের পরিবর্তে ভোট অন অ্যাকাউন্টস পেশের দস্তুর, কিন্তু মোদি সরকার কোনও ভদ্র রীতিকেই ভোটের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা বোধ করে না। তাই সেই বাজেটটিও ছিল পূর্ণাঙ্গ বাজেট। তবে নির্বাচনে জেতার পরে আবারও একটি পূর্ণাঙ্গ বাজেটকে নব কলেবরে পেশ করেছিলেন নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী। পীযূষ গোয়েলের পেশ করা বাজেটে পূর্ববর্তী বিত্তবর্ষ ২০১৮-১৯-এ যে রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের অনুমান করা হয়েছিল তা প্রকৃত আয় ও ব্যয়ের তুলনায় যথেষ্টই বেশি; যথাক্রমে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ০.৯%) ও ১ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ০.৮%)। মনে রাখা দরকার নির্বাচনের আগে পেশ করা বাজেটে এই অতিরিক্ত ব্যয় ও আয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। কেবল তাই নয়, অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রকাশিত হওয়ার পরে যখন সেই সমীক্ষায় বাস্তব পরিমাণ জানানো হচ্ছে তখনও অর্থমন্ত্রী তাঁর পেশ করা বাজেটে ওই অন্তর্বর্তী বাজেটের ভুল অনুমানগুলিকেই নিয়ে বাজেট পেশ করেছিলেন। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন যে, বরাবরই সংশোধিত আনুমানিক রাজস্ব আদায় ও সংশোধিত আনুমানিক ব্যয়ের তথ্যই বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি এটা বলতে চাননি যে বাজেট প্রস্তুতের সময়ে বাস্তব রাজস্ব আদায় ও বাস্তব ব্যযের তথ্য জানা থাকে না কারণ বাজেট প্রস্তুত হয় বর্ষ শেষ হওয়ার আগে। তাছাড়া, সমস্ত অনুমানকেই যতটা সম্ভব বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া ও তার উপরে ভিত্তি করে বাজেট প্রস্তুত করাই উচিৎ। তবে এই সরকারের অর্থমন্ত্রীর কাছে তেমনটা আশা করা বৃথা। তিনি ব্রিফকেসের বদলে শালুতে মোড়া খাতা ব্যবহারের চমক দেখাতে পারেন, কিন্তু তথ্যকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুবিধে অনুযায়ী পুরনো রীতি মেনে জানা তথ্যের বদলে ভুল তথ্যকেই ব্যবহার করেন।
ফলে ২০১৯-২০ সালের বাজেট ও বাস্তবের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক পাওযা যাবে তা বলাই বাহুল্য। সরকারি আয় ব্যয়ের তথ্য থেকে মনে হচ্ছে বাজেট প্রদত্ত আনুমানিক ব্যয়ের পরিমাণের তুলনায় প্রকৃত ব্যয় ২ লক্ষ কোটি থেকে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা কম হবে। অন্য দিকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও অনুমানের তুলনায় ২.৫ লক্ষ কোটি টাকার মত কম হবে। নভেম্বর মাস পর্যন্ত বিত্তবর্ষের প্রথম ৮ মাসে বাজেট বরাদ্দের ৬৫% খরচ করা হয়েছে; তবে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ব্যয়ের পরিমাণ সেপ্টেম্বরের ব্যয়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। যেহেতু বর্তমান মূল্যে জিডিপির পরিমাণের বৃদ্ধি ৭.৫%-এর কাছাকাছি হবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে যা বিত্তবর্ষের শুরুতে অনুমিত ১১.৫% বৃদ্ধির তুলনায় অত্যন্ত কম। তাই ওই মোট ব্যয়ের পরিমাণের হ্রাসও রাজকোষ ঘাটতিকে বাজেট প্রস্তাবিত জিডিপির ৩.৩%-এর মধ্যে বেঁধে রাখতে পারবে না। বরং তা টপকে ৩.৮%-এ পৌঁছবে। রাজকোষ ঘাটতিকে ৩%-এর মধ্যে বেঁধে রাখার যে অদম্য লক্ষ্যমাত্রা কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করেছে সেটাই যেন বাজেটের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কমলে যখন সরকারি রাজস্ব আদায় কমে তখন সরকার ব্যয় বাড়িয়ে চাহিদা সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার বদলে রাজকোষ ঘাটতি সামাল দিতে সরকারি ব্যয় কমায়। এমনটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণকে কমিয়ে দেখানোর চালাকিটিও চলতে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বাজার থেকে যে ঋণ নেয়, যা প্রকারান্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষ ঘাটতিকে কমায়, যাকে বাজেটবহির্ভূত রাজকোষ ঘাটতি হিসেবে ধরা হয়, তা জুড়লে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে, এর সঙ্গে রাজ্য সরকারগুলির রাজকোষ ঘাটতিকে যোগ করতে হবে।
গত বছরের প্রথম বাজেট পেশ করার সময়ে দেশের অর্থনীতির হাল ভালো ছিল না। কিন্তু, নির্বাচনমুখী সরকার তা মানতে নারাজ ছিল। ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারকে ৭.৫%-এর অধিক বলে গণ্য করা হয়েছিল। তার উপরে দাঁড়িয়ে বাজেট, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ এগুলি হিসেব করা হল। জুলাই মাসে যখন নতুন অর্থমন্ত্রী পুনরায় বাজেট পেশ করছেন তখন থেকেই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির শ্লথতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৮-১৯ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৭% থাকবে। কিন্তু সেই ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছিল ৫%-এ। পরের ত্রৈমাসিকে ৪.৫%। অতি সম্প্রতি সেই হার সারা বছরের প্রেক্ষিতে, জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের অনুমানে ৪.৯৫%-এ দাঁড়াবে, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের অনুমানে তা ৪.৮%-এ নেমে আসবে। চলতি টাকার মূল্যে যে জিডিপির অনুমিত পরিমাপ ছিল ২১১ লক্ষ কোটি টাকা, তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০৪ লক্ষ কোটি টাকা। যদি রাজকোষ ঘটতি পূর্বে উল্লেখিত জিডপির ৩.৮%-এ দাঁড়ায়, তাহলে তার পরিমাণ বাজটে অনুমিত ৭ লক্ষ কোটি টাকার থেকে বেড়ে ৭.৭৫ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। যেহেতু রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আনুমানিক ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা কমবে তাই হিসেব অনুযায়ী বাজেট ব্যয় কমবে প্রায় ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকায়। বাজার থেকে ঋণ সংগ্রহের মাধ্যমে সরকার আরো ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করছে। তা সত্ত্বেও ব্যয় হ্রাসের পরিমাণ ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা শতাংশ হিসেবে মোট বাজেট ব্যয়ের ৪-৫ শতাংশ।
প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই ব্যয়ের হ্রাস কোন কোন ক্ষেত্রে করা হবে বা করা হচ্ছে? যতদূর জানা যাচ্ছে সরকারের বহুল প্রচারিত জনকল্যাণের ক্ষেত্রগুলিতে বরাদ্দ হ্রাস হয়েছে। ১০০ দিনের কাজে টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে না। ফলে কাজ করলেও খেত মজুর বা ছোট চাষিরা যথাসময়ে টাকা পাচ্ছেন না। মনে রাখা দরকার, ওই প্রকল্প মানুষের কাজ করতে চাওয়ার উপর নির্ভর করে। ফলে বাজেট বরাদ্দ মানুষ কত কাজ করতে চাইবে সেই অনুমানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু যদি মজুরি দেরি করে দেওয়া হয়, তাহলে কাজ করতে চাওয়ার উৎসাহ কমে আসে। সরকার দেখাতে পারে গ্রামাঞ্চলে প্রচুর উন্নয়নের ফলে ১০০ দিনের কাজ চাইতে আসা মানুষের সংখ্যা কমেছে। আদতে, সরকারের যথাসময়ে টাকা দিতে পারার অপারগতাকে পরিসংখ্যানের গোলকধাঁধায় উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হয়ে যায়। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পে (প্রতি ৪ মাসে ২০০০ টাকা) অর্থ প্রদানে ধীর গতি নেওয়ার মাধ্যমে অর্থ বাঁচানো হচ্ছে। এরকম জনকল্যাণ কর্মসূচিকে খর্বিত করার ফলে গ্রামাঞ্চলে কৃষকের হাতে অর্থ পৌঁছচ্ছে না। গ্রামীণ চাহিদা কমেছে। ফলে অর্থনীতির গতি শ্লথ হচ্ছে। কর্মসংস্থানে ভাঁটা পড়ছে। অন্যদিকে খাদ্যদ্রব্যের দাম দ্রুত হারে বাড়ছে, সেই অনুপাতে শিল্পপণ্যের দাম না বাড়ায় এক ধরনের বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গত নভেম্বর মাসে জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর পুনরায় ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ৫ বছরের ভোগব্যয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে চেপে দিয়েছে। গোপনে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ পেয়েছে তা জানিয়ে দিয়েছে যে, ২০১১-১২ সালের প্রকৃত মাথা পিছু ভোগব্যয়ের (মাসিক ১৫০১ টাকা, ২০০৯-১০ সালের টাকার মূল্যে) তুলনায় ২০১৭-১৮ সালের মাথাপিছু ভোগ ব্যয় ৩.৭% কমে মাসিক ১৪৪৬ টাকায় পৌঁছেছে। মাথাপিছু ভোগব্যয়ের হ্রাস যথেষ্ট গুরুতর বিষয়। গত চার দশকে এটি প্রথম ঘটেছে। এর আগে ১৯৭২-৭৩ সালে এমনটা ঘটেছিল, যখন ফসলের উৎপাদন হ্রাস ও ওপেক দেশগুলির পেটোলিয়ামজাত জ্বালানির মূল্য হ্রাস মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়ে জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু এখন তেমন কিছু ঘটেনি।
গ্রামীণ ভারতে এই ভোগব্যয় হ্রাসের পরিমাণ ৮.৮%, নগর ভারতে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২%। এর জন্য কেবল নোট বাতিল আর জিএসটিই দায়ী নয়, যদিও সেগুলি খারাপ পরিস্থিতিকে দুঃসহ করে তুলেছে। সরকার উৎপাদন ও ভোগব্যয়ের চিত্রকে আলাদা বলতে চাইছে। কিন্তু আমরা যদি কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রের উৎপাদিত মূল্য যোগের দিকে খেয়াল রাখি ও সেই মূল্যযোগকে কৃষির উপরে নির্ভরশীল জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ দেই, এবং গ্রামীণ ভারতের ভোগ্যপণ্য সূচকের ব্যবহার করি তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৩-১৪ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে কৃষিনির্ভর জনসাধারণের মাথাপিছু বাস্তব আয় কমেছে। কৃষিনির্ভর জনসাধারণের মধ্যে জোতদাররা আছে যাদের আয় কমেনি বলেই ধরা যেতে পারে। ফলে কৃষিনির্ভর শ্রমজীবী জনতার মাথাপিছু আয় অনেক বেশি কমেছে। গোপনে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী খাদ্যপণ্যের উপর মাথাপিছু ভোগব্যয়ের হ্রাস (২০১১-১২র তুলনায় ২০১৭-১৮তে) গ্রামীণ ভারতে ১০%। ফলে ধারণা করাই যেতে পারে গ্রামীণ ভারতে দারিদ্রের তীব্রতা বেড়েছে। যেহেতু পরিসংখ্যান মোদি সরকারের নীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে তাই সরকার এই পরিসংখ্যানকে একদম প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী সমীক্ষার সময়কাল ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩। ঐ সময়ের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কাঙ্খিত পরিবর্তন ঘটিয়ে ওই সমীক্ষায় উজ্জল ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। এমন কারচুপি চলতেই থাকবে।
যদিও ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীও কমে চলেছে, শিল্পোৎপাদন সূচকের অবস্থা তথৈবচ, তবুও মুদ্রাস্থীতির হার বাড়ছে। যখন শিল্পোৎপাদন সূচকের সঙ্কোচন যে সমস্ত মাসে ঘটছে, আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, সেই সমস্ত মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার গতিময় হয়ে উঠছে। ভারতের খুচরো ভোগ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির হার ডিসেম্বর, ২০১৮র তুলনায় ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে ৭.৩৫%। গত ৫ বছরে সর্বোচ্চ। অনুরূপ এক সময়বিন্দু থেকে এক বছর আগের সেই সময়বিন্দুতে মুদ্রাস্ফীতির হার গত জানুয়ারি, ২০১৯ থেকেই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আগস্ট মাসে তা ৩.২৮%-এ পৌঁছেছিল। তার পর থেকে এই বৃদ্ধির হার দ্রুততর হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ৩.৯৯%, অক্টোবরে ৪.৬২%, নভেম্বরে ৫.৫৪% হওয়ার পরে ডিসেম্বরে পূর্বে উল্লেখিত ৬.২%%-এ পৌঁছতে পারে। ফলে খুচরো ভোগ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতির হার, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সীমা, ২% থেকে ৬%-কে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
কিন্তু সমস্যাটা অনেক গভীরে রয়েছে। যখন অর্থনীতিতে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তখন মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পাওয়াকে অনেকে স্ট্যাগফ্লেশন বলে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাহ্যিক কারণে কস্ট পুশ মুদ্রাস্ফীতি পরিলক্ষিত হয়, যেমনটা ১৯৭২-৭৩ সময় কালে ওপেকের পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ঘটেছিল। এখন তেমনটা ঘটেনি। ভারতীয় অর্থনীতিতে চাহিদাও বাড়েনি। ফলে এই মুদ্রাস্ফীতি চাহিদা বৃদ্ধিজনিতও নয়। মূলত খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতিকে বাদ দিয়ে দিলে অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন মুদ্রাস্ফীতি দেখতে পাওয়া যাবে না। ওই সমস্ত ক্ষেত্রে চাহিদার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, কারণ মানুষকে খাদ্যদ্রব্যের উপরে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতি গরিব জনসাধারণকে বেশি অসহায় করে তুলছে। এই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে যোগ হচ্ছে দুধের দাম ও টেলিফোনের মাশুল বৃদ্ধির চাপ, এসে উপস্থিত হচ্ছে তেলের দামের দ্রুত বৃদ্ধি, ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের পতন। সব মিলিয়ে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
তবে সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতিতে চাহিদার ঘাটতি না থাকার ইঙ্গিত নয়। অর্থনীতির নিম্নাভিমুখী যাত্রা চাহিদার ঘাটতিজনিত কারণেই ঘটছে। মুদ্রাস্ফীতির বৃদ্ধি সেই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে, উভয়ে মিলে কর্মহীনতার হারকে গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ করে তুলেছে। এর থেকে উদ্ধার পেতে দরকার সামগ্রিক চাহিদার বৃদ্ধি ঘটানো ও অন্যদিকে নির্দিষ্ট সংবেদনশীল পণ্যের ক্ষেত্রগুলিতে জোগানকে বাড়িয়ে তোলা। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে রেশনিং-এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট মূল্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করে অর্থনীতিতে বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কর্পোরেটের মুনাফা ও সম্পদের উপর কর বসিয়ে জনকল্যাণমূলক ব্যয় বাড়াতে হবে। আকাঙ্খা করা যেতে পারে বাজেটে তেমনটা করা হবে। কিন্তু যদি বাজেট সম্পর্কে অনুমান করতে বলা হয়, তাহলে আকাঙ্খার সঙ্গে সেই অনুমান মিলবে না। কারণ এই সরকার জনগণের আশা আকাঙ্খাকে পূরণ করার বদলে কর্পোরেট পুঁজির প্রত্যাশা পূরণেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। ফলে সরকার তার বিপরীতটাই করছে। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের জোগান ব্যবস্থাপনাকে তারা বাজারে হস্তক্ষেপ বলে এড়িয়ে যাচ্ছে। আর চাহিদা বৃদ্ধির জন্য ভোক্তার উপরে নির্ভর না করে কর্পোরেট ক্ষেত্রে বিনিয়োগ চাহিদা বৃদ্ধির জন্য কর্পোরেটের কর কমাচ্ছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাচ্ছে।
এদিকে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাও ক্রমাগত ধ্বস্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাঙ্কগুলির মোট সম্পদের মধ্যে ৯.৩% ছিল অনুৎপাদক সম্পদ, যা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৯.৯%-এ দাঁড়াবে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনুমান করছে। ব্যাঙ্কগুলির যথোপযুক্ত মূলধন অনুপাতও কমবে, ২০১৯ সেপ্টেম্বরে ১৪.৯% থেকে কমে ২০২০ সেপ্টেম্বরে ১৪.১%-এ দাঁড়াবে। অপরদিকে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের ঋণ প্রদানের চিত্রটিও যথেষ্টই সমস্যাময় অর্থনীতির দিকে দিকনির্দেশ করছে। খাদ্য ব্যতিরেকে অন্য ক্ষেত্রে প্রদত্ত ঋণ বৃদ্ধির হার গত অক্টোবর, ২০১৮ থেকে অক্টোবর, ২০১৯ এই বর্ষকালের তুলনায় নভেম্বর, ২০১৮ থেকে নভেম্বর, ২০১৯ বর্ষকালে ৮.৩% থেকে কমে ৭.২% হয়েছে। শিল্প, সেবা, ব্যক্তিগত ঋণ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ঋণ বৃদ্ধির হারের শ্লথতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পূর্বে উল্লেখিত সময়কালে শিল্পক্ষেত্রে ঋণ বৃদ্ধির হার ৩.৪% থেকে কমে ২.৪% হয়েছে। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে তা ১৭.২% থেকে কমে ১৬.৩% হয়েছে ও ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য ঋণের বৃদ্ধি খুবই কম, মাত্র ৪%। ফলে ভোগব্যয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটবে না ধরা যেতে পারে। সামগ্রিকে বলা যায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে পর্যায়ক্রমে সুদের হার ১.১% কমাল তা ঋণ চাহিদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি।
আগেই বলা হয়েছে যে, প্রকৃত রাজকোষ ঘাটতি কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে প্রতিফলিত হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারের কম কর রাজস্ব সংগ্রহের অর্থ রাজ্য সরকারগুলি কেন্দ্রের থেকে কম অর্থ পাবে, কারণ মোট রাজস্বের ৪২% রাজ্যগুলির কাছে যায়। যদি বাজেট ব্যয়ের কোনও ছাটাই না হয়, তাহলে সব মিলিয়ে রাজকোষ ঘাটতি জিডিপির ১১%-এর কাছাকাছি পৌঁছবে। কেন্দ্রীয় বাজেটের পরিমাণ মোট জিডিপির ১৫%-এর মত। সরকারের চাহিদা বাড়ানোর জন্য দুটো উপায় আছে। হয়, ব্যয় বাড়ানোর ফলে রাজকোষ ঘাটতি বাড়ানো, অথবা কর আদায় বাড়িয়ে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘাটতি না বাড়িয়েই চাহিদা বাড়ানো। বর্তমানে, যেহেতু অর্থনীতিতে অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা রয়ে গিয়েছে, তাই অর্থনীতিকে দুর্বল না করেই, সাধারণ মুদ্রাস্ফীতি না বাড়িয়েই ঘাটতি বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়া এর ফলে বেসরকারি বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না কারণ, বেসরকারি ক্ষেত্রে ও ব্যাঙ্কে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে।
যদি সরকার অতিরিক্ত ঘাটতির প্রতি অনাগ্রহী হয়, তাহলে ধনীদের উপরে করের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। সম্পদ কর, উপহার কর, উত্তরাধিকার কর বসিয়ে ও উচ্চ ধনীদের উপরে আয়কর বাড়িয়ে সেই অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। যদি দেশের ৫% অতি সম্পদশালীর উপরে অতিরিক্ত ১% কর আদায় করা হয় তাহলেই জিডিপির ১.৫%-এর বেশি আদায় করা যেতে পারে। এই অর্থ গ্রামাঞ্চলে সামাজিক পরিকাঠামো নির্মাণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রকল্পে ব্যয় করা যেতে পারে। যার ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রেও সহায়তা পৌঁছবে, চাহিদা বাড়বে, রাজকোষ গাটতি বাড়বে না। তদর্থে, বৃদ্ধির হার বাড়লেই, কররাজস্ব আদায়ও বাড়বে, রাজকোষ ঘাটতি কমবে।
ধনী কর্পোরেট মালিকরা চাইবে সরকার করের হার আরও কমাক, বিলগ্নিকরণের দ্বারা রাজকোষ ঘাটতি মেটাক। কিন্তু এটা করা সহজ নয়। বেসরকারি মালিকরা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি কিনতে তেমন আগ্রহী হবে না, যদি না সরকার সেগুলিকে অত্যন্ত কম দামে বিক্রি করে দেয়। তাছাড়া এই কাজ অর্থনীতির চাহিদা বাড়াবে না কারণ এটি কেবল সম্পদ হস্তান্তর ঘটাচ্ছে, কোনরকম বিনিয়োগ চাহিদা তৈরি করছে না। কিন্তু অনুমান করা যেতে পারে সরকার ধনী কর্পোরেটদের আকাঙ্খাই মেটাবে। তাই এই বাজেটের কাছে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সফল করার জন্য কোনও দিকনির্দেশ পাব বলে মনে হচ্ছে না।